সংক্ষিপ্ত

অনেক সংবাদমাধ্যমই মেনে নিয়েছিল জরুরী অবস্থা

তবে অনেকেই মানেনি, প্রতিবাদ করেছিল

তবে সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করাটা ইন্দিরা গান্ধী সরকারের কাছে ছিল জলভাত

তিনটি মূল অস্ত্রে সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল সরকার

 

১৯৭৫ সালের জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণার সময় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে বিশিষ্ট বিজেপি নেতা এল কে আদবানি বলেছিলেন, 'ইন্দিরা গান্ধী সংবাদমাধ্যমকে মাথা নত করতে বলেছিলেন, তারা শুরু করেছিল হামাগুড়ি দিতে'। তবে সব সংবাদমাধ্যমই নিজেদের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিল তা নয়। কিন্তু, যেভাবে ইন্দিরা সরকার সংবাদমাধ্যমের গলা টিপে ধরেছিল, তাতে আত্মসমর্পণ অনেকের কাছেই একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠেছিল। ভারতীয় গণতন্ত্রের সেই কালো অধ্যায়ের ৪৫ বছরে দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে সংবাদমাধ্যমের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছিলেন তিনি।

খবরের কাগজে কী কী রাজনৈতিক খবর ছাপা হবে, কী হবে না - সবই নিয়ন্ত্রণ করতেন ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী। তার তত্ত্বাবধানেই ইন্দিরা গান্ধী সরকার সংবাদমাধ্যমকে 'জীবাণুমুক্ত' করার অভিযান চালিয়েছিল। আর তার ফলে প্রতিটি সংবাদমাধ্যমই হয়ে উঠেছিল সরকারি মুখপত্র। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের যেসব তথ্য বেঁধে দিত, তার বাইরে কিছু লেখার অধিকার ছিল না। এমনকী কখনও কখনও সেন্সর করার নামে ইচ্ছে করে দেরি করিয়ে দেওয়া হত, যাতে সেই বিশেষ খবরটি ছাপা না যায়। বাধ্য হয়ে কাগজগুলিতে পৃষ্ঠা ফাঁকা রাখা বা পেঁয়াজের রায়তা বানানোর পদ্ধতির মতো জিনিস ছাপতে হত সেই জায়গায়। কারণ রাজনৈতিক খবর বিনা সম্মতিতে প্রকাশ করা যাবে না।

ইন্দিরা গান্ধী সরকার প্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তিনটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন - ১. সরকারী বিজ্ঞাপন বরাদ্দকরণ, ২. নিউজ এজেন্সিগুলিকে চাপ দিয়ে একত্রিত করা, এবং ৩. প্রকাশক, সাংবাদিক এবং স্বতন্ত্র শেয়ারহোল্ডারদের ভয় দেখানো বা অন্য যে কোনও উপায়ে হাতে রাখা।

গত শতাব্দীর সাতের দশকে ভারতীয় সংবাদপত্রগুলির অস্তিত্ব অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল সরকারী বিজ্ঞাপনের উপর। এই খাতে যে উপার্জন হত, তা ছাড়া বেশিরভাগ ভারতীয় সংবাদপত্রের পক্ষেই ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন ছিল। ফলে সরকারি হাতে বন্দি হওয়ার ঝুঁকি তাদের সবসময় ছিল। ইন্দিরা গান্ধী সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে এই নির্ভরশিলতাকে তারা সংবাদপত্রগুলির বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চলেছে। প্রেস সেন্সরশিপ না মানার কারণে 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' এবং 'দ্য স্টেটসম্যান' পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

ইন্দিরা প্রশাসনের প্রেস নিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় অস্ত্র ছিল চারটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভারতীয় ভারতীয় সংবাদ সংস্থা - ইংরেজি ভাষার প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (পিটিআই) এবং ইউনাইটেড নিউজ অফ ইন্ডিয়া (ইউএনআই)  এবং হিন্দি ভাষার সমাচার ভারতী এবং হিন্দুস্তান সমাচার-কে একসঙ্গে মিলিয়ে একটি সংস্থায় পরিণত করা। এই সংযুক্তির পিছনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সংবাদ সংস্থাগুলির পরিচালন পদ্ধতির পরিবর্তন এবং সংবাদপত্রের বেশিরভাগ বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করা। এই চারটি সংস্থাই ছিল সেই সময়ের খবরের কাগজগুলির লাইফলাইন। তাই তাদের দেওয়া তথ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ইন্দিরা গান্ধীর খবরের কাগজগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হত।

এই অস্ত্র প্রয়োগ করতে সরকার বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। এই এজেন্সিগুলির বোর্ডের সদস্যদের উপর চাপ দেওয়া হয়েছিল। সরকারি ভর্তুকি আটকে রেখে আর্থিক সংকোচনের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। সংবাদ সংস্থাগুলির লাইফলাইন টেলি-প্রিন্টার পরিষেবাগুলি কেটে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। ডাক ও টেলিগ্রাফ বিভাগ বলেছিল একত্রিত না হলে, ইউএনআই-এর পরিষেবা স্থগিত করে দেওয়া হবে। এমনকী এতে সম্মিত না হলে সর্বভারতীয় রেডিও-র পক্ষ থেকে তাদের বড় অঙ্কের বকেয়া পরিশোধ না করার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।

তৃতীয় উপায়, প্রেসকে বজ্রমুষ্টিতে টিপে ধরা। অর্থাৎ সরকারের কথা না শুনলেই সরাসরি প্রতিশোধ। করের বকেয়া নিয়ে চাপ, নিউজপ্রিন্ট কোটা হ্রাসের হুমকি, প্রকাশক এবং তাদের পরিবার পরিজনদের ভুয়ো মামলায় কারাবাস, প্রেস বন্ধ করার হুমকি এবং দিল্লির সাংবাদিকদের সরকারি আবাসন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাগুলি কেড়ে নেওয়া - এইরকম অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর স্বত্বাধিকারী রামনাথ গোয়েঙ্কা জানিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী সরকার তাঁকে এবং তাঁর শিল্পগোষ্ঠীর সংস্থাগুলির অর্থনৈতিক ক্ষতি করার জন্য আইনী প্রক্রিয়াকে বিকৃত করতেও পিছপা হয়নি।

কীসের যুক্তিতে ইন্দিরা গান্ধীর ভারতীয় গণমাধ্যমগুলিকে দমন করতেন? এই অনৈতিক কাজকে ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছিল তিনটি বড়মাপের অনুমানের ভিত্তিতে। বলা হয়েছিল, নাগরিক স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার থেকে অর্থনৈতিক উত্পাদনশীলতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ভারতের সংবাদমাধ্যমের কাজে অর্থনৈতিক উত্পাদনশীলতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে গুরুতর বাধা তৈরি হচ্ছিল, এবং নাগরিক স্বাধীনতা এবং প্রেসের অধিকারগুলি কঠোর সংকোচনের ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উত্পাদনশীলতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রচার করার ক্ষমতা বাড়বে।

এইসব প্রধান পদক্ষেপগুলি ছাড়াও ইন্দিরা গান্ধী সরকার বিভিন্ন অন্যান্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল যা প্রিন্ট মিডিয়ার উত্পাদন ও প্রচারকে প্রভাবিত করেছিল। যেমন জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরপরই দিল্লি সংবাদপত্রগুলিতে বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই দিল্লির বেশিরভাগ সংবাদপত্রই ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন তাদের পত্রিকার দৈনিক সংস্করণ প্রকাশ করতে পারেনি।  প্রিন্ট মিডিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর এই স্বৈরাচারী অবস্থানকে উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করেছিলেন, তখনকার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা। তাঁকে নিজে হাতে বেছে নিয়েছিলেন খোদ সঞ্জয় গান্ধী। তবে সবচেয়ে বড় আঘাত নেমেছিল অবশ্যই ১৯৭৬ সালে 'আপত্তিজনক বিষয় প্রকাশনা প্রতিরোধ আইন' জারি হওয়ায়। এই আইন ছিল ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে মৃত্যুঘন্টার মতো। এই আইনের ফলে সরকারবিরোধী সমালোচনা বা সরকারী নীতির বিরোধিতা করার মতো সমস্ত প্রচার নিষিদ্ধ হয়েছিল।