সংক্ষিপ্ত

ইন্দিরা গান্ধীর রক্তের গ্রুপ ছিল 'ও নেগেটিভ'। ওই গ্রুপের রক্ত মজুত ছিল হাসপাতালে।তাই বেশি দৌঁড়ঝাপের প্রয়োজন হল না। ৮০ বোতল রক্ত দেওয়া হল ইন্দিরা গান্ধীকে। শরীরে যে পরিমাণ রক্ত থাকে, সেটা ছিল তার প্রায় ৫ গুণ। চিকিৎসকরা 'হার্ট এন্ড লাং মেশিন' লাগালেন ইন্দিরার শরীরে। ধীরে ধীরে তার শরীরে রক্তের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি থেকে কমে ৩১ ডিগ্রি হয়ে গেল।

১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। ব্যক্তিগত দুই দেহ রক্ষীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় ইন্দিরা গান্ধীর দেহ। গোয়েন্দা এজেন্সিগুলো আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে মিসেস গান্ধীর ওপরে এরকম একটা হামলা হতে পারে তাও ইন্দিরা কোনো পদক্ষেপ নেন নি। অপারেশন ব্লুস্টারের পর প্রধানমন্ত্রীর আবাস থেকে সব শিখ নিরাপত্তা-কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলে ইন্দিরা ভীষণ রেগে গিয়ে বলেছিলেন,  Are not we secular?  আমরা না ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাস করি? ওড়িশায় জীবনের শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। আর সেই ভাষণেও তিনি আভাষ দিয়েছিলেন নিজের মৃত্যুর। ইন্দিরা গান্ধীর সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের বিশ্লেষণ করলেন অনিরুদ্ধ সরকার। 

১৯৮৪ সালের জুন মাস। অপারেশন ব্লু স্টারে নিহত হয়েছিলেন ৮৩ জন ভারতীয় সৈনিক। এই অপারেশনে ২৪৮ জনের গুলি লেগেছিল। ৪৯২ জন বিচ্ছিন্নতাবাদী মারা গেছিলেন এই ঘটনায়। দেড় হাজারেরও বেশি লোক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।অপারেশন ব্লু স্টারের ফলে শুধু ভারতের নয়, সারা বিশ্বের শিখ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছিল।

এর ঠিক তিন মাস পরের ঘটনা। ১৯৮৪ -র অক্টোবর। নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ হারালেন ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। অনেক ইন্দিরা গবেষক বলেছেন মিসেস গান্ধী নিজের মৃত্যুর বিষয়ে জানতেন। তাঁর কাছে ইনটালিজেন্স ব্যূরোর খবরও ছিল কিন্তু তিনি কোনও পদক্ষেপ নেন নি! 

ইন্দিরা গান্ধীর জীবনীকার ইন্দর মালহোত্রা তাঁর লেখায় লিখছেন, "গোয়েন্দা এজেন্সিগুলো আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে মিসেস গান্ধীর ওপরে এরকম একটা হামলা হতে পারে।
তারা সুপারিশ পাঠিয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রীর আবাস থেকে সব শিখ নিরাপত্তা-কর্মীদের যেন সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু সেই ফাইল যখন ইন্দিরা গান্ধীর টেবিলে পৌঁছায়, তখন ভীষণ রেগে গিয়ে তিনি বলেছিলেন,  Are not we secular?  আমরা না ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাস করি?"

চলে আসি সেই দিনটির কথায়। কি ঘটেছিল ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। সেদিন ইন্দিরা সকালে উঠে রাহুল, প্রিয়াঙ্কাদের আদর করে চুম্বন করলেন।তারপর তারা স্কুলে গেলে তাদের গাড়িতে তুলে দিয়ে এলেন। 
সকাল ৭ টা ৩০।  তৈরি হয়ে নিচে নামলেন মিসেস গান্ধী। দিনের প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল পিটার উস্তিনভের সঙ্গে। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ওপরে একটা তথ্যচিত্র বানাচ্ছিলেন। আগের দিন ইন্দিরা গান্ধীর ওড়িশা সফরের সময়েও তিনি শুটিং করেছিলেন।

দুপুরে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালিঘান আর মিজোরামের এক নেতার সঙ্গে। আর সন্ধেবেলায় ব্রিটেনের রাজকুমারী অ্যানের সম্মানে একটা ডিনার দেওয়ার কথা ছিল মিসেস গান্ধীর। ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে দুটি পাউরুটি টোস্ট, কিছুটা সিরিয়াল,  মুসাম্বির জুস আর ডিম খেলেন তিনি। ব্রেকফাস্টের কিছুক্ষণের মধ্যেই এলেন মেকআপ ম্যান। তিনি মিসেস গান্ধীর মুখে সামান্য একটু পাউডার আর ব্লাশার লাগিয়ে দিলেন। সেই সময় হাজির হলেন ইন্দিরার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাক্তার কে পি মাথুর। রোজ ঠিক ওই সময়েই মিসেস গান্ধীকে পরীক্ষা করতে আসতেন তিনি। ইন্দিরা ডাক্তার মাথুরকে ভেতরে ডেকে নিলেন। ডাক্তার মাথুর ভেতরে ঢুকে দেখলেন মিসেস গান্ধী মেকআপে বসেছেন। ইন্দিরা ডাক্তার মাথুরকে ইশারায় বসতে বললেন ও মজা করে বললেন, জানেন তো আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগান  অতিরিক্ত মেকআপ করেন। আর সেকারণে ৮০ বছর বয়সেও তার মাথার বেশির ভাগ চুলই কালো দেখায়। শুনে হেসে ফেললেন ডাক্তার মাথুর। ঘড়িতে তখন ৯ টা বেজে ১০ মিনিট।

ইন্দিরা গান্ধী বাইরে বের হলেন। বেশ রোদ একটা ঝলমলে দিন। রোদ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করতে সেপাই নারায়ণ সিং একটি কালো ছাতা নিয়ে পাশে পাশে হাঁটছেন। ইন্দিরার কয়েক পা পেছনে রয়েছেন ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান। আর তার পেছনে ব্যক্তিগত পরিচারক নাথুরাম। আর সবার পেছনে আসছিলেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার, সাব ইন্সপেক্টর রামেশ্বর দয়াল।

ঠিক সেই সময়েই তাঁদের সামনে দিয়ে এক কর্মচারী হাতে একটা চায়ের সেট নিয়ে পেরিয়ে গেলেন। ওই চা তথ্যচিত্র নির্মাতা পিটার উস্তিনভকে পরিবেশন করা হয়েছিল। ওই কর্মচারীকে ইন্দিরা ডেকে বললেন, মিস্টার উস্তিনভের জন্য যেন অন্য আরেকটা চায়ের সেট বের করা হয়।  ইন্দিরার বাসভবনের লাগোয়া দপ্তরটি ছিল আকবর রোডে। দুটি ভবনের মধ্যে যাতায়াতের জন্য একটি সংযোগকারী রাস্তা ছিল। সেই গেটের সামনে পৌঁছে ইন্দিরা গান্ধী তার সচিব আর কে ধাওয়ানের সঙ্গে কথা বলছিলেন। মিঃ ধাওয়ান ইন্দিরাকে বলছিলেন রাষ্ট্রপতি গিয়ানী জৈল সিংয়ের কথা। মিঃ ধাওয়ান ইন্দিরাকে বললেন, " ম্যাডাম প্রাইমমিনিস্টার। আপনার নির্দেশমতো  ইয়েমেন সফররত রাষ্ট্রপতি গিয়ানী জৈল সিংকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে তিনি সন্ধ্যে ৭টার মধ্যে দিল্লি ফিরে আসেন। পালাম বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতিকে রিসিভ করে সময়মতো যাতে রাজকুমারী অ্যানের ভোজসভায় পৌঁছাতে পারেন আপনি সেইমত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।"

ঠিক সেই মুহুর্তে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মী বিয়ন্ত সিং রিভলবার বের করে ইন্দিরা গান্ধীর দিকে তাক করে গুলি চালালো। প্রথম গুলিটা লাগলো ইন্দিরা গান্ধীর পেটে।  ইন্দিরা গান্ধী ডান হাতটা ওপরে তুললেন গুলি থেকে বাঁচতে। তখন একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে বিয়ন্ত সিং আরও দুবার গুলি চালালো। যে দুটো গুলির একটা লাগলো ইন্দিরার বুকে আর একটা লাগলো ইন্দিরার কোমরে। লুটিয়ে পড়লেন ইন্দিরা। 

ওই জায়গা থেকে ঠিক পাঁচ ফুট দূরত্বে নিজের টমসন অটোমেটিক কার্বাইন মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সতবন্ত সিং। ইন্দিরাকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সতবন্ত কিছুটা ঘাবড়ে যায়। সে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে ইন্দিরার দিকে। বিয়ন্ত তখন চিৎকার করে সতবন্তকে বলতে থাকে 'গুলি চালাও...গুলি চালাও'।' সতবন্তের হুঁশ ফিরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের কার্বাইন থেকে চেম্বারে থাকা ২৫টা গুলিই ইন্দিরা গান্ধীর শরীরে গেঁথে দেয়। 

বিয়ন্ত সিং প্রথম গুলিটা চালানোর প্রায় ২৫ সেকেন্ড কেটে যায়। প্রধানমন্ত্রী বাসভবনের নিরাপত্তারক্ষীরা সবাই স্তম্ভিত। সতবন্ত সিংকে গুলি চালাতে দেখে নিরাপত্তা অফিসার রামেশ্বর দয়াল দৌড়ে আসেন। সতবন্ত তখন একনাগাড়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। মিঃ দয়ালের উরু আর পায়ে গুলি লাগলো। সেখানেই পড়ে গেলেন তিনি।
ইন্দিরা গান্ধীর আশপাশে থাকা অন্য কর্মচারীরা ততক্ষণে একে অন্যকে চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছেন। ওদিকে ১ নম্বর আকবর রোডের ভবন থেকে পুলিশ অফিসার দিনেশ কুমার ভাট এগিয়ে এলেন শোরগোল শুনে।

বিয়ন্ত সিং আর সতবন্ত সিং নিজেদের অস্ত্র ততক্ষণে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। অস্ত্র ফেলে বিয়ন্ত সিং  বলল, "আমাদের যা করার ছিল, সেটা করেছি। এবার তোমাদের যা করার করো।" ইন্দিরার কর্মচারী নারায়ণ সিং ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছেন। এসেই বিয়ন্ত সিংকে ধরে মাটিতে ফেলে দিলেন। পাশের গার্ডরুম থেকে ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে আইটিবিপি, ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের কয়েকজন জওয়ান। তারা সবাই মিলে সতবন্ত সিংকে ঘিরে ফেলল। 

সবসময়ে ইন্দিরার বাসভবনে একটি অ্যাম্বুলেন্স রাখা থাকত। ঘটনাচক্রে সেদিন সেই অ্যাম্বুলেন্সের চালক কাজে আসেন নি।ফলে একটু দেরি হল।  ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মাখনলাল ফোতেদার চিৎকার করে গাড়ি বের করতে নির্দেশ দিলেন। মাটিতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত  ইন্দিরাকে ধরাধরি করে সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়ির পেছনের আসনে তুললেন আরকে ধাওয়ান আর নিরাপত্তা কর্মী দিনেশ ভাট। ড্রাইভারের পাশে সামনের আসনে চেপে বসলেন মিস্টার ধাওয়ান আর মিস্টার ফোতেদার।রক্তাক্ত ইন্দিরা পেছনের সিটে।

গাড়ি যেই চলতে শুরু করেছে তখন সোনিয়া গান্ধী খালি পায়ে, ড্রেসিং গাউন পরে 'মাম্মি, মাম্মি' বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে ওই অবস্থায় দেখে সোনিয়া গান্ধী চমকে গেলেন ও গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসলেন। রক্তে তখন ভেসে যাচ্ছে ইন্দিরার দেহ। সোনিয়া গান্ধী ইন্দিরার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলেন। 

গাড়ি চলতে শুরু করল 'এইমস' বা অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট ফর মেডিক্যাল সায়েন্সের দিকে। ৪ কিলোমিটার রাস্তা কয়েক মিনিটের মধ্যে অতিক্রম করে গাড়ি এইমস ঢুকল ৯টা ৩২ মিনিটে। সোনিয়া গান্ধীর ড্রেসিং গাউন ততক্ষণে ইন্দিরা গান্ধীর রক্তে পুরো ভিজে গেছে। সফদরজং রোডের বাসভবন থেকে কেউ ফোন করে হাসপাতালে খবর দেয় নি যে ইন্দিরা গান্ধীকে গুরুতর আহত অবস্থায় এইমস-এ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলে হাসপাতালে কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। সবটাই ঘটে আকস্মিক।  জরুরী বিভাগের দরজা খুলে গাড়ি থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে নামাতে সময় লাগলো মিনিট তিনেক। কিন্তু হাসপাতালে তখন কোনো স্ট্রেচার নেই। কোনওরকমে একটা স্ট্রেচার যোগাড় করে আনলেন দুজন। গাড়ি থেকে ইন্দিরাকে নামানোর সময়ে তাঁর ওই অবস্থা দেখে সেখানে হাজির ডাক্তাররা ঘাবড়ে গেলেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ইন্দিরার শরীর।

ফোন করে সিনিয়র কার্ডিয়োলজিস্টদের খবর দেওয়া হল হাসপাতাল থেকে । কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার গুলেরিয়া, ডাক্তার এম এম কাপুর আর ডাক্তার এস বালারাম এসে হাজির হলেন। ডাক্তার ইসিজি করলেন ও বললেন, "পালস পাওয়া যাচ্ছে না।" ইন্দিরার চোখ তখন স্থির হয়ে গেছে। ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, "মস্তিষ্কে আঘাত লেগেছে, চান্স কম।" 

মিসেস গান্ধীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হল। চিকিৎসকেরা দেখলেন যে যকৃতের ডানদিকের অংশটা গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বৃহদান্ত্রের বাইরের অংশটা ফুটো হয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্রান্ত্রেরও। ফুসফুসের একদিকে গুলি লেগেছে আর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গেছে গুলির আঘাতে। তবে হৃৎপিণ্ডের কোনও ক্ষতি হয় নি। একজন চিকিৎসক ইন্দিরার মুখের ভেতর দিয়ে একটা নল ঢুকিয়ে দিলেন যাতে ফুসফুস পর্যন্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে। মস্তিষ্কটা চালু রাখা বেশি প্রয়োজন বলে মনে করলেন তাঁরা।

ইন্দিরা গান্ধীর রক্তের গ্রুপ ছিল 'ও নেগেটিভ'। ওই গ্রুপের রক্ত মজুত ছিল হাসপাতালে।তাই বেশি দৌঁড়ঝাপের প্রয়োজন হল না। ৮০ বোতল রক্ত দেওয়া হল ইন্দিরা গান্ধীকে। শরীরে যে পরিমাণ রক্ত থাকে, সেটা ছিল তার প্রায় ৫ গুণ। চিকিৎসকরা 'হার্ট এন্ড লাং মেশিন' লাগালেন ইন্দিরার শরীরে। ধীরে ধীরে তার শরীরে রক্তের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি থেকে কমে ৩১ ডিগ্রি হয়ে গেল। 
"

তিনি যে আর নেই, সেটা সকলেই বুঝতে পারছিলেন, কিন্তু তবুও 'এইমস'এর আটতলার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইন্দিরাকে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী শঙ্করানন্দ তখন হাসপাতালে উপস্থিত। ডাক্তার গুলেরিয়া এসে তাঁকে বললেন, "আমি তো দেখেই বুঝে গেছিলাম যে উনি আর নেই। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইসিজি করতে হল।" স্বাস্থ্যমন্ত্রী শঙ্করানন্দকে ডাক্তার গুলেরিয়া জিজ্ঞেস  করলেন, " এখন কী করণীয়? ঘোষণা করে দেব যে উনি মৃত?" শঙ্করানন্দ ঘাড় নেড়ে মৃদু স্বরে বললেন "না, এখন না।" দেহরক্ষীদের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হওয়ার প্রায় ৪ ঘণ্টা পর, দুপুর ২ টো ২৩ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত ঘোষণা করা হল। কিন্তু সরকারি প্রচারমাধ্যমে সেই খবর ঘোষণা করা হল সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ।

সব কাহিনির যেমন একটা শেষ থাকে তেমনি একটা শুরুও থাকে। ইন্দিরার মৃত্যুর নেপথ্যে যে একমাত্র অপারেশন ব্লুস্টার দায়ি ছিল এমনটা নয়। ইন্দিরা গান্ধীর জীবনী লেখক এবং ইন্দিরা গবেষকরা অন্তত তেমনটাই দাবি করছেন। কারো কারো মতে ইন্দিরার মৃত্যু বীজ রোপিত হয়েছিল ওড়িশা থেকেই। সেখানেই তিনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন মৃত্যু আসন্ন। ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বর শহরের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতি সেই পিতা জওহরলালের সময় থেকেই।  এই শহরেই পিতা জওহরলাল নেহরু প্রথমবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তারপরেই ১৯৬৪ সালের মে মাসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনী প্রচারে এই শহরেই ইন্দিরা গান্ধীর দিকে পাথর ছোঁড়া হয়েছিল, যাতে তার নাক ফেটে যায়। আর সেই ভুবনেশ্বর শহরেই ১৯৮৪ সালের ৩০ অক্টোবর জীবনের শেষ ভাষণ দেন ইন্দিরা গান্ধী। সেই ভাষণেই তিনি আভাষ দিয়েছিলেন নিজের মৃত্যুর।   আসুন জেনে নিই সেদিন তিনি ঠিক কি বলেছিলেন।  

প্রতিটা ভাষণের মতোই ইন্দিরার সেই ভাষণ লিখে দিয়েছিলেন মিসেস গান্ধীর মিডিয়া উপদেষ্টা এইচওয়াই শারদা প্রসাদ। কিন্তু ভাষণ দিতে দিতে হঠাৎই শারদা প্রসাদের লেখা বয়ান থেকে সরে গিয়ে নিজের মতো বলতে শুরু করেন ইন্দিরা। তার বলার ধরনও পাল্টে গেছিল সেদিন। তিনি বললেন, "আমি আজ এখানে রয়েছি। কাল নাও থাকতে পারি। এটা নিয়ে ভাবি না যে আমি থাকলাম কী না। অনেকদিন বেঁচেছি। আর আমার গর্ব আছে যে আমি পুরো জীবনটাই দেশের মানুষের সেবায় কাজে লাগাতে পেরেছি বলে। আর শেষ নিশ্বাস নেওয়া পর্যন্ত আমি সেটাই করে যাব। আর যেদিন মারা যাব, সেদিনও আমার রক্তের প্রতিটা ফোঁটা ভারতকে আরও মজবুত করার কাজে লাগাবো।" কখনও কখনও বোধহয় শব্দই 'নিয়তি'র একটা ইশারা দিয়ে দেয়। ভাষণের শেষে মিসেস গান্ধী যখন রাজ্যপালের সঙ্গে রাজভবনে ফিরেছেন, তখন রাজ্যপাল বিশ্বম্ভরনাথ পান্ডে ইন্দিরাকে বলেছিলেন,  "একটা রক্তাক্ত মৃত্যুর কথা বলে আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।" জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, "আমি যা বলেছি, তা নিজের মনের কথা। আমি এটাই বিশ্বাস করি।" ঠিক এর একটা দিন পর ৩১ অক্টোবর। দেহরক্ষীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল ইন্দিরার দেহ।  .....মহাত্মা গান্ধীর পর দ্বিতীয়বার, হত্যা হল ভারতের গণতন্ত্রের। 

তথ্যঋণ :
 ১|| Indira Gandhi: A Personal and Political Biography - Inder Malhotra 

২|| Indira Gandhi: A Biography- Pupul Jaykar

৩|| India Gandhi: Tryst With Power-  Nayantara Sehgal

৪|| The Red Sari - Javier Moro

৫|| Indira: Life of Indira Nehru Gandhi - Katherine Frank

৬|| Mrs Gandhi-  Dom Moraes

৭|| Indira Gandhi assassination - Mrs. Z.Y. Himsagar and S. Padmavathi 

৮|| BBC News. 31 October 1984. 

YouTube video player