সংক্ষিপ্ত

ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে কালো দিন ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন

ওই দিনই ইন্দিরা গান্ধী জারি করেছিলেন জরুরি অবস্থা

যার পিছনে অনেক বড় ভূমিকা ছিল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের

ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন

 

১৯৭৫ সালের ২৫ জুন। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে কালো দিন। ওই দিনই জারি করা হয়েছিল জরুরি অবস্থা। ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন? কীভাবে বিরোধী থেকে সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ করে ২১ মাসের ভয়াবহ অধ্যায়ে প্রবেশ করেছিল ভারত?

সেই সময় মোরারজি দেশাই, অটল বিহারী বাজপেয়ীদের মতো বিরোধী জনতা পার্টির নেতাদের জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়ছিল। তাতে শঙ্কিত হয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে নিজের অধিকার পুরোপুরি কায়েম করার উদ্দেশ্যে, ইন্দিরা গান্ধী কোনও একটা ফাঁক খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী তথা পশ্চিমবঙ্গের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়-কে।


ওই দিন সকাল থেকেই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ভারতীয় এবং মার্কিন সংবিধান ঘাঁটছিলেন। যদি কোনও ফাঁক পাওয়া যায়। অবশেষে সেই কাঙ্খিত 'ফাঁক' পেয়ে বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ প্রায় আর্কিমিডিসের ইউরেকা ইউরেকা বলে ছুটে আসার মতো তিনি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ছুটে এসেছিলেন।  

কী সেই ফাঁক? ইন্দিরা গান্ধীকে সিদ্ধার্থশঙ্কর বোঝান সংবিধানের ৩৫২ নম্বর ধারা ব্যবহার করে জনতা পার্টির আন্দোলন-কে 'অভ্যন্তরীণ হুমকি' হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যেতে পারে। তিনি বলেন জনতা পার্টি পুলিশ এবং সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছে। তাই তাদের আন্দোলনকে সম্ভাব্য 'সশস্ত্র বিদ্রোহ' হিসাবে যেতেই পারে।

সিদ্ধার্থশঙ্করের সেই প্রস্তাব দারুণ মনে ধরেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। 'জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার' জন্য সরকারী দলিল তৈরি করতে কোনও সময় ব্যয় করা হয়নি। কিন্তু, তাতে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ-এর স্বাক্ষর-ও দরকার ছিল। তাই নিয়ে অবশ্য ভাবনার কিছু ছিল না। কারণ, তার আগের বছর ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ-কে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীই। সেই কৃতজ্ঞতার দাম তিনি দেবেন বলে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন ইন্দিরা।

দলিল তৈরি হওয়ার পরই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়-কে সঙ্গে নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রপতি ভবনে যান। প্রত্যাশা অনুযায়ীই, কোনও দ্বিরুক্তি না করে ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ জরুরি অবস্থা জারির সেই দলিলে স্বাক্ষরও করে দিয়েছিলেন। কোনও রকম সাধাসাধিও করতে হয়নি। বাড়ি ফেরার পথেই বিরোধী নেতাদের মধ্যে কাদের কাদের কারাগারে ভরা হবে তার একটি তালিকা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। রাতের মধ্যেই সেই তালিকা মিলিয়ে জারি করা হয়েছিল গ্রেফতারি পরোয়ানা। রাত ২টোর মধ্যে বেশিরভাগ শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

অন্যদিকে বাড়ি ফিরে জরুরি অবস্থার ঘোষণা করে জাতির উদ্দেশ্যে কী বলবেন সেই বক্তৃতার একটা খসড়া তৈরি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তা শেষ করতে করতে রাত তিনটে বেজে গিয়েছিল। তারপর শোনা যায় নিশ্চিন্ত মনে অল্প সময়ের জন্য ছোট্ট একটা ঘুম দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।

আবার ভোর ছটাতেই উঠে পড়েছিলেন তিনি। ছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক। উপস্থিত ছিলেন শীর্ষস্থানীয় আট মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন জরুরি অবস্থা ঘোষণাপত্রের অনুলিপি এবং গ্রেপ্তার করা বিরোধী নেতাদের নামের তালিকা। মন্ত্রীরাও হাই কমান্ডের সেই সিদ্ধান্ত ঘাড় নেড়েছিলেন।

২৬ জুন সকাল সাতটায় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত জানিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। 'ভারতের সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ' থেকে তাকে বাধা দেওয়ার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে 'গভীর ও ব্যাপক ষড়যন্ত্র' করা হচ্ছিল বলে দাবি করেছিলেন তিনি। 'বিদেশী হাত'-এর প্ররোচনায় তৈরি সমস্যা থেকে দেশকে রক্ষা করতে জরুরি অবস্থা একটা 'তেতো বড়ি', এমনটাই বলেছিলেন তিনি।

এই তেতো বড়ি গিলতে হয়েছিল ভারতবাসীকে পরের ২১টা মাস। সংবাদপত্রের ছিল না স্বাধীনতা। বিরোধী দলনেতাদের ধরে ধরে বন্দি করা হয়েছিল কারাগারে। এমনকী বন্দি করা হয়েছিল রাজমাতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়া, মহারাণী গায়ত্রী দেবী-র মতো ভারতীয় বিভিন্ন রাজপরিবারের সদস্যদেরও। ইন্দিরা গান্ধী, তাঁর সরকার বা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে কেউ সামান্য মুখ খুললেও তাঁকে বন্দি করা হত। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে আর কারাগারে লোক রাখার জায়গা ছিল না। সেই সময় ল্যাম্পপোস্টে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।