সংক্ষিপ্ত
বিশ শতকের প্রথম দিকে অরবিন্দ বাংলার বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনকে একক কর্ম-পরিকল্পনার আওতায় আনার জন্য তাঁর যোগ্য সহকারী জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দেন। জিতেন্দ্রনাথকে কাজে সহযোগিতার জন্য ১৯০৩ সালে বারীনকে কলকাতায় পাঠানো হয়।
বিপ্লবী বারীন ঘোষের (Barin Ghosh) প্রথম পরিচয় তিনি বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের ভাই (Brother of Arabindo Ghosh)। জন্মেছিলেন লণ্ডনে। দাদার অনুপ্রেরণায় বিপ্লবী হন। আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত বারীনকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যা পরে ‘কালাপানি’ অর্থাৎ আন্দামান সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বদল করা হয়। ১২ বছর আন্দামানের জেলে কাটিয়ে বারীন ঘোষ (Barin Ghosh) মুক্তি পান। জেল থেকে ফিরে যান পণ্ডিচেরীতে দাদা অরবিন্দের কাছে।দাদা তখন আর বিপ্লবী নন, ঋষি অরবিন্দ। বারীন ঘোষেত অজানা কথায় অনিরুদ্ধ সরকার।
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ (BrindraKumar Ghosh) কোন্নগরের কৃষ্ণধন ঘোষ ও স্বর্ণলতা ঘোষের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। লন্ডনের উপকণ্ঠে নরউড-এ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভারতে ফিরে "বারীন" নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৮৯৮ সালে দেওঘর-এর এক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্র্যান্স পরীক্ষা পাস করে পাটনা কলেজে ভর্তি হন। তিনি অবশ্য আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা বেশিদিন অব্যহত রাখতে পারেন নি। বারীন্দ্রকুমার ঢাকায় তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মনমোহন ঘোষের কাছে কিছুদিন কাটান এবং এখানেই প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ কালিপদ বসুর স্নেহভাজন হন। সেখান থেকে তিনি বরোদা যান। বারীন বরোদায় অনুধাবন করে, রাজনীতিকে ধর্মের সঙ্গে একীভূত না করলে কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনে (Political Movement) কাজ হবে না। এজন্য তিনি গীতা পাঠের সঙ্গে রাজনীতির পাঠ দেবার উদ্দেশ্যে অনুশীলন সমিতির পরিকল্পনা করেন ও উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন।।সেখানে তিনি রাইফেল চালনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে চলতে থাকে ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা।
অরবিন্দ ঘোষ (Arabindo Ghosh) তখন বরোদা কলেজে অধ্যাপনা করেন। দাদার অনুপ্রেরণায় তিনি ধীরে ধীরে বিপ্লবী আন্দোলনে (Freedom Movement) জড়িয়ে পড়েন। দাদা ছিলেন বঙ্কিমের লেখার ও বন্দেমাতরম গানের (Vandemataram Song) গুনমুগ্ধ ভক্ত। বিশ শতকের প্রথম দিকে অরবিন্দ বাংলার বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনকে (Revolutionary Organization) একক কর্ম-পরিকল্পনার আওতায় আনার জন্য তাঁর যোগ্য সহকারী জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দেন। জিতেন্দ্রনাথকে কাজে সহযোগিতার জন্য ১৯০৩ সালে বারীনকে কলকাতায় পাঠানো হয়। কিন্তু ভিন্ন মনোভাব ও চিন্তা-চেতনার কারণে বারীন ও জিতেন্দ্র-এর মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। ১৯০৬ সালে স্বদেশী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন বিপ্লবী চেতনা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বারীন ঘোষ সাপ্তাহিক "যুগান্তর" পত্রিকা প্রকাশ করেন। যুগান্তরের জনপ্রিয়তায়, বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে, বারীনের গতিবিধি ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সন্দিহান করে তোলে। বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক হয়রানির স্বীকার হলেও তিনি ছিলেন অদম্য।
এরপর অরবিন্দর অনুপ্রেরণায় ও বারীনের নেতৃত্বে কলকাতার ৩২নং মুরারিপুকুরে তৈরি হয় সশস্ত্র বিপ্লবী দল, "অনুশীলন সমিতি" (Anushilon Samiti)। ৩২নং মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়িটি ছিল বারীনদের পৈত্রিক সম্পত্তি। সশস্ত্র বিপ্লবী নেতা বারীন তাঁর দলের আখড়া গড়েছিলেন মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে। এই বাগানবাড়ির মাঝখানে ছিল ছোটো একটি পাকাবাড়ি। বাড়িটির চতুর্দিকে ছিল গাছপালা। অরবিন্দ ঘোষ এবং অপর দুই ভাই মনোমোহন ঘোষ ও বিনয় ঘোষ এই বাগানবাড়িতে বসবাস করতেন। অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে পরামর্শ করে এই বাড়িতেই বারীন, উল্লাসকর দত্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় , হেমচন্দ্র ঘোষ, অবিনাশ ভট্টাচার্যর মত বিপ্লবীরা দলের নীতি নির্ধারণ করতেন। একসময় এই ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটি হয়ে ওঠে সশস্ত্র বিপ্লবীদের মূল কেন্দ্র
১৯০৭ সালে অল্প কয়েকজন নিবেদিত প্রাণ যুবককে নিয়ে বারীন মানিকতলা বিপ্লবী দল (Revolutionary Organization) গঠন করেন, যাদের কাজ ছিল অস্ত্র সংগ্রহ ও বিস্ফোরক তৈরি করা। তাদেরকে অত্যাধুনিক অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বারীন ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতার মানিকতলায় তরুণ স্বদেশীদের বোমা তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। মানিকতলার সেই জায়গাটি এখন “বোমার মাঠ” নামে খ্যাত। ১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল। ইংরেজ বিচারক কিংসফোর্ড সাহেবকে হত্যার দায়িত্ব পান ক্ষুদিরাম বোস ও প্রফুল্ল চাকী (Khudiram Bose & Prafulla Chaki)। এই কিংসফোর্ড ছিলেন ভারতবিদ্বেষী। সামান্যতম অপরাধে বিপ্লবীদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দিতেন। কিন্তু কিংসফোর্ড হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বোমার আঘাতে দুজন ইংরেজ মহিলা মারা যান। ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose) ধরা পড়েন। প্রফুল্ল চাকী (Prafulla Chaki) ধরা না দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯০৮ সালের ১১-ই আগস্ট ক্ষুদিরামের (Khudiram Bose) ফাঁসি হয়।
গুপ্তচরদের মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবীদের গতিবিধি লক্ষ্য করে যাচ্ছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৯০৮ সালের ২ মে কলকাতার ব্রিটিশ প্রশাসনের পুলিশ আটটি জায়গায় খানা-তল্লাশি চালায়। মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত ও নলিনীকান্ত গুপ্তসহ ১৪ জনকে। ৫ই মে, ৪৮নং গ্রে স্ট্রিট থেকে অরবিন্দ ঘোষসহ তিনজনকে, ১৩৪নং হ্যারিসন রোড থেকে ৫ জনকে, রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে হেমচন্দ্র দাস কানুনগো, গোপীমোহন দত্ত লেন থেকে কানাইলাল দত্তসহ দুইজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের এই মামলাটির নামকরণ হয় ‘আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা’ (Alipur Bomb Conspiracy Case)। মোট ৩৭ জন অভিযুক্ত আসামিকে বিচারের জন্য চালান দেওয়া হয়। ১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর আলিপুরের জেলা ও দায়রা জজ মি. চার্লস পোর্টেন বিচক্রাফটের আদালতে ‘মুরারিপুকুর বোমা মামলা’র (Murarippukur Bomb Case) সূচনা হয়। পরে যা আলিপুর বোমা মামলা নামে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়।এই মামলায় অরবিন্দ ঘোষের (Arabindo Ghosh) ওপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। বিপ্লবীদের হয়ে মামলা মামলা লড়তে এলেন উদীয়মান ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ।তিনি বিনা পারিশ্রমিকে এই মামলায় লড়লেন। তখন তাঁর মাসিক আয় ছিল পাঁচ হাজার টাকা। আর এই মামলা পরিচালনা করতে তাঁকে চল্লিশ হাজার টাকা দেনা করতে হয়েছিল। অরবিন্দ ঘোষের (Arabindo Ghosh) বিরুদ্ধে এই মামলা চলে ১২৬ দিন। দু’শর বেশী সাক্ষীকে জেরা করা হয়। ৪০০০ কাগজপত্র এবং ৫০০ জিনিসপত্র প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর সওয়াল জওয়াবের পরিসমাপ্তি বক্তব্য দেন ৯ দিন ধরে। অরবিন্দ ছাড়া পান। এই মামলা চলাকালীন স্বীকারোক্তিতে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ (BarindraKumar Ghosh) সম্পূর্ণ দায় নিজের উপর তুলে নেন।এই মামলায় প্রথমে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যা পরে ‘কালাপানি’ অর্থাৎ আন্দামান সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বদল করা হয়। ১৯২০ সালে “জেনারেল এমনেস্টির” ফলে, ১২ বছর আন্দামানের জেলে কাটিয়ে বারীন ঘোষ সহ বাকি সকলে মুক্তি পান।
প্রায় এক দশক পর ঔপনিবেশিক সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বারীনকে কলকাতায় এনে মুক্তি দেওয়া হয়। দুবছর পর বারীন রাজনীতির পথ (Barindrakumar's political path) ছেড়ে কলকাতায় একটি আশ্রম খোলেন। ১৯২৩ সালে তিনি পন্ডিচেরীতে দাদা অরবিন্দের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দাদা তখন ঋষি অরবিন্দ। আর বিপ্লবী নন।পন্ডিচেরীতে থাকাকালীন যোগী অরবিন্দের প্রভাবে ‘সাধনা’ও তাঁর 'দর্শনে'র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ৬ বছর পর, ১৯২৯ সালে তিনি পুনরায় কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেষ দিকে তিনি কলকাতার "স্টেট্সম্যান" পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং একজন কলাম লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। পরে তিনি "বসুমতী"র সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।তিনি বিভিন্ন দর্শন ও ধর্মের সমম্বয়ে একটি সর্বব্যাপী আত্মিক চেতনা সৃষ্টিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।১৯৫৯ সালের ১৮ এপ্রিল, ৭৯ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন।