সংক্ষিপ্ত
বঙ্গ বিজেপি নিজেরাই মেনে নেয় সেভাবে সংগঠন তাদের নেই
কিন্তু গত কয়েক দশকে বাংলায় সংগঠনের জাল ছড়িয়েছে আরএসএস
তারই সুফল ভোগ করছে বিজেপি
নির্বাচনের আগে বিজেপির হয়ে প্রচারও চালাচ্ছে আরএসএস
শমিকা মাইতি: কথায় বলে, আরএসএস আর বিজেপি নাকি সমার্থক, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ধারণাটা ঠিক নয়। আরএসএস নিজে একটা গোটা মুদ্রা হলে তার এক পিঠের কিছুটা অংশ বিজেপি মাত্র। বাংলার বুকে বিজেপির উল্কাগতির উত্থানের পিছনে সবচেয়ে বড় যে কারণ কাজ করছে, তা হল আরএসএস-এর শক্ত হাত। গত কয়েক দশক ধরে গ্রামবাংলার বিভিন্ন প্রান্তে যে ভাবে ধীরে ধীরে সংগঠনের জাল ছড়িয়েছে আরএসএস, আজ তারই সুফল ভোগ করছে বিজেপি। আবার বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলায় তাদের সাংগঠনিক কাজকর্ম আরও জোরদার করতে পারবে বলে আশা করছে আরএসএস।
হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (সংক্ষেপে আরএসএস) জন্ম ১৯২৫ সালে। আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী মতধারা অনুসরণ করে যে সংগঠনগুলি গড়ে উঠেছে এই দেশে, তাদের নিয়ে সঙ্ঘ পরিবার। ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি হল এই সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক শাখা। বিজেপির রাজনীতি, রামমন্দির আর গোরক্ষকের আয়নার সঙ্ঘ পরিবারকে দেখলে কিন্তু পুরোটা বোঝা যাবে না। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ্গ দল, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, বিদ্যাভারতী, মজদুর সঙ্ঘ, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, এমনকী মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চও রয়েছে তার ছত্রচ্ছায়ায়। আরএসএস-এর স্বয়ংসেবকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এমন ৩৬টা সংগঠন রয়েছে এ দেশে। মজদুর সঙ্ঘ যেখানে শ্রমিকদের নায্য মজুরি বা সুখ-সুবিধার বিষয়টি দেখে তেমনই বিদ্যামন্দির হল দেশের সব চেয়ে বড় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক। প্রায় ৪০ লক্ষ পড়ুয়া, ১৪,০০০-এর মতো স্কুল। শহরে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা মূলত এই স্কুলে যায়, যেখানে সঙ্ঘের মতাদর্শ মোতাবেক সিলেবাসে পড়ানো হয়। আবার প্রত্যন্ত আদিবাসী এলাকায় একল্য বিদ্যালয় চালায় সঙ্ঘ। এই সব শাখা সংগঠনগুলির মধ্যে মাঝে মাঝে মতপার্থক্য হয় ঠিকই, তবে দিনের শেষে এরা একে অন্যের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও পরিপূরক। আরএসএস-এর নির্দেশে হাজার হাজার কর্মী হিন্দুত্বের বাণী প্রচার করছে দেশ জুড়ে।
বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে আরএসএস-এর শাখা সংগঠনগুলি বহু দিন ধরে কাজ করলেও ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। আরএসএস-এর সক্রিয় কর্মী দিলীপ ঘোষ বিজেপির রাজ্য সভাপতি হওয়ার পর দু’পক্ষের সমন্বয়ে আরও জোর দেওয়া হয়। বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে বিজেপির সংগঠনকে জোরালো করতে বাংলাকে ৫টা জোনে ভাগ করা হয়েছে। এরপর লোকসভা কেন্দ্র ধরে সাংগঠনিক জেলা কমিটিগুলোকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এর পরের ভাগ হল মণ্ডল কমিটি। আগে একএকটা মণ্ডল কমিটি যেখানে ২১০-২৭০টা বুথের দেখভাল করত, সেটা কমিয়ে ৬০-৯০ করা হয়েছে। যাতে আরও ভাল ভাবে বুথগুলোর কাজ পর্যালোচনা করা যায়। দিলীপ ঘোষ জানিয়েছেন, ৫-৭টা বুথকমিটি নিয়ে গঠন করা হয়েছে শক্তিকেন্দ্র। এগুলোর দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বলে বিস্তারক। এই পদে মূলত আরএসএস-এর স্বয়ংসেবকদের নিয়োগ করা হয়েছে। এই ভাবে বিজেপির সাংগঠনিক ভিত হিসাবে কাজ করছে আরএসএস।
এছাড়াও ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটকে পাখির চোখ করে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কিছু কর্মসূচি করছে আরএসএস। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল জাগরণ কর্মসূচি। বাংলার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার নিয়ে কখনও বাড়ি বাড়ি লিফলেট বিলি করছে আরএসএস-এর স্বয়ংসেবকরা, কখনও বা ছোট ছোট মঞ্চ করে ভোটারদের বোঝানো হচ্ছে দেশাত্মবোধ, গেরুয়া শিবিরের ভাবনাচিন্তা ইত্যাদি। বিজেপির ভোটের প্রচারের সঙ্গে এর পার্থক্য কোথায়? আরএসএস-এর জেলাস্তরের এক নেতার কথায়, ‘আমরা কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের নাম বলি না। আমরা পরিস্থিতির কথা তুলে ধরি। আমরা বলি পাঁচ জন প্রার্থীর মধ্যে হেরফের রয়েছে। যে ভাল, তাঁকে ভোট দেবেন। সেই ভাল কে, তা বুঝতে সাহায্য করি আমরা। ভোট এলে লোকজন বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কাকে ভোট দেবে বুঝে উঠতে পারে না অনেক সময়। আমরা সেটা বোঝাতে সাহায্য করি।’ অর্থাৎ সরাসরি না বললেও গেরুয়া শিবিরের প্রার্থীদের হয়ে যে জাগরণ মঞ্চে প্রচার চলে তা পরিষ্কার।
এই ভাবে অরাজনৈতিক আরএসএস-এর বিভিন্ন শাখা সংগঠন রাজনৈতিক দল বিজেপির হয়ে জোরদার প্রচার চালাচ্ছে ভোটের বাজারে। আরএসএস-এর কৃষক শাখা ভারতীয় কিসান সঙ্ঘ (বিকেএস) যেমন গ্রামে গ্রামে কৃষক সুরক্ষা অভিযানের নামে প্রচার করছে, বিজেপি ক্ষমতায় এলে চাষিদের উন্নয়নে নানা প্রকল্প করবে। উত্তরে চা বলয়ে সঙ্ঘের উপস্থিতি দীর্ঘ দিনের। কোথাও চা শ্রমিকদের সমবায় চালায় সঙ্ঘ, কোথাও একলব্য স্কুল চলে, কোথাও দাতব্য ওষুধ বিলি হয়, কোনও চা বাগানে আবার বনবাসী কল্যাণ আশ্রম সক্রিয়। চা মহল্লায় গণবিবাহের আয়োজনও করে সঙ্ঘ। গত লোকসভা ভোটে চা বলয়ে বিজেপির বিপুল ভোট পাওয়ার নেপথ্যে সঙ্ঘের সক্রিয়তাই যে প্রধান, সেটা মেনেও নিয়েছেন বিজেপি নেতারা। সম্প্রতি চা শ্রমিক সংগঠনের রাশ সরাসরি নিজের হাতে তুলে নিতে উদ্যোগী হয়েছে আরএসএস। বঙ্গীয় চা মজদুর সঙ্ঘ নামে ডুয়ার্সে নতুন একটি ইউনিট খুলেছে তারা। জঙ্গলমহলের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাতে একই ভাবে বিজেপির হাত শক্ত করছে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম। প্রত্যন্ত যে এলাকাগুলোতে প্রশাসন বা শাসকদল তৃণমূল ঢুকতে পারেনি এখনও, সেখানে আরএসএস-এর সিলেবাসে শিশুদের স্কুল চলছে। স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা বানিয়ে দিয়েছেন স্বয়ংসেবকরা। আরএসএস এক নেতার কথায়, ‘আমরা কাজ করে চলেছি। বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় আসুক আর না আসুক আমাদের রোডম্যাপ তৈরি। নতুন অনেকগুলো শাখা সংগঠন খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের বড় লক্ষ্য রয়েছে সামনে।’