সংক্ষিপ্ত

দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের পর কৃষি আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকার। শুক্রবার এ কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গত প্রায় এক বছর ধরে ওই আইন নিয়ে আন্দোলন করছিলেন কৃষকরা। জানুন ঠিক কী হয়েছিল এই এক বছরে?
 

ধর্মগুরু গুরু নানকের জন্মজয়ন্তীতে (Guru Nanak Jayanti) বিরাট সিদ্ধান্ত মোদি সরকারের। প্রায় এক বছরের কৃষক আন্দোলনের পর সিদ্ধন্ত বদল করল কেন্দ্রীয় সরকার (Central Got)। তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Narendra Modi)। বিতর্কিত এই তিনটি কৃষি আইন প্রকাশ্যে আসার পর থেকে দেশ জুড়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রের কৃষি আইনের (Farm Bills) বিরোধিতা করে দেশ জুড়ে কৃষকরা বিক্ষোভে সামিল হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরও তাদের এই আন্দোলন জারি রেখেছেন কৃষকরা (Farmers)।

বিধানসভা নির্বাচন 2022: চলতি বছরের প্রায় শেষ কিনারায় এসে পৌঁছেছে সকলে এবং ২০২২-এ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। এরই মাঝে হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা জানালেন প্রধানমন্ত্রী।  এদিন জাতীর উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (PM Narendra Modi) ক্ষমা চেয়ে বলেন, 'হয়ত আমাদেরও কিছু ত্রুটি ছিল। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল। আমাদের দুঃখ যে কৃষি আইনের সুফলের কথা কিছু কৃষককে আমরা বোঝাতে পারিনি। তবে এখন সময়টা কাউকে দোষারোপ করার নয়। আসুন, সব আবার নতুন করে শুরু করা যাক।'

সেপ্টেম্বর ২০২০: সেই সময় তিনটি কৃষি বিলে (Farm Bills) সংশোধন করে আইনে পরিণত হওয়ার পর থেকেই আন্দোলনে সামিল হয় দেশের কৃষক মহল। দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্তানে বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু করেন কৃষকরা (Farmers)। পাঞ্জাবে এই আন্দোলন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। রাস্তা অবরোধ, রেল রোকো-আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষি আইনের (Farm Bills) বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিবাদ জানাতে থাকে কৃষক সংগঠনগুলি। তাদের দাবি ছিল নতুন এই আইনের ফলে তীব্র ক্ষতির মুখে পড়বেন তারা। 

নভেম্বর ২০২০: সময় যতই এগোতে থাকে আন্দোলনের রূপ ততই ভয়াবহ হতে শুরু করে। কয়েকটি রাজ্যে কৃষক মনে অসন্তোষ ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করতে শুরু করে। এমন কি নতুন কৃষি আইন (Farmer's Bills)বাতিলের দাবিতে কৃষক আন্দোলন ঘিরে চরম উত্তেজনার মধ্যেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিন কৃষক। আন্দোলনকারী ওই কৃষকরা নিজেদের গায়ে আগুন লাগানোর চেষ্টা করলে নিরাপত্তারক্ষীরা  এগিয়ে এসে বাঁধা দেন এবং তিন কৃষককে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত করেন। 

ডিসেম্বর ২০২০: ৩ ডিসেম্বর প্রথমবার মুখোমুখি বৈঠকে বসে কৃষক পক্ষ এবং কেন্দ্রীয় সরকার। দু’দিন পরই হয় দ্বিতীয় বৈঠক। তবু সঠিক মীমাংসা মেলে না। ৮ ডিসেম্বর ভারত বন্ধের ডাক দিলেন কৃষকরা (Farmers)। এরপর ১১ ডিসেম্বর তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হল ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন। অবশেষে ৩০ ডিসেম্বর কিছুটা নরম হয় কেন্দ্র। ফসলের নষ্ট অংশ পোড়ানোর অভিযোগে কৃষকদের জরিমানা করা হবে না বলে জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার।

আরও পড়ুন- Farm Laws-কৃষি আইন বাতিল করবে কেন্দ্র, বড় ঘোষণা নরেন্দ্র মোদীর

জানুয়ারি ২০২১: এই তিনটি আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) করা এক মামলার শুনানিতে দেশের প্রধান বিচারপতি এস এ বোবডে কেন্দ্রীয় সরকারকে (Central Govt) একপ্রকার হুঁশিয়ারির সুরে জানান, 'আপনারা এই স্থগিত করবেন কি না জানান না হলে আমরা তা করতে বাধ্য হব।' পাশাপাশি কেন্দ্রের পক্ষ থেকে কৃষক আন্দোলনের নিষ্পত্তি করার জন্য আরও সময় চাওয়া হলে উত্তরে বিচারপতি বোবডে সরাসরি জানান, 'আমাদের আদৌ মনে হচ্ছে না সরকার ঠিকমতো বিষয়টা সামলাতে পারছে। এখন কৃষক আন্দোলনকে ঘিরে যদি রক্ত ক্ষরণ ঘটে তাহলে আপনারা কি তার দায় নিতে প্রস্তুত?'

ফেব্রুয়ারি ২০২১: রাজস্থানে কৃষি আন্দোলন যে কেবল ভয়াবহ আকার ধারণ করে তাই নয়, কৃষক মহাপঞ্চায়েত থেকে বড়সড় আন্দোলনের হুমকি দেন ভারতীয় কিসান ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েত। ৩ কৃষি আইন বাতিল ও নূন্যতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত না করলে, ৪০ লক্ষ ট্র্যাক্টর নিয়ে সংসদ ভবন ঘেরাও করার হুঁশিয়ারি দেন তিনি। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের এই কর্মসূচির জন্য প্রস্তুত ও থাকতে নির্দেশ দেন রাকেশ টিকায়েত (Rakesh Tikait)। 

মার্চ ২০২১: কৃষকদের দাবি কোনও ভাবে মানা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন কেন্দ্রীয় সরকার।  এরপর তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন কৃষকরা (Farmers)। ২৬ মার্চ ভারত বনধের ডাক দেন সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। এখানেই শেষ নয়, এর পাশাপাশি ২৮ মার্চ হোলিকা দহন পালনের মাঝে নতুন কৃষি আইনের প্রতিলিপি পুড়িয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত ও নেন আন্দোলনকারী কৃষকরা। 

মে ২০২১: মে মাসে ও হল না রফা। কেন্দ্র এবং কৃষকদের এই টানাপোড়েন থাকলো জারি। এরপর মে মাসের শেষার্ধে ২৭ মে কৃষকদের বিক্ষোভের ৬ মাস পূর্ণ হওয়ায় কালা দিবস পালন করলেন কৃষকরা (Farmers)। ২০২৪ পর্যন্ত আন্দোলন চালানোর হুঁশিয়ারি দিলেন বিক্ষোভকারীরা কৃষকরা। 

জুন ২০২১: ৫ই জুন দেশ জুড়ে পালিত হয় 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস (World Environment Day)। চলতি বছরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় পরিবেশ দিবস পালিত হয় একেবারে ভিন্ন রূপে। কৃষি আইন-২০২০ বাতিলের দাবিতে অল ইন্ডিয়া কিসান মজদুর সংগঠন দেশজুড়ে কৃষি বাঁচাও কর্পোরেট হটাও দিবস পালন করে। যার  থেকে বাদ পরে নি এ রাজ্য ও। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকাইত (Rakesh Tikait)। কৃষক নেতাদের সঙ্গে নিয়েই বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে নামেন তৃণমূল সুপ্রিমো। বাংলায় বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি বিরোধী প্রচার করতে এ রাজ্যে এসেছিলেন কৃষক নেতারা। আগামী দিনেও বিভিন্ন রাজ্যে এই প্রচার চালানো হবে বলে জানান রাকেশ টিকায়েত (Rakesh Tikait)। 

আগস্ট ২০২১: আগষ্টে কৃষক আন্দোলন (Farmer's Protest) কিছুটা শাক্তিশালী রূপ পেল।  কারণ ৭ আগস্ট কিশান সংসদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের ১৪টি বিরোধী দলের নেতা। তবে এর পরে ও নিজেদের সিদ্ধান্ত বদল করেন নি কেন্দ্রীয় সরকার। এবার ২৮ আগস্ট হরিয়ানার কার্নালে কৃষকদের উপরে লাঠিচার্জ করে পুলিশ।

অক্টোবর ২০২১: অক্টোবরে কৃষক আন্দোলন একেবারে অন্য চেহারা নেয়। ৩ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের লখিমপুরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলে আশিস মিশ্রর (Asish Mishra) দ্রুতগামী গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় চার কৃষকের। ঘটনায় মৃত্যু হয় আর ও চারজনের। ১০ অক্টোবর অভিযুক্ত আশিসের ১৪ দিনের বিচার বিভাগীয় হেফাজতের নির্দেশ মেলে। 

নভেম্বর ২০২১: অবশেষে আন্দোলনের একপ্রকার সদর্থক জবাব পায় কৃষকরা। ১৯ শে নভেম্বর যেই কৃষি আইনকে ঘিরে এতো বিতর্ক সি কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানান, সংসদের আসন্ন অধিবেশনেই এই তিনটি বিতর্কিত আইন (Farm Laws) প্রত্যাহারের আইনি প্রক্রিয়া শুরু হবে।

আরও পড়ুন- Farmer Law Repealed-সংসদে কৃষি আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবাদ চলবে, বার্তা কৃষকদের

ঠিক কী বলা ছিল এই বিতর্কিত কৃষি আইনে?

* ফারমার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট- ২০২০: এই আইন অনুসারে, বেসরকারি সংস্থা বা কোনও বড় ব্যবসায়ী চাইলে সরাসরি চাষির কাছ থেকে কৃষিজ পণ্য কিনতে পারেন যার পিছনে সরকারের যুক্তি (Govt's Logic) ছিল এতে কৃষকরা বাজারের সর্বোচ্চ মূল্য পাবেন, অন্যদিকে কৃষকদের দাবি (Farmer's logic) ছিল এতে আদতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়িক সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

* ফারমার্স এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাসিওরান্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস ((এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন) অ্যাক্ট- ২০২০: এই আইন অনুসারে, বেসরকারি সংস্থা চাইলে কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে সেখানে কৃষজ পণ্য ফ্লাটে পারবেন যার পিছনে সরকারের যুক্তি (Govt's Logic) ছিল এর ফলে দেশীয় কৃষিজ পণ্যের চাহিদা বাড়বে, অন্যদিকে কৃষকদের দাবি (Farmer's logic) ছিল এর ফলে তাঁদের জমির উপর থেকে তাঁদের অধিকার হারাবে। 

* এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (সংশোধিত) বা অত্যাবশ্যক পণ্য আইন: এই আইন অনুসারে, চাল, ডাল, গম ইত্যাদি অত্যাবশকীয় পণ্য সামগ্রী মজুতের ঊর্ধ্বসীমা বলে কিছু থাকবে না যার পিছনে সরকারের যুক্তি (Govt's Logic)  ছিল যে এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, অন্যদিকে কৃষকদের দাবি (Farmer's logic) ছিল এর ফলে অত্যাবশকীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চলে যাবে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে। 

যদিও এর পিছনে রাজনৈতিক সমীকরণ দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। বাইশের নির্বাচনের আগেই এহেন সিদ্ধান্ত নির্বাচনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। তারপরেই ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের (Indian Farmer's Union) নেতা রাকেশ টিকাইত (Rakesh Tikait) জানিয়েছেন যে, 'আন্দোলন এখনই থামবে না। সংসদে কৃষি আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।'

আরও পড়ুন- Farm Law:'এটা তোমাদেরই জয়', কৃষি আইন বাতিলের পর কৃষকদের শুভেচ্ছা, BJP-কে তোপ মমতার

 

YouTube video player