পুতিনের ২৬-২৭ ঘণ্টার ভারত সফরে ১০টি চুক্তি, ১৫টি MoU, ২০৩০ রোডম্যাপ, RT ইন্ডিয়া লঞ্চ এবং বিগ ক্যাট অ্যালায়েন্স অন্তর্ভুক্ত থাকবে। মোদী-পুতিনের রুদ্ধদ্বার বৈঠক এই সফরকে আরও কৌশলগত করে তুলেছে। এই হাই-প্রোফাইল মিশনের আসল ইঙ্গিত কী?

নয়াদিল্লি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ২৪-২৭ ঘণ্টার ভারত সফর শুধু একটি সাধারণ কূটনৈতিক যাত্রা নয়, বরং এটিকে দুই দেশের সম্পর্কের আগামী দশকের রোডম্যাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কূটনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এই সফরটি অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে—প্রতিটি মিনিটের এজেন্ডা স্থির, প্রতিটি বৈঠকের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এবং প্রতিটি ঘোষণার কৌশলগত তাৎপর্য রয়েছে। শীর্ষস্থানীয় সূত্র অনুসারে, এই সফরটি সেই বিরল यात्राগুলির মধ্যে একটি যেখানে পুতিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১০টি আন্তঃসরকারি চুক্তি, ১৫টিরও বেশি বড় ব্যবসায়িক MoU, ২০৩০ সালের রোডম্যাপ এবং বেশ কয়েকটি নতুন অংশীদারিত্বে সিলমোহর দিতে পারেন। পুতিনের এই 'পাওয়ার ভিজিট' কি ভারত-রাশিয়া সম্পর্ককে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাবে? 

১. মোদী-পুতিনের ‘রুদ্ধদ্বার বৈঠক’ কি বড় কোনও পরিবর্তনের ইঙ্গিত?

পুতিন ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দিল্লি পৌঁছেই সরাসরি এমন একটি বৈঠকে যোগ দেবেন, যাকে বলা হচ্ছে ‘সীমাবদ্ধ বৈঠক’ (Restricted Meeting)।

এই বৈঠকে মাত্র তিনজন থাকবেন:

  • প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
  • NSA অজিত ডোভাল
  • রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
  • অর্থাৎ কোনও প্রতিনিধি দল নয়, কোনও ক্যামেরা নয়, শুধু রুদ্ধদ্বার আলোচনা।

সূত্র অনুযায়ী, এই বৈঠকেই “নীতি নির্ধারিত হবে” এবং এই সাক্ষাৎ এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করা হচ্ছে। এরপর প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর সরকারি বাসভবন লোক কল্যাণ মার্গে পুতিনের জন্য একটি ব্যক্তিগত নৈশভোজের আয়োজন করবেন—এটি এমন একটি সফর যা বোঝায় যে দুই নেতার আলোচনার স্তর সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত এবং বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে হবে।

২. গার্ড অফ অনার এবং রাজঘাটের কার্যক্রম কি কোনও ‘বড় বার্তার’ প্রস্তুতি?

পরদিন সকালে পুতিনকে রাষ্ট্রপতি ভবনে গার্ড অফ অনার দেওয়া হবে। এরপর তিনি রাজঘাটে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানাবেন। কূটনীতিতে এই সূচিকে শুধু আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখা হয় না। একে প্রায়শই “মেসেজিং ডিপ্লোমেসি” বলা হয়—যেখানে প্রতীকী কার্যক্রম সম্পর্কের উষ্ণতা এবং সম্মানের ইঙ্গিত দেয়।

৩. হায়দ্রাবাদ হাউসে হতে চলা সবচেয়ে বড় আলোচনার এজেন্ডা কী?

হায়দ্রাবাদ হাউস এই সফরের কেন্দ্রীয় স্থান হতে চলেছে। এখানে তিনটি পর্যায় থাকবে:

১. ছোট বৈঠক

শুধুমাত্র নির্বাচিত নেতা এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে।

২. বিস্তারিত বৈঠক

সম্পূর্ণ প্রতিনিধি দলের স্তরে আলোচনা হবে।

৩. বড় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ঘোষণা

এখানে এই চুক্তি এবং নথিগুলিতে সিলমোহর পড়তে পারে: 

  • ভারত-রাশিয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা রোডম্যাপ ২০৩০
  • প্রায় ১০টি আন্তঃসরকারি চুক্তি, যার মধ্যে রয়েছে:
  • ভারতীয় এবং রাশিয়ান নাগরিকদের পারস্পরিক কর্মসংস্থান সংক্রান্ত চুক্তি
  • অবৈধ অভিবাসন মোকাবিলার কাঠামো
  • তরল রকেট ইঞ্জিন উৎপাদনের উপর বড় MoU
  • ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ১৫টিরও বেশি বাণিজ্যিক MoU

এই বৈঠকগুলির পর প্রধানমন্ত্রী মোদী পুতিনের সম্মানে একটি সরকারি মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করবেন।

৪. রাশিয়া প্রথমবার ভারতের Big Cat Initiative-এ কেন যোগ দিচ্ছে?

এই সফরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো—রাশিয়ার ইন্ডিয়ান বিগ ক্যাট অ্যালায়েন্সে যোগদান। এটি প্রধানমন্ত্রী মোদীর একটি গ্লোবাল প্রজেক্ট, যেখানে ভারত বাঘ, সিংহ, চিতাবাঘের মতো বড় বিড়ালদের সুরক্ষার জন্য বিশ্বকে আন্তর্জাতিক বিগ ক্যাট অ্যালায়েন্সের প্রস্তাব দিয়েছিল। এখন রাশিয়া এর অংশ হতে চলেছে, যা একটি বড় কূটনৈতিক জয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর পাশাপাশি পুতিন RT ইন্ডিয়ার লঞ্চ এবং রাশিয়া-ভারত বিজনেস ফোরামেও অংশ নেবেন। এই কার্যক্রমগুলিকে অর্থনৈতিক এবং মিডিয়া সহযোগিতার নতুন দরজা খোলার পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

৫. পুতিনের প্রতিনিধি দলের তালিকা এত দীর্ঘ কেন?

এই সফরের সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, পুতিনের সঙ্গে আসা প্রতিনিধি দলটি অত্যন্ত শক্তিশালী।

এতে রয়েছেন:

  • নয়জন রাশিয়ান ক্যাবিনেট মন্ত্রী
  • সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নর
  • রোজনেফট
  • রসকসমস
  • রসাটম
  • Sberbank
  • VTB
  • রুসাল
  • এবং বেশ কয়েকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান

উল্লেখ্য, রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী লাভরভ এই সফরে আসছেন না, তবে তাঁর ডেপুটি মিনিস্টার আন্দ্রেই রুডেনকো উপস্থিত থাকবেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে এত বড় প্রতিনিধি দলের একটাই লক্ষ্য—রাশিয়া ভারতের সঙ্গে নতুন অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যেতে চায়।

এই অতি-সংক্ষিপ্ত সফরটি কি বিশ্বকে কোনও বড় বার্তা দিতে চলেছে?

পুতিন শুক্রবার গভীর সন্ধ্যায় মস্কোর উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। অর্থাৎ, ২৪-২৭ ঘণ্টার এই সফর ছোট হলেও এর তীব্রতা, বৈঠকের স্তর এবং সিদ্ধান্তের গভীরতা একে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন যে এই সফর ভবিষ্যতের ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করতে পারে।