- Home
- India News
- কৃষক আন্দোলন - মনমোহন-বুদ্ধ ভট্টাচার্যের রাস্তাতেই চলেছেন নরেন্দ্র মোদী, পরিণতি কি একই হবে
কৃষক আন্দোলন - মনমোহন-বুদ্ধ ভট্টাচার্যের রাস্তাতেই চলেছেন নরেন্দ্র মোদী, পরিণতি কি একই হবে
- FB
- TW
- Linkdin
২০১১ সালে যখন ইউপিএ-২ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আন্দোলন শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে, তখন মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বাধীন (সনিয়া গান্ধী নিয়ন্ত্রিত) ইউপিএ-২ সরকার, প্রথমে সেই আন্দোলনকে পাত্তাই দেয়নি। কিছু অনুগামীদের নিয়ে রাজধানীতে নিয়মিত আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন, দেখেও দেখেনি সরকার। তারপর যখন সেই আন্দোলনের পালে জোর বাতাস লেগেছে, তখন আন্না হাজারে, কেজরিওয়ালদের মতো আন্দোলনের পুরোধা-সহ সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেফতার করেছিল দিল্লি পুলিশ। সিঙ্গুর-নন্দিগ্রাম আন্দোলনের সময়ও পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারকে একি রকম ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছিল।
আবার সেই ছবিই দেখা যাচ্ছে দিল্লিতে। প্রথমে সংসদে সংখ্যার জোরে কৃষকদের সংগঠনগুলির সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই ভারতীয় কৃষির আইনি কাঠামো আমূল বদলে দিল সরকার। এমনকী বিজেপি-র কৃষক সংগটগুলির সঙ্গেও আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেননি মোদী। বিলটি আইন হওয়ার পর থেকেই পঞ্জাব-সহ সারা দেশেই তা নিয়ে ছোট-বড় প্রতিবাদ হয়েছিল। তাতে কর্ণপাত করেনি মোদী সরকার। তারপর কৃষকরা দিল্লি যাত্রা শুরু করলে ব্যারিকেড দিয়ে, বোল্ডার দিয়ে, রাস্তা খুঁড়ে, জল কামান এবং টিয়ার গ্যাস ব্যাবহার করে, লাঠির বাড়ি মেরে - নানাভাবে তাদের দিল্লি আসা আটকানোর চেষ্টা করা হল। শেষ পর্যন্ত দিল্লির সীমান্তে কৃষকরা যখন শিবির গড়লেন, তখনও সরকার আলোচনার জন্য় একাধিক শর্ত চাপালো।
কৃষকদের বলা হল দিল্লির বিশেষ ময়দানে আন্দোলন স্থানান্তর করার জন্য ৫০০টিরও বেশি সংগঠন আন্দোলনে সামিল হলেও আলোচনায় ডাকা হল মাত্র ৩২টি সংগঠনকে। অর্থাৎ তাদের সংহতি ভেঙে, বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হল। কিন্তু সেই ফাঁদে পা দেননি কৃষকরা। আর এই মুহূর্তে আলোচনায় কোনও কাজ হওয়ার অবকাশ নেই। একদিকে সরকার সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ওই তিন কৃষি আইন বাতিল করা ছাড়া, অন্য যে কোনও বিষয়ে তারা আলোচনায় রাজি। আর অন্যদিকে কৃষকরাও সংকল্পবদ্ধ, তিনটি কৃষি আইনই প্রত্যাহার করা ছাড়া অন্য কোনও সমাধানে তারা আগ্রহী নয়।
বিষয়টি মোদী সরকারে জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, কারণ এখনও পর্যন্ত মনমোহন সরকারের মতো আন্দোলনের প্রকৃতি এবং সমর্থনের ভিত্তিটা সরকার ও দলের একাংশ হয় বুঝতে পারছেন না, অথবা বুঝেও বুঝতে চাইছেন না। কৃষকদের আন্দোলনকে লঘু করতে, পঞ্জাবের মধ্যসত্তবভোগীদের আন্দোলন, খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন, কমিউনিস্টদের আন্দোলন, কংগ্রেসের নতুন আক্রমণ শানানোর প্ল্যাটফর্ম - বিভিন্ন নাম দেওয়া হচ্ছে চলতি আন্দোলনকে। বলা হচ্ছে কই পঞ্জাবের মতো অন্য রাজ্যের কৃষকরা তো এমন করছেন না। সেইসঙ্গে দেওয়া হচ্ছে এমএসপি বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আশ্বাস।
আন্দোলনের প্রকৃতিটা সত্যিই কি তাই? সত্যিই কি এটা শুধু পঞ্জাবের কৃষকদের বিচ্ছিন্ন আন্দোলন? এমএসপি রক্ষার লড়াই? হয়তো শুরুতে তাই ছিল, কিন্তু, যত দিন যাচ্ছে ততই কিন্তু এই আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের রূপ নিচ্ছে। অনেকটা যেমন আন্না হাজারের আন্দোলন ইউপিএ-২ সরকারে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন হিসাবে শুরু হয়ে, শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছিল গত ৭০ বছরের কংগ্রেস সরকারের শাসনামলে ভারতের জাতীয় হতাশা ব্যক্ত করার প্ল্যাটফর্মে, পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশের কন্ঠস্বরে। কিংবা সিঙ্গুর-নন্দিগ্রাম থেকে শুরু হয়ে, পশ্চিমবঙ্গে যেমন বাম সরকারের সমস্ত ত্রুটির দিকে আঙুল তুলেছিল আন্দোলন, সেই ভাবেই।
নিঃসন্দেহে এখনও আন্দোলনের পুরোভাগে আছেন পঞ্জাবের কৃষকরা। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের কৃষকরাও। কোভিড পরিস্থিতিতে দেশের অন্যআন্য অংশ থেকে বিরাট সংখ্যক কৃষক এই আন্দোলনে যোগ দিতে না পারলেও, দেশের প্রায় সব অংশ থেকে কৃষক সংগঠনের নেতা-প্রতিনিধিরা কিন্তু পৌঁছে গিয়েছেন দিল্লিতে। এমনকী, আরএসএস-সমর্থিত ভারতীয় কিষাণ সংঘ-ও এই আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে। এটি এখন একটি জাতীয় আন্দোলন।
শুধু তাই নয়, দেশের প্রতিটি অংশের কৃষকরা আন্দোলনটা কী নিয়ে তা হয়তো ভালো করে জানেন না, কৃষি আইন তাঁদের ভালোর জন্য না খারাপের জন্য তাও হয়তো এখনও বোঝেন না। কিন্তু গত কয়েকদিনে যেভাবে কৃষকদের দিল্লি আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে, যেভাবে তাঁদের উপ দমন নীতি চলছে, তাতে কৃষকদের মনে এমন একটা ধারণা কিন্তু তৈরি হয়ে গিয়েছে যে, মোদী সরকার খুব খারাপ কিছু করছে।
এখানেই শেষ নয়। ন্যূনতম সমর্থন মূল্য, বা কৃষি পণ্যের দামের নিশ্চয়তা এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও, দীর্ঘদিন ধরে চলা এই আন্দোলন এখন আর এই ক্ষুদ্র অংশে আটকে নেই। সরকারে প্রাথমিক উদাসিনতায় আন্দোলনের ব্যপ্তি এখন এমএসপি ছাড়িয়ে বৃহত্তর ক্ষেত্রে চলে গিয়েছে। প্রথমে ব্যবস্থা নিলে এমএসপি-র নিশ্চয়তা সম্ভবত কৃষকদের উদ্বেগ দূর করতে পারত, কিন্তু এখন প্রতিটি কৃষক সংগঠন একটাই দাবি জানাচ্ছে - তিনটি কৃষি আইনই বাতিল করতে হবে।
তবে এই কৃষক আন্দোলন এখন সত্যি বলতে এই তিনটি আইনের পরিসরেও আটকে নেই, স্বাধীনতার পর থেকে একের পর এক সরকার যেভাবে তাদের বঞ্চনা করেছে, সেই বঞ্চনার ক্ষোভের বহিপ্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই অবস্থায় সমাধানের পথ একমাত্র দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতাকে কাজে লাগিয়ে কৃষকদের সঙ্গে বসে তিনটি আইনই বাতিল করে তাদের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার কাজটা এখনও পারলে নরেন্দ্র মোদীই করতে পারেন। তবে সমস্যা হল ক্ষমতা অত্যন্ত খারাপ জিনিস। তা অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বকেও অন্ধ করে দিতে পারে। অনেকে শাসকই এই ক্ষেত্রে আরও দমন পিড়নের রাস্তায় নেমে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম সরকার তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। একইভাবে সংখ্যার জোরে অন্ধ হয়ে উন্নয়ন চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল বুদ্ধ ভট্টাচার্য সরকার। তার পরিণতি ২০১১ সালেই প্রকট হয়েছিল। এখন নরেন্দ্র মোদী কোন রাস্তায় হাঁটেন, সেটাই দেখার।