সংক্ষিপ্ত


একদল বলছে চিন ছেড়ে যাচ্ছে বিদেশি লগ্নি। আরেক দল বলছে না, ঘটনা এমন নয়। আসল সত্য়ি টা কি? সুযোগ কি নিতে পারবে ভারত?

চিনের বাণিজ্য লবি গ্রুপ এবং ব্যবসায়িক পরামর্শদাতারা বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারির পরও চিনের বিদেশি লগ্নির পরিমাণ একই রয়েছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে ছবিটা অন্যরকম, এমনটাই জানা যাচ্ছে। বর্তমানে,  একের পর এক বিদেশী সংস্থাগু চিন থেকে ব্যবসা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দিনকে দিন এই প্রবণতা ক্রমে বাড়ছে এর ফলে কোভিড-১৯ মহামারির পর চৈনিক অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করানোই এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের কাছে।

২০২০ সালের নভেম্বরে, সাংহাইয়ের আমেরিকান চেম্বার অফ কমার্স বা 'অ্যামচ্যাম' তার বার্ষিক চিন ব্যবসা রিপোর্টে প্রকাশ করেছিল। তাদের আওতায় থাকা ৩৬৬ টি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে তারা বলেছিল, ৭১ শতাংশই তিন থেকে উত্পাদন শিল্প স্থানান্তরে নারাজ। ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি, বেজিং-এর জনপ্রিয় অনলাইন বিজনেস নিউজ ম্যাগাজিন ক্যাক্সিন-এও দুই বিশিষ্ট চিনা ব্যবসায়িক পরামর্শদাতা দাবি করেছিলেন, চিনের উত্পাদন শিল্প আরও বাড়ছে। অ্যামচ্যামের ওই সমীক্ষার ফলের উপর ভিত্তি করেই তাঁরা এই দাবি করেছিলেন।

তবে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, অর্থাৎ অ্যামচ্যামের ওই সমীক্ষার প্রায় এক বছর আগে, দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় আমেরিকা ও চিনের বাণিজ্য চুক্তিকে, 'বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তার সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থানে', বলে দাবি করেছিল। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ফোর্বস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছিল, উচ্চ শুল্ক, কোভিড-১৯ এবং বর্ধিত ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার ফলে চিন থেকে উত্পাদন শিল্প গুলি ব্যাপকহারে অন্য দেশে সরছে। ফলে উত্পাদন শিল্পে চিনের আধিপত্য আগের মতো নাও থাকতে পারে। একই সময়ে হংকং-এর বিশিষ্ট সাংবাদিক জোহান নাইল্যান্ডার তাঁর লেখা 'দ্য এপিক স্প্লিট' বইয়ে দেখিয়েছিলেন, কেন বাজারে আর 'মেড ইন চায়না' পণ্য চলছে না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে একই সময়ে সরবরাহ শৃঙ্খলায় চিনের অবস্থান নিয়ে দুইরকম মত তৈরি হয়েছে। কে ঠিক, কে ভুল? বস্তুত অ্যামচ্যাম-এর সমীক্ষা রিপোর্ট, চিনের উৎপাদন শিল্পগুলির একটা অংশ মাত্র দেখায়। অ্যামচ্যামের সদস্য সংখ্যা মাত্র ৩৪৬। তারা শুধু মার্কিন সংস্থাগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ না হলেও, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের সদস্যপদ গাইড অনুযায়ী, এর সদস্যদের ৭০ শতাংশই মার্কিন সংস্থা। তাই অ্যামচ্যামের সমীক্ষায় চিনের প্রকৃত উৎপাদন শিল্পের খুব সামান্য অংশই ধরা পড়েছে। কারণ, চিনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে চিনে প্রায় ৩০০,০০০ এরও বেশি উত্পাদনমূলক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। আর এই প্রতিষ্ঠানগুলির মালিকানা যদি দেশের ভিত্তিতে আলাদা করা হয় তাহলে শীর্ষ দশ দেশ হল - হংকং, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ম্যাকাও, নেদারল্যান্ডস এবং জার্মানি। চিনের মোট বিদেশী লগ্নির ৯৫.২ শতাংশই এসেছে এই এই ১০ দেশ থেকে।

সাম্প্রতিককালে জানা যাচ্ছে, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানেরর মতো যেসব দেশের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি, সেইসব দেশের প্রস্তুতকারী শিল্পগুলি চিন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। জানুয়ারিতে, ফিনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছিল, হাজার হাজার তাইওয়ানিজ সংস্থা, ওয়াশিংটন এবং বেজিংয়ের বাণিজ্য উত্তেজনা মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের কারণে চিন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মার্কিন-চিন বিরোধ না থাকলেও, চিন এখন আর লগ্নির জন্য ভাল জায়গা নয় বলে মনে করছে তারা। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে, এশিয়া টাইমস-এর খবরে বলা হয়েছিল, জাপানি নির্মাতারাও চিন থেকে বেরিয়ে আসার পথে হাঁটছে। টোকিওর পক্ষ থেকে সরাসরি এই বিষয়ে জাপানি সংস্থাগুলিকে উত্সাহ দেওয়া হচ্ছে। স্যামসাং-এর নেতৃত্বে দক্ষিণ কোরিয়ার কর্পোরেট জায়ান্টরাও এখন চিন-বিমুখ।

আরও পড়ুন - বিধাননগর যেন 'মিনি নন্দীগ্রাম' - সমানে সমানে টক্কর সুজিত-সব্যসাচীর , আছেন ভাইপো নইও

আরও পড়ুন - করোনার 'দেশি' রূপান্তরই কি আনল দ্বিতীয় তরঙ্গ, ডাবল মিউট্যান্ট নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

আরও পড়ুন - সংগঠন থেকে প্রচার, আরএসএস-ই গড়ে দিয়েছে বিজেপির জয়ের ভিত

কোভিড-১৯ মহামারির পাশাপাশি এইসব বড় বড় উৎপাদন শিল্পগুলি চিন ছাড়ার ফলে চিনা অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন, অখৎবা তাদের কর্মঘণ্টা হ্রাস পেয়েছে। ফলে স্থানীয় স্তরে অর্থনীতি দারুণভাবে মার খেয়েছে। ফলে কোভিড -১৯ পরবর্তী সময়ে বেজিং-এর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা দারুণভাবে মার খেয়েছে। এই অবস্থায় বিদেশী উৎপাদন শিল্পগুলির স্থানান্তর রুখতে মরিয়া চীন সরকার।  জাপানি সংস্থাগুলি ধরে রাখতে, চিনা কর্তৃপক্ষগুলি ট্যাক্স হ্রাস, স্থানীয় কর্মকর্তাদের জাপানি গাড়ি কেনা বাধ্যতামূলক করা, নতুন বৈদ্যুতিক এবং হাইব্রিড যানবাহন প্ল্যান্ট তৈরিতে সহায়তার জন্য আর্থিক সহায়তা দানের মতো ব্যবসায়িক সুবিধা দিতে শুরু করেছে।

কাজেই, বিদেশি লগ্নি যে সেই দেশের ক্রমশ কমছে, বিদেশি উৎপাদক সংস্থাগুলির যে চিন ছাড়ার ঢল নেমেছে, আর তাতে যে প্যআঁচে পড়েছে বেজিং, তা স্পষ্ট। তাই প্রশ্নটা এটা নয়, যে বিদেশী নির্মাতারা চিন ছাড়ছে কিনা। তারা চিন ছাড়ছে। প্রশ্নটা হল, সংস্থাগুলি একবার চলে গেলে চিন কীভাবে এবং কত দ্রুত সেই ঘাটতি মেটাতে পারবে। আর তার থেকেও বড় প্রশ্ন হল এই সুযোগটা কি নিতে পারবে ভারত? বিদেশি সংস্থাগুলির লগ্নির নতুন প্রিয় জায়গা হয়ে উঠতে পারবে আমাদের দেশ?

YouTube video player