সংক্ষিপ্ত

দেশের অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন কেন চিন উড়ছে আর ভারত শুধুই বেড়েছে? ২০১৯ সালের ফোর্বস ম্যাগাজিন এর একটি উত্তর দিয়েছিল। বলা হয়েছিল চিনে বাধা-হীন স্বৈরাচার আর ভারতের দুঃস্বপ্নের গণতন্ত্রই এর কারণ।

এস গুরুমূর্তি, কেন চিন (China) আর কেন ভারত (India) নয়? নির্দিষ্ট আর বিশ্বাসযোগ্য কোনও উত্তর ছাড়াই ভারতে একটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। দেশের অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন কেন চিন উড়ছে আর ভারত শুধুই বেড়েছে? ২০১৯ সালের ফোর্বস ম্যাগাজিন এর একটি উত্তর দিয়েছিল। বলা হয়েছিল চিনে বাধা-হীন স্বৈরাচার আর ভারতের দুঃস্বপ্নের গণতন্ত্রই এর কারণ। ফোর্বস উল্লেখ করেছে ১৯৮০  সালে ভারত আর চিন প্রায় সমান ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের মধ্যে চিনের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ভারতের তুলনায় চিনের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩.৫ গুণ। ফোর্বস ম্যাগাজিনে তুলনা করা হয়েছে চিন ও ভারতের বেশ কয়েকটি প্রকল্পকেও। যেখানে চিনের ইয়াংজি নদীর ওপর থ্রি গর্জেস ড্যামের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে ভারতের নর্মগা বাঁধের। 

ইয়াংসি বনাম নর্মদাঃ
চিনের থ্রি গর্জেল বাঁধ- ১৩টি নগর, ১৪০টি শহর, ১৩৫০টি গ্রাম প্লাবিত করেছে। লক্ষ লক্ষা মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। কিন্তু তারপরেই এক দশকের মধ্যে চিন এই বাঁধ নির্মাণের কাজ  সম্পন্ন করেছে। অন্যদিকে নর্মদা বাঁধে কোনও শহর প্লাবিত হয়নি। অল্প সংখ্যক কিছু গ্রামে প্রভাব পড়েছে। বাস্তু হারানোর সংখ্যা চিনের ১০ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করতে ভারতের লেগেছে ৪৮ বছর। জহরলাল নেহেরু ১৯৬১ সালে এই বাঁধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বিশ্বব্যাঙ্ক ১৯৮৫ সালে এটিকে অর্থ সাহায্য করতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন শুরুর পর তাও থমকে যায়। 

নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন সুপ্রিম কোর্টে যায়। ১৯৯৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দেয়। ১৯৯৯ সালে আদালত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে। বাঁধের উচ্চতা ৮৮ মিটার সীমাবদ্ধ করেদেয়। কিন্তু ১৯ বছরেরও বেশি সময় ধরে পাঁচটি কিস্তিতে বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়েছিষ ২০০০ সালে ৯০ মিটার, ২০০২ সালে ৯৫ মিটার ও ২০০৪ সালে ১১০ ও ২০০৬ সালে ১১২ আর শেষে ২০১৯ সালে ১৩৯ মিটার উচ্চতা বাড়িয়ে তা শেষ করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ভারতে নর্মদার বাঁধ নির্মাণে স্বৈরাচারী চিনের থেকে ৫ গুণ বেশ সময় লেগেছে। এই তথ্য তুলে ধরে ফোর্বস ম্যাগাজিত জিজ্ঞাসা করেছিল কেন চিন ক্রমবর্ধমান ভারতের ওপর দিয়ে উড়ে যাবে না। কিন্তু একটি বিষয় ফোর্বসের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। তা হলে ১৯৮৯-২০১৪ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ২৫ বছর ভারতে একটি অস্থির আপোষমূলক জোট ছিল।যা দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। 

১০ বছরে ৪টি নির্বাচন ও ৭জন প্রধানমন্ত্রী
১০ বছরে ১৯৮৯-১৯৯৯ সাল যখন গোটা বিশ্বে বিশ্বায়ন চলছে পশ্চিমের বাজারগুলি বাকিদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে সেই সময় ভারতের ৪টি সংসদীয় নির্বাচন  হয়। সেই ১০ বছরে ভারতের দায়িত্ব গিয়েছে ৭ জন প্রধানমন্ত্রীর হাতে। ভিপি সিং ১১, চন্দ্রশেখর ৪ মাস, নরসীমা রাও ৫ বছর, অটলবিহারী বাজপেয়ী ১৩ দিন, দেবেগৌড়া ১১ মাস, গুজরাল ১১ মাস,  তারপর আবার বাজপেয়ী ফিরে আসেন ১৩ মাসের সরকার নিয়ে। সেই একই সময়ে চিনের শাসনক্ষমা এক ব্য়ক্তির হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল- দেও জিয়াও পিং। ভারতের গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা না করে চিনকে গণতন্ত্রে পরিণত করার আশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৩ সালে চিনের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পৃক্ততা তৈরি করে। 

১৯৯৯-২০১৪ সালে ভারতের জন্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল যখন ভারতে পূর্ণ মেয়াদের জন্য বহুদলীয় জোট সরকার ছিল। বাজপেয়ী যিনি তাঁর জোটের ওপর আরও ভালো নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। এর আগেই সাহসীভাবে পোখরান বিস্ফোরণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু মনমোহন সিংএর মিডিয়া উপদেষ্ট সঞ্জয় বারুর মতে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে একজন প্রক্সিদাতা। সোনিয়া গান্ধীর হাতেই ছিল প্রকৃত ক্ষমতা। ১৯৮৯-২০১৪ সাল- পর্যন্ত এই ১০ বছর কেন্দ্র সরকার কতদিন টিকে থাকবে সেটাই ছিল একটি বড় প্রশ্ন। সেই সময় অনেক ভারতীয় ইন্দিরা গান্ধীর মত শক্ত কোনও নেতার হাতে দেশের দায়িত্বভার চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্ন দেখতেন স্থিতিশীল সরকারের। 

প্যারাডাইম শিফট
২০১৪ সাল, প্রধানমন্ত্রী নকেন্দ্র মোদী প্রায় ৩০ বছর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। তখনই দৃষ্টিটি বদলে যায়। বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। শুধু মোদী নয় ভারতীয় গণতন্ত্রও বিশ্বের আর্থা অর্জন করতে শুরু করে। ২০১৯ সালে মার্কিন ম্যাগাজিন ফরেন পলিসি বলেছিল, ভারতীয় গণতন্ত্র বিশ্বের কাছে একটি রুপলি মোড়ক।   ২০১৪ সালের মত ১৯৯০ সালে সালে যদি কোনও সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লির মসনদে বসত তাহলে ভারতের দিকেই নজর থাকত পশ্চিমের দেশগুলির। সেই সময় চিনে একজন মাত্র শাসকের হাতেই ছিল শাসনভার। ২০২০ সালের মধ্যে চিন প্রায় ৭০টি কৌশলগত অংশীদারিত্ব গুটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে মনমোহন সিং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করতে নিয়ে নাজেহাল হয়ে যায়। সোনিয়ার সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যায়।  ভারতের সরকারও টালমাটাল হয়ে পড়ে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মর্নিং কনসাল্টের মাসিক সমীক্ষা অনুসারে ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত বিশ্ব নেতৃত্বের অনুমংোজনের বেটিংয়ে আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ১৩ জন নেতার মধ্যে মোদী শীর্ষস্থানে রয়েছে। দীর্ঘদিন অন্যদেক নেতৃত্বে ভারত এখন বহুপাক্ষিক ফোরামে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। সর্বেশেষ G7 plus, G 20 , cop 26 কনক্লেভেরও ভারত প্রধানের ভমিকা পালন করেছে। বিশ্ব বর্তমানে ভারতের দিতে ঝুঁকছে যেমনটা ১৯৯০ সালে ঝুঁকেছিল। বেশ কয়েকটি সমীক্ষাও বর্তমানে জানিয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির বর্তমানে চিন থেকে ভারতের দিকে সরে যাচ্ছে। 

পরিকল্পনা ও বিকাশ
জনগণের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন মোদী ও দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারন করেছে। যা ভারতের আগে কল্পনা করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মোদী ২০১৪ সাল থেকে ৭ বছর ৪৩,৮১ কোটি দরিদ্রদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পেরেছেন। ১১.৫ কোটি সরকারি ও বেসরকার শৌচাগার স্থাপন করেছেন। ৬ লক্ষেরও বেশি গ্রামে শৌচাগার তৈরি হয়েছে। যেখানে মানুষ খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করে না। দেশে ২.৩৩ লক্ষ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হয়েছে। দরিদ্রদের জন্য ২ কোটিরও বেশি ঘর তৈরি হয়েছে। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও বিদ্যুয়াতনের কাজ শুরু হয়েছে । বিনামূল্য দেওয়া হচ্ছে রান্নার গ্যাস। ২৫ কোটিরও বেশি মানুষের জন্য চিকিৎসা বিমা করা হয়েছে। শস্য বিমার পাশাপাশি কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে  টাকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। দেওয়া হয়েছে আধার ও বায়োমেট্রিক পরিচয় পত্র। প্রধানমন্ত্রী মোদী যে দ্রুত গতিতে পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত করেছেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৬৪ বছরে যা রাস্তা তৈরি হয়েছিল  মোদী ক্ষমতার আসার সাত বছর পরে তার ৫০ শতাংশ বেড়েছে। 

প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলিকে কার্যকর করার জন্য নেটবন্দিকরণ, জিএসটি, দেউলয়া আইন, পিএসইউগুলির বেসরকারিকরণের মত অর্থনৈতিক প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। যার জন্য তাঁকে একাধিকবার সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে হয়েছে। কিন্তু তাঁর উদ্যোগে একাধিক রাজ্যে দেখা গেছে পিছিয়ে পড়া মানুষে হাতে আর্থিক সাহায্য পৌঁছেছে দ্রুত গতিতে। 

ফোর্বস ভুল করছে
ভারতীয় অর্থনীতিতে ডিটক্সিফাই  করার সঙ্গে উন্নয়ন পরিকল্পনা একীভূত করা মোদী সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। একটি ছাড়া অন্যটি সম্ভব নয়। সাহসী নেতৃত্ব ছাড়া ওই উন্নয়ন সম্ভব নয়। ফোর্বস গণতন্ত্রকে দোষ দিয়ে ভুল করেছে। রাজবংশের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের পতনের ফলে ভারতীয় গণতন্ত্র যে সংকটে পড়েছিল তা থেকে টেনে তোলেন মোদী। ভারত যেভাবে কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে তা রীতিমত গুরুত্বপূর্ণ। 

কোভিড চ্যালেঞ্জ
২০১৯ সালে নির্বাচনে জেতার কয়ের মাসের মোদীর সামনে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মহামারি মোকাবিলা। এটি মোকাবিলার জন্য ভারতে কোনও রোল মডেল ছিল না। একাধিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছিল। ব্যার্থ হয়েছে। হাতে কলমে কাজ করেছেন। কোভিড মহামারি আর্থিক বিপর্যয়ও সঙ্গে করে এনেছে। এই অবস্থায় ভারতে সমস্যায় ফেলতে চিন সীমান্ত এলাকায় আগ্রাসন শুরু করেছে। গ্যালওয়ানে রক্তপাতও হয়েছে। ভিরতে বাইরে সহদিকেই ভারত বড় সমস্যার মুখে পড়েছিল। সমস্যা বাড়িয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও। প্রতিনিয়ত বিরোধিতা করে গেছে। 

এটাই গুরুত্বপূর্ণ যে ভারত যদি বিদেশের তৈরি করোনা টিকার জন্য অপেক্ষা করত তাহলে এতদিনে দেউলিয়া হয়ে যেত। বিদেশ থেকে ভারতে টিকা আসতেও দীর্ঘদিন সময় লাগত। বিচক্ষণ মোদী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির কথায় গুরুত্ব না দিয়ে দেশে তৈরি টিকার ওপর প্রথম থেকেই ভারসা রেখেছিলেন। বর্তমানে ভারত বৃহত্তম কোভিড টিকা উৎপাদক দেশ। 

এখানেই ২০১৪ সালের পরবর্তী ভারতের সঙ্গে তার আগের ভারতের পার্থক্য। আগে কিছু প্রক্সি প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করত ভারত। শক্ত, বলিষ্ট কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। কোভিড ও চিনা আগ্রাসন ভারতের সমস্যা আরও বাড়াত। এখানেই ১৯৮৯-২০১৪ সালের ভারতের পার্থক্য। 


(লেখকঃ এস গুরুমূর্তি, সম্পাদক ঠগলোক ও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এই প্রতিবেদনের লেখা লেখকের ব্য়ক্তিগত মতামত, এর সঙ্গে এশিয়ানেট নিউজ বাংলার কোনও যোগ নেই।  লেখাটি নিউ ইন্ডিয়ান এক্সেপ্রেসে প্রথম ছাপা হয়)