সংক্ষিপ্ত
২০২০ সালেই শুরু হলেও ২০২১ সাল জুড়ে নানান উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার (SKM) কৃষি আন্দোলন (Farmers' Protest)। কীভাবে শেষ পর্যন্ত জয় পেলেন কৃষকরা, ফিরে দেখা যাক।
২০২০ সালের জুনে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর (PM Narendra Modi) নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তিনটি নতুন কৃষি আইন (Farm Laws 2020) অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছিল। পরে সেপ্টেম্বরে তা আইনে পরিণত হয়েছিল। অধ্যাদেশটি পাশ করার পর থেকেই প্রথম পাঞ্জাবে কৃষকদের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের বা বিকেইউ (BKU) নেতৃত্বে। নভেম্বরে আন্দোলন দিল্লিতে পৌঁছে গিয়েছিল, ৩৬টি কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা বা এসকেএম (SKM)। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের অন্যান্য রাজ্যেও। ২০২০-র ডিসেম্বর থেকেই কেন্দ্র কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে বাধ্য হয়েছিল। এরপর, ২০২১ সাল জুড়ে নানান উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গিয়ে অবশেষে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে এই আন্দোলন।
২০২১-এর শুরু থেকেই ভারতের কৃষক আন্দোলন দিল্লির (Delhi) সীমানা থেকে গোটা বিশ্বে খবর তৈরি করেছিল। নরেন্দ্র মোদী সরকার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গয়াল (Piyush Goyal), নরেন্দ্র সিং তোমর (Narendra Singh Tomar) এবং সোম প্রকাশের (Som Prakash) সমন্বয়ে এক তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে কৃষকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু করে। কৃষকদের পক্ষ থেকে আলোচনায় যোগ দেন রাকেশ টিকাইত (Rakesh Tikait), হান্নান মোল্লা (Hannan Molla), যোগেশ যাদব (Yogendra Yadav) প্রমুখ কৃষক নেতারা। ১১ রাউন্ডের আলোচনায় মোদী সরকার (Modi Govt) কৃষি আইন সংশোধন করার বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু, কৃষক ইউনিয়নগুলি আইন বাতিল করার দাবিতে অনড় ছিল। সেই সঙ্গে, প্রথমবারের মতো ন্যূনতম সমর্থন মূল্য বা এমএসপি-র (MSP) আইনি গ্যারান্টি, বিদ্যুৎ (সংশোধন) বিলে কৃষি-বিরোধী বিধান প্রত্যাহার এবং খড় পোড়ানোর জন্য কৃষকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিধান বাতিল-সহ অন্যান্য দাবিগুলিকেও কৃষকরা একত্রিত করে।
আলোচনা কোথাও এগোচ্ছে না দেখে, কৃষকরা সরকারের উপর চাপ বাড়াতে ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে একটি ট্রাক্টর সমাবেশের (Reactor Rally) কর্মসূচি নিয়েছিল। কিন্তু সেই ট্র্যাক্টর সমাবেশ শেষ পর্যন্ত কৃষক বনাম পুলিশ সংঘর্ষে পরিণত হয়। প্রতিবাদ হিংসাত্মক হয়ে ওঠার পিছনে রাষ্ট্রেরও হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করেছিলেন কৃষক নেতারা। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে আন্দোলনের কৌশলে পরিবর্তন এনেছিলেন কৃষক নেতারা। বড় বড় সমাবেশগুলি সবই করা হতে থাকে দিল্লির বাইরে। দিল্লি এবং তার আশেপাশে কিছু করলে, তা ছোট মাপে আরও সুশৃঙ্খলভাবে করা হয়।
কৃষকদের প্রতিবাদ আন্দোলন এই পর্যন্ত ছিল অরাজনৈতিক। রাজনীতিবিদরা তাঁদের মঞ্চে এসে সমর্থন জানিয়েছেন, কিন্তু, সেই মঞ্চ তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে দেয়নি সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। কিন্তু, এরপরই তারা বিজেপির (BJP) বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার শুরু করে। এসকেএম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাঁরা কোনও প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করবে না বা তাদের হয়ে প্রচার করবে না। তাদের বার্তা হবে স্পষ্ট, সীমিত, নেতিবাচক এবং শুধুমাত্র বিজেপির (BJP) বিরুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন (West Bengal Elections 2021) এবং অন্যান্য রাজ্যের উপনির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার করে এসকেএম। বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ (Uttar Pradesh) এবং পঞ্জাবেও (Punjab) তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। বেশ কয়েকজন নেতা নির্বাচনে লড়াই করবেন বলেও ঠিক করেছেন।
রাজনৈতিক আঘাত এই আইন প্রত্যাহারের পিছনে অন্যতম বড় অস্ত্র ছিল ঠিকই, তবে এর পিছনে চূড়ান্ত ধাক্কাটা ছিল, উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরি-তে (Lakhimpur Kheri) কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় কুমার মিশ্রের (Ajay Kr Mishra) ছেলে আশিস মিশ্রের (Ashish Mishra) ভিআইপি কনভয়ে চাপা দিয়ে চার কৃষকের হত্যা। এই ঘটনার পর আন্দোলন আরও বেশি করে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। অনেকেই, সিংগু সীমান্তে নৃশংস হত্যাকাণ্ড কৃষকদের আন্দোলনকে নষ্ট করার আরেকটি প্রচেষ্টা হিসাবে দেখেন। কিন্তু, এটি প্রতিবাদকে লাইনচ্যুত কার বদলে আরও বেশি করে ট্র্যাকে এনে দিয়েছিল।
এর কয়েক সপ্তাহ পরে, ১৯ নভেম্বর অবশেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। এরপর, মন্ত্রীসভার ছাড়পত্র এবং সংসদের দুই কক্ষের অনুমোদনে তিনটি কৃষি আইন বাতিল করা হয়েছে। তবে, কৃষকদের বাকি দাবিগুলি এখনও মানা হয়নি। ৯ ডিসেম্বর, অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে এসকেএমকে আরেকটি চিঠি দিয়ে কৃষকদের অন্যান্য অমীমাংসিত দাবিগুলি সমাধান করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। যার ফলে, কৃষকদের তাদের ঐতিহাসিক প্রতিবাদ স্থগিত করে ফিরে গিয়েছেন যে যার বাড়িতে। কৃষক নেতাদের অভিযোগ শুধু সরকার নয়, মূলধারার সংবাদমাধ্যমের একাংশও ছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। তা সত্ত্বেও, আন্দোলন এতটাই শক্তিশালী ছিল, যে তাঁরা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছেন।