সংক্ষিপ্ত

শ্রীনিবাস রামানুজন, একজন "ম্যাথমেটিক্যাল জিনিয়াস"। কারো কারো কাছে,  "গণিতের মোৎজার্ট"। মানসিক নির্যাতন আর শারীরিক অসুস্থতায় বিরক্ত হয়ে লন্ডনের একটি ব্রিজের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন একদিন।তারপর? রামানুজন ২য় ভারতীয় যিনি ইংল্যান্ডের  র‍য়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ পান। প্রায় ৩,৯০০ সমীকরণের ওপর কাজ করে গেছেন তিনি যা ভাবতেও অবাক লাগে। তার এত কাজের মধ্যে "পাই"য়ের অসীম সিরিজ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাত্র ৩৩  বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া ক্ষণজন্মা এই প্রতিভাবান গণিতজ্ঞের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর জন্মদিন ২২ ডিসেম্বরকে ভারতে ‘জাতীয় গণিত দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়। একসময় লেখার জন্যে যথেষ্ট কাগজ কেনার সামর্থ অবধি তাঁর ছিলো না। শ্রীনিবাস রামানুজনের অজানা জীবনকথায় অনিরুদ্ধ সরকার
 

১৮৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ভারতের মাদ্রাজের তাঞ্জোর (Chennai, Tanjavur) জেলার ইরেভদ শহরের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীনিবাস রামানুজান ( Mathematician Srinivas Ramanujan)। রামানুজনের বয়স যখন মাত্র এক বছর, তখন তার মা তাকে নিয়ে কুম্ভকোনাম চলে যান। সেখানে এক কাপড় ব্যবসায়ীর দোকানে কেরানির চাকরি করতেন রামানুজানের বাবা কে শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার (Srinivas Ayengar)। মা কোমালাতাম্মাল ছিলেন সাধারণ গৃহিণী, (National Mathematics Day) মাঝে মাঝে স্থানীয় মন্দিরে গান করতেন। স্কুলের শিক্ষকদের কাছে ছোট্ট মেধাবী রামানুজুনের পরিচয় ছিলো ‘শিশু গণিতবিদ’। প্রথম থেকেই প্রবল অর্থকষ্ট ছিল নিত্যসঙ্গী। বাড়ি থেকে অনেক দূরের স্কুল তো তাঁকে হেঁটে যেতেই হত।শোনা যায়, লেখার জন্যে যথেষ্ট কাগজ কেনার সামর্থ অবধি তাঁর ছিলো না। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই অঙ্কে ছিল অসামান্য মাথা। আর তাঁর এই দক্ষতার জন্যে রামানুজনকে  (Srinivas Ramanujan) কুম্ভকোনাম-এর আর্ট কলেজ স্কলারশিপ প্রদান করে। কিন্তু কলেজে গণিত নিয়ে বেশি মগ্ন থাকেন। যার জেরে অন্য বিষয়গুলিতে বিশেষ মনোযোগ দিতে পারেন না।ফলে যা হয়। অঙ্ক বাদে বাকি বিষয়গুলোতে ফেল করলেন রামানুজন (Srinivas Ramanujan)। যার জন্য তাঁর স্কলারশিপও বাতিল হল।

পরে অনেক চেষ্টা করে শেষ অবধি স্বপ্ন পূরণ হল রামানুজনের (Srinivas Ramanujan)। একদিন পৌঁছলেন ইংল্যান্ড। তবে সেখানে গিয়ে তাঁর স্বাস্থ্য ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। শেষমেশ তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। রামানুজনকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করার দিন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ম্যাথম্যাটিশিয়ান রামানুজনের (Mathematician Ramanujan) বন্ধু হার্ডি তাকে দেখতে আসেন। তিনিই রামানুজনকে ইংল্যান্ডে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি জানতেন রামানুজন সব সময় অঙ্ক (Mathematics)  নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন। 

হার্ডি তাই ট্যাক্সি থেকে নেমেই রামানুজনকে  (Srinivas Ramanujan) বললেন, "আমি যে ট্যাক্সিতে এসেছি, সেটার নম্বর কত জানো?"

রামানুজন বলে - "না, জানিনা।"

 হার্ডি বললেন- "১৭২৯।"

রামানুজন শুনে বললেন, "১৭২৯!"

হার্ডি ব ললেন, "হ্যাঁ।"

রামানুজন বিছানা থেকে উঠে বললেন, "জানো এই সংখ্যার মজা?"

হার্ডি বললেন, " না।" 

রামানুজন (Srinivas Ramanujan) বলতে শুরু করল, " তাহলে শোনো। ১৭২৯ হল দুটি সংখ্যার কিউবের যোগফল।"হার্ডি একমনে শুনে গেল রামানুজনের ব্যাখ্যা। সব শুনে হার্ডি অবাক হয়ে যায়। সে তো ওই সংখ্যা কথার কথা বলেছিল,মজা করতে। কিন্তু এই সংখ্যা যে ইতিহাস তৈরি করবে তা হার্ডি জানতেন না। গণিতের ইতিহাসে (History of Mathematics) তাই এই ১২৭৯ সংখ্যাটি স্মরণীয় হয়ে আছে। সংখ্যাতত্ত্বে ১৭২৯ সংখ্যাটিকে তাই বলা হয় "হার্ডি-রামানুজন সংখ্যা"। লাজুক বলে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে (Cambridge University) রামানুজনকে (Srinivas Ramanujan) নিয়ে অনেকেই ঠাট্টা তামাশা করত। ইংরেজ সহপাঠী ছাড়া শিক্ষকরাও মজা কর‍তে ছাড়ত না রামানুজনকে  (Srinivas Ramanujan) নিয়ে।অন্যদিকে ইল্যান্ডের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না তিনি। একদিন মানসিক নির্যাতন আর শারীরিক অসুস্থতায় বিরক্ত হয়ে লন্ডনের একটি ব্রিজের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন একদিন। পুলিশ তাঁকে ধরে ফেলে ও পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যায়। বন্ধু হার্ডি খবর পেয়ে সঙ্গেসঙ্গে থানায় ছুটে যান ও পুলিশকে গিয়ে বলেন- "আপনি জানেন উনি কে?" পুলিশ বলে -"না, জানিনা"। তখন হার্ডি বলেন, "উনি শ্রীনিবাস রামানুজন (Srinivas Ramanujan)। রয়্যাল সোসাইটির একজন ফেলো। রয়্যাল সোসাইটির একজন ফেলোকে আপনি জেলে রাখতে পারেন না।"


পুলিশ একথা শুনে সসম্মানে রামানুজকে (Srinivas Ramanujan) ছেড়ে দেন। হার্ডির এই "মিথ্যে গল্প"  অবশ্য কয়েক মাস পরে সত্যি হয়ে যায়। রামানুজন (Srinivas Ramanujan) সত্যি সত্যি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। আর তিনি ২য় ভারতীয় হিসেবে এই ফেলোশিপ পান। এটা সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয়। ১৯১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রামানুজন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের (Cambridge University) দার্শনিক সমিতির সদস্য পদে মনোনীত হন। তাঁর জীবনে অর্জিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব ছিল এটি। বিশ্বের নামকরা সব গণিতজ্ঞরা তাঁর নাম সুপারিশ করেন। যার মধ্যে বন্ধু হার্ডি ছাড়াও ছিলেন গণিতজ্ঞ ম্যাকমাহন, গ্রেস, লার্মোর, ব্রমউইচ, হবসন, বেকার, লিটলউডের মত দিকপাল গবেষকরা। ১৯১৮ সালের ২ এপ্রিল তিনি সেখানে নির্বাচিত হন এবং ওই একই বছরের ১০ অক্টোবর কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের সদস্য হিসেবে নিয়োজিত হন তিনি। 


১৯১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের উদ্দেশে রওনা হন রামানুজন (Srinivas Ramanujan)। ১৩ মার্চ বাড়ি পৌঁছান কিংবদন্তী এই গণিতজ্ঞ।ফেরার অল্পদিনের মধ্যে যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে রামানুজনের। অনেক ডাক্তারের মতে রোগটি ছিল "হেপাটিক অ্যামিবিওসিস" বা "অ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি"। আবার কারো মতে নিষ্ঠাবান নিরামিষাশী ব্রাহ্মণ রামানুজন ইল্যান্ডের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারার জন্যেই স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে যার জেরে দেশে ফিরতেই অসুস্থতা বেড়েছিল দ্বিগুণ। আর যেহেতু রামানুজন বংশগতভাবেই দুর্বল স্বাস্থ্যের ছিলেন তাই খুব তাড়াতাড়ি তিনি শশয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। দেশে ফেরার ঠিক একবছরের ২২ ডিসেম্বর রামানুজন পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ১৯২০ সালের ২৬ এপ্রিল মারা যান এই "ম্যাথমেটিক্যাল জিনিয়াস" 9Mathematical Genius)। গণিত জগতে অবদানের জন্য তাঁকে কেউ কেউ বলেন, ‘গণিতের মোৎজার্ট’। আর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর জন্মদিন ২২ ডিসেম্বরকে ভারতে ‘জাতীয় গণিত দিবস’ (National Mathematics Day)হিসেবে উদযাপন করা হয়।