সংক্ষিপ্ত

আফগানিস্তানের শাসনভার তালিবানদের হাতে যাওয়ার পর থেকে সীমান্তপারের সমস্যা নিয়ে ভারতের চিন্তার কারণ বেড়েছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র উপত্যকার শান্তি বিঘ্ন করতে ব্যবহারের ষড়যন্ত্রের কথাও শোনা যাচ্ছে। এর সঙ্গে ৩৭০ ধারার বিলোপ নিয়ে কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা করছে। এমন পরিস্থিতিতে কতটা তৈরি ভারতীয় সেনাবাহিনী, এই নিয়ে মুখ খুলেছেন সদ্য কাশ্মীর থেকে মধ্যপ্রদেশের সেনার যুদ্ধ কৌশল প্রশিক্ষণ কলেজের কম্যান্ডান্ট পদে যোগ দেওয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডে। 
 

লেফটেন্যান্ট জেনারেল দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডে, সোমবার দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন মধ্যপ্রদেশের মোহে সেনাবাহিনীর ওয়ার কলেজের কম্যান্ডান্ট পদে। এই নতুন দায়িত্বভার নেওয়ার আগে দেবেন্দ্র প্রতাপ শ্রীনগরে চিনার ক্রপস (এক্সভিক্রপস)-এর দায়িত্বে ছিলেন। কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাস দমনে লেফটেন্যান্ট দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডের নেতৃত্বে চিনার ক্রপস এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। এমনকী, জঙ্গি দমেন দেবেন্দ্র প্রতাপের কৌশলের খুব নাম করেছিল। 

উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরের বাসিন্দা লেফটেন্যান্ট দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডে। দেরাদূনের ন্যাশলাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি-র প্রাক্তন ছাত্র দেবেন্দ্র প্রতাপ ১৯৮৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি পান। আর সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি শিখ লাইট ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন। দেবেন্দ্র-র সবচেয়ে বড় সাফল্য অন্তত ২০০ যুবকে কাশ্মীর উপত্যকায় জঙ্গি হওয়াতে আটকাতে পেরেছিলেন। তাদের জীবন শেষ হওয়ার আগেই তাঁদের রক্ষা করেছিলেন দেবেন্দ্র এবং ফিরিয়ে এনেছিলেন জীবনের মূল স্রোতে। এহেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডের মুখোমুখি হয়েছিল এশিয়ানেট নিউজ।

এশিয়ানেট নিউজ- দীর্ঘ কয়েক বছর  ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় কম্যান্ডান্ট পদে কর্মরত ছিলেন, আপনার অভিজ্ঞতাটা কেমন? কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়েছিল আপনাকে? 

লেফটেন্যান্ট দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডে- গত এক বছরে আমার সময়কালে উপত্যকায় এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর নিরাপত্তা ব্যবস্থার খুবই উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে আগের কতগুলি বছরে যে ধরনের অবস্থা ছিল, তার থেকে উন্নতি হয়েছে। নিউ নর্মালে আশায় বুক বেঁধেছে কাশ্মীরা। কারণ, অতিমারির কারণে পর্যটন শিল্প এক্কেবারে মন্দার মধ্যে পড়েছে। এই বছর সরকারের পক্ষ থেকে কাশ্মীরের বুকে নতুন করে বিভিন্ন ধরনের পর্যটন উৎসব চালু করার প্রস্তুতি চলছে। এটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালে কাশ্মীরের ভেঙে পড়া পর্যটন শিল্প ফের চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে। আর এটা যে হবে তাতে আমি নিশ্চিত। 

চ্যালেঞ্জের কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হয় হোয়াইট কলার টেরোরিস্ট-দের কে কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর জন্য একাধিক সরকারি এজেন্সি একসঙ্গে কাজ করছে। যে সব সরকারি কর্মচারি জঙ্গিদের সঙ্গ দিচ্ছে বা তাদের সাহায্য করছে সেই সব লোকেদের জরুরির ভিত্তিতে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের কড়া পদক্ষেপে কার্যত একটু পিছিয়ে গিয়েছে জঙ্গিরা। এমনটা যে হতে পারে তা তারা আঁচ করতে পারেনি। সীমান্ত পার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র এদেশে পাচার করা থেকে শুরু করে মাদক পাচার- এখন অনেকটাই কমেছে। এর মধ্যে এনআইএ হাওলার অর্থে তল্লাশি চালানোয় জঙ্গিরা এখন কার্যত দিশেহারা। এর ফলে জঙ্গিদের অর্থ পাওয়ার রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এমনকী কাশ্মীরবাসীও বুঝতে পেরেছে যে একদল মানুষ যারা বিতর্ককে জিইয়ে রাখতে চাইছে তাদের অসৎ উদ্দেশ্যকেও। কাশ্মীরে পরিবর্তন অবশ্যাম্ভাবি এবং খুব দ্রুত এই পরিবর্তন হচ্ছে। 

এশিয়ানেট নিউজ- জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার পর কেটে গিয়েছে ৩টে বছর। এই নিয়ে এই মুহূর্তে কি প্রতিক্রিয়া কাশ্মীরে বসবাসকারীদের?
 
লেফটেন্যান্ট দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডে- সবচেয়ে বড় পাওনা আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি। বিশেষ করে ২০১৯-এর অগাস্টের পর এতে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। এর বড় প্রমাণ যে এই সময়ের পর থেকে কাশ্মীরে নিরাপত্তা রক্ষীদের উপর পাথর ছুঁড়ে মারার ঘটনায় কোনও মৃত্যুর পরিসংখ্যান শূন্য। এমকী, উত্তেজিত জনতার নিরাপত্তারক্ষীদের উপর হামলাতেও কোনও মূত্যুর সংখ্যা নেই। আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি যে উপত্যকায় আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা এই মুহূর্তে খুবই ভালো এবং সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আগামী বছরগুলোতে কাশ্মীরকে স্বাভাবিক করে তোলার পথে এগুলি খুবই সহায়ক হবে এবং কাশ্মীরের শান্তি ও সুরক্ষায় এগুলি শক্তি জোগাবে। 

কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে এক বিশাল পরিকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। এরমধ্যে যেমন রয়েছে শ্রীনগরকে রেলপথে সংযুক্ত করা তেমনি রয়েছে সব ধরনের আবহাওয়ায় কাশ্মীর থেকে লেহ-এর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সুগম করা। সোনমার্গে একটি বিশাল টানেল তৈরির কাজ চলছে। এমনকী আরও কিছু এমন টানেল নির্মাণ চলছে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করতে। সন্দেহ নেই এই সব মেগা প্রজেক্ট সম্পূর্ণ হতে অনেকটা বছর লেগে যাবে। কিন্তু যে গতিতে কাজ চলছে তা সত্যি নজিরবিহীন। কাশ্মীরবাসীও এটা অনুভব করেছে। সরকারও আগে থেকে অনেক বেশি তৎপর হয়েছে। পরিকাঠামো উন্নয়নের সরকারের উদ্যোগে সকলের চোখে পড়ছে। 

এশিয়ানেট নিউজ- পাকিস্তান সেনার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চলছে, বহু সময় দেখা গিয়েছে জঙ্গিরা এই সুযোগে সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে ঢোকার চেষ্টা করেছে কিন্তু জঙ্গিরা মারা পড়েছ, আপনাপ কি মনে হয় যে যুদ্ধ বিরতিতে পাকিস্তানের সায় আসলে জঙ্গি অনুপ্রবেশকেই সাহায্য করছে ?

লেফটেন্যান্ট দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডে- যুদ্ধ বিরতি দুদেশের কাছেই মঙ্গলের। বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বসবাসকারীদের জন্য এটা অতি ভালো। এরপরও জম্মু-কাশ্মীরে যে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি হচ্ছে তার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী অদৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণরেখা। আর জম্মু-কাশ্মীরের বুকে সীমান্তপার থেকে সন্ত্রাসে মদত দেওয়াটা পাকিস্তানকে বন্ধ করতে হবে। এমনটা হলে তবে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর শান্তি চিরস্থায়ী হবে। 

যে কোনও ধরনের অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর আমরা সজাগ এবং সতর্ক থাকি। অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য আমাদের যে বিশেষ বাহিনী রয়েছে তারা এই কাজে প্রচণ্ড দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এবং একের পর এক এমন প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। সীমান্তে আমাদের নজরদারি দল খুব ভালো কাজ করছে শুধু নয় সীমান্ত বরাবর আমাদের সেনা জওয়ানরা যথেষ্ট পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্রে বলিয়ান হয়ে উঠেছে, যা তাদের যে কোনও ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহায্য করে। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সংঘর্ষ বিরতি বজায় রাখার জন্য আমরা আন্তরিক এবং আন্তরিকতার সঙ্গে আগামীদিনেও ভারতীয় সেনা এই কাজ করে যাবে। 

এশিয়ানেট নিউজ- এমন খবর রয়েছে যে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্রকে এবার কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাস রোপণে কাজে লাগানো হচ্ছে, এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কীভাবে কৌশল তৈরি করছে ভারতীয় সেনা ? 

লেফটেন্যান্ট দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডে- এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা এবং তালিবানদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে তাতে ন্যাটোর ফেলে যাওয়া যে কোনও লক্ষ্যবস্তু ভেদ করার ক্ষমতা রাখা কার্তুজ ও নাইটভিশন বিভিন্ন ডিভাইসের সংখ্যা খুব একটা বেশি নেই। তাও আমরা নজর রাখছি এবং আফগানিস্তানে ন্যাটো-র অস্ত্র-বারুদ এবং বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম কেমন উদ্ধারের তথ্য হচ্ছে তা রেকর্ডে রাখছি । আমদের সেনা জওয়ানরা সাম্প্রতিক সমর দক্ষতা অনুযায়ী নিজেদের তৈরিও রাখছে। তবে, জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ এবং তাদের কৌশল এখনও যথেষ্ট অবাক করার মতো। কিন্তু, এই কৌশলে বারবার ব্যর্থ করছে আমাদের জওয়ানরা। আমরা সব সময়ে সতর্ক এবং নজর রেখে চলেছি এই ধরনের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য। 

এশিয়ানেট নিউজ- ইফতার আয়োজন নিয়ে একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছে, এমনকী আপনার ছবি এবং ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে, আপনি বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

লেফটেন্যান্ট দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডে- আমরা সর্ব ধর্ম সমন্বয়কে সবসময় মর্যাদা দেই এবং তাতে বিশ্বাস রাখি। একে আমরা সর্ব ধর্ম স্থলও বলে থাকি। এটা এমন একটা জায়গা যেখানে সব ধর্মের মানুষ এক সঙ্গে হয়ে সর্বাত্মক মঙ্গলকামনায় নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী একসঙ্গে প্রার্থনায় সামিল হয়। প্রবল উৎসাহ নিয়ে আমাদের প্রতিটি সদস্য যো কোনও ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করে। আমি যেমন খিস্টমাস পালন করি, তেমনি গুরু পরবও পালন করি, আবার দীপাবলিও করি। 

কাশ্মীর উপত্যকায় রমজান সবচেয়ে বড় উৎসব। এই ধরনের উৎসবে যোগ না দিয়ে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের মতোই আমাদের বিভিন্নপ্রান্তেও দেশবাসী ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে উৎসব পালনে একইভাবে সামিল হয়। এটা নতুন কোনও বিষয় নয়। অন্য উৎসব পালনের মতো এটাও একটা উৎসব। এই নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই।