সংক্ষিপ্ত

একটু যেন ফাঁকা লাগে সুবীরের। আনন্দের একটা দিনে সবটুকু আনন্দ যেন বুঝি আর পাওয়া হয়ে উঠল না। কিন্তু কেন যাবে না অদ্বয়দা? খটকা লাগে তার। কিছু একটা রহস্য আছে। আর সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না। 

কলিংবেলের আওয়াজ শুনে অদ্বয় নিজেই দরজা খুলে দিল। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সুবীর। তাকে দেখে একগাল হেসে অভ্যর্থনা জানাল অদ্বয়। বলল, আরে এসো, এসো....
সুবীর ভিতরে এল। আর তখনই ওর চোখ পড়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবতী। বাদামি গায়ের রং। কিন্তু রীতিমতো সুন্দরী। চেহারায় তীব্র আকর্ষণ।

এই মেয়েটিকে আগেও কয়েকবার দেখেছে সুবীর। মেয়েটি সুন্দরী এবং আকর্ষণীয়া বলেই তার যেন বেশি করে কৌতূহল হল। 
সুবীর বলল, অদ্বয়দা, পরশু আমরা সবাই মিলে মন্দারমনি পিকনিকে যাচ্ছি। তুমিও নিশ্চয়ই যাবে....
অদ্বয় যেন শিউরে উঠল। বলল— না, না, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। 
কেন, অদ্বয়দা?  ফ্ল্যাটের সবাই যাচ্ছে। 

অদ্বয় কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল— আমার বাবা অসুস্থ। যে কোনো সময় দাদার ফোন আসতে পারে। এই অবস্থায় আমি কোথায় যাবো? 
সুবীর জানে, এই কথাটা অদ্বয়দা বলেই থাকে। অদ্বয়দার বাবার অনেক বয়স হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সে একদিনের জন্য শহরের বাইরে যেতে পারবে না। ওই ফোন কালেভদ্রে আসে। অদ্বয়দা এখন ফ্ল্যাট থেকে প্রায় বেরই হয় না। তাহলে না যাওয়ার কারণ কী? 

সুবীর সামান্য জোর দিয়ে বলল— অদ্বয়দা, সবাই চাইছে তোমাকে। তুমি না গেলে সবাই মিস করবে তোমাকে। সেই তো ঘরেই বসে থাকবে....
অদ্বয়কে সবাই পছন্দ করে। তার ব্যবহার খুব আন্তরিক। তার সঙ্গে মিশলে, কথা বললে একটা অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। অদ্বয় একদম ভেতর থেকে মেশে। হৃদয় দিয়ে মেশে। সে কোথাও গেলে সেখানকার পরিবেশই পাল্টে যায়। 

একটু যেন ফাঁকা লাগে সুবীরের। আনন্দের একটা দিনে সবটুকু আনন্দ যেন বুঝি আর পাওয়া হয়ে উঠল না। কিন্তু কেন যাবে না অদ্বয়দা? খটকা লাগে তার। কিছু একটা রহস্য আছে। আর সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না। 
অদ্বয়ের গলাটা এবার একটু গম্ভীর শোনায়। সে বলে, সুবীর, তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো যে, কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী....

আর কিছু বলতে পারে না সে। সুবীরও বুঝতে পারে, এরপর আর কোনো কথা চলে না। অদ্বয়দার স্ত্রী অন্তরা বৌদি কয়েক মাস আগেই মারা গেছে। হঠাৎ করেই ক্যানসার ধরা পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেনি অদ্বয়দা। এখনও হয়তো সেই শোক বহন করে বেরাচ্ছে অদ্বয়দা....

অদ্বয় আবার বলে— আমাদের নিঃসন্তান জীবন খুব সুখের ছিল। আমার স্ত্রীকে আমি ভালোবাসতাম সুবীর....
সুবীর চুপ করে থাকে। অদ্বয়ের শোক এবার যেন সত্যিই ওকে স্পর্শ করে যায়। সে মৃদুস্বরে বলে, বুঝতে পেরেছি। আমি আর জোর করব না....
সে উঠতে যায়। অদ্বয় বলে ওঠে, আরে, একটু চা খেয়ে যাও....
সুবীর এমনিতে লাজুক প্রকৃতির। অন্য সময় হলে হয়তো বলত— না, না, পরে কখনও এসে খেয়ে যাবো....

 কিন্তু কী এক রহস্যময় কারণে সে বসে পড়ল। কী কারণ এর? আর তখনই সামান্য লজ্জায় ওর ফর্সা মুখ যেন লাল হয়ে উঠল। ওই মেয়েটাকে দেখার পর থেকে তার কথা সে ভুলতে পারেনি। কথা বলছিল অদ্বয়দার সঙ্গে। কিন্তু মনে মনে মেয়েটার কথাই ভাবছিল। অদ্বয়দার প্রস্তাবে তাই সে রাজি না হয়ে পারেনি। মেয়েটাকে আর একবার, সামনা সামনি, দেখতেই হবে। তীব্র লোভ হচ্ছে তার। 
 অদ্বয় সামান্য গলা তুলে ডাকল, পাপিয়া....
রান্নাঘর থেকেই মেয়েটি বলল, বলুন....
 আমাদের একটু চা দেবে? 
দিচ্ছি। 

সুবীর কৌতূহলী হলে তাকিয়ে আছে দেখে অদ্বয় গলা নামিয়ে বলল, আমার কাছেই থাকে। কী করব বলো! তোমার বৌদি মারা যাওয়ার পর রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেরাতাম। রোজ ঠিকমতো খাওয়া–দাওয়াও জুটত না....
সুবীর বলল—  হ্যাঁ, সে তো জানি....
কিছুদিন পর পাপিয়ার সন্ধান পাই। আমার বাবাদের পাড়ায় থাকে। আমার এক দাদাই ওকে নিয়ে আসে....
যাক, খুব ভালো হয়েছে। 
হ্যাঁ, ও রোজ এসে রান্না করে দিয়ে যেত। কিন্তু তারপরই এল কোভিড....
সুবীর তাকিয়ে রইল। একটু একটু করে ব্যাপারটা বুঝতে পারছে সে....
অদ্বয় বলে চলে, পাপিয়াকে আমার কাছেই রেখে দিলাম। ও রাজি হয়ে গেল। বাইরে থেকে ওইভাবে আসা–যাওয়া তো এখন আর অ্যালাউ করা যায় না, কী বলো? 
হ্যাঁ, খুবই রিস্কের ব্যাপার। সুবীর বলল। আমাদের ফ্ল্যাটেই তো বাইরে থেকে যেসব কাজের লোক আসত, তাদের সবাইকেই নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে....
সেটাই স্বাভাবিক, অদ্বয় বলল— কিন্তু আমার তো চলবে না। আমাকে তো খেতে হবে। আমি রান্না জানি না। আর না খেয়েও তো চলবে না। তাই না? তারপর এখন বয়স হয়েছে। রোগ–ব্যাধি আছে। নিয়ম করে, নির্দিষ্ট সময়ে খেতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে....
সুবীর জানতে চায়, কত নেয়? 
দশ হাজার।
সে তো অনেকটাই। তুমি রিটায়ার করেছ....
হ্যাঁ। খরচটা একটু বেশিই করতে হচ্ছে। কিন্তু ওই যে বললাম....
সুবীর বলল, সে তো ঠিকই। তারপর এ পাড়ায় যা শুরু হল! কোভিড আক্রান্ত পরপর চারজন.... বিশেষ করে কৌশিকের ব্যাপারটা তো মানাই যায় না। একদম সুস্থ একটা ছেলে, দুদিনের মধ্যে ওইভাবে....
অদ্বয় বলল, আমার বয়স এখন তেষট্টি। বুঝতেই পারছ, রিস্ক কতটা। আমি নিজেও এখন ফ্ল্যাট থেকে বেরোই না। পাপিয়াকেও বেরোতে দিই না।  বাইরে মেলামেশা একদম বন্ধ....
সুবীর মনে মনে হিসাব করে। অদ্বয়দা এখন তেষট্টি। পাপিয়া? বড়োজোর পঁচিশ–ছাব্বিশ। দু’জনে দিনের পর দিন একসঙ্গে, একই ফ্ল্যাটে আছে। বাইরে বেরোয় না। কারো সঙ্গে মেশে না।  
হঠাৎ সে বলে, তোমাকে দেখলে কিন্তু তেষট্টি বলে মনেই হয় না....
অদ্বয় হাসে। জানতে চায়, কী মনে হয়? 
তেত্রিশ— সুবীর বলে। 

যাঃ। হেসে উড়িয়ে দেয় অদ্বয়। এ পাড়ায় সবার কাছেই সে অদ্বয়দা। কেউ তাকে কাকু বা জেঠু বলে না। এখনও তার ছিপছিপে শরীর। শরীরে এতটুকু মেদ নেই। বয়স সত্যিই বোঝা যায় না। 
ঠিক এই সময় পাপিয়া আসে। একটা ট্রে সামনে রাখে। তাতে রাখা ফুল আঁকা চায়ের কাপ আর এক বাটি চাউমিন। 

প্রথমেই চায়ের কাপে চুমুক দেয় সুবীর; আর বলে ওঠে— বাঃ! তারপর চাউমিন খেতে গিয়েই বুঝতে পারে, ওর রীতিমতো খিদে পেয়েছে। গোগ্রাসে সবটুকু চাউমিন খেয়ে নেয় সে। 
কিন্তু আর বসে থাকা যায় না। সুবীর উঠে দাঁড়ায়। এদিক–ওদিক তাকায়। কোথায় গেল পাপিয়া? মেয়েটি সুন্দরী তো বটেই! তাছাড়া সেই সৌন্দর্যের মধ্যে কেমন যেন একটা বন্যতা রয়েছে। আর একবার দেখতে পেলে হতো! 
কিন্তু পাপিয়া অন্য কোনও ঘরে আছে। সুবীরকে নিরাশ হতে হয়। অদ্বয়ও উঠে দাঁড়িয়েছে। তার সারা মুখে হাসি। বলে— নাঃ, তোমাকে আর আটকাবো না....
  
 
সুবীর বেরিয়ে যায়। তার ভুরু কুঁচকে গেছে। অন্তরা বৌদি মারা যাওয়ার পর কী অবস্থা হয়েছিল এই ফ্ল্যাটের। এখন আবার সব পরিপাটি করে গোছানো। ঘরগুলো আগের মতোই ছিমছাম, সাফসুতরো, বিছানার চাদরটা একদম টানটান। এত সৎ মানুষ অদ্বয়দা। কিন্তু নিজের কাছেই যেন কিছু একটা লুকোচ্ছে। 
   
একটু পরেই ভেতরের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পাপিয়া। একটার পর একটা পোশাক ছাড়তে থাকে। তারপর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়। অদ্বয় তখন পিছন ফিরে একটা বই খুঁজে চলেছে। 
আর ঠিক তখনই আবার ফোন বেজে ওঠে। আর একটু পরেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে অদ্বয়....
ওদিক থেকে কেউ বলে, দশ হাজার? অত টাকা দিয়ে মেয়েটাকে তুমি রেখেছো? 
না রেখে উপায় কী? খাবো কী? বয়স হয়েছে, রোগ–ব্যাধি আছে....
তা একদিন না হয় মেয়েটা একাই থাকবে। তুমি পার্টিতে চলে এসো....
অসম্ভব। যে কোনও সময় বাবার ওখান থেকে ফোন আসতে পারে...
এলেই-বা? তুমি তো এমন কিছু দূরে আসছ না....
আমার পক্ষে এখন আনন্দ–ফুর্তি করা সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী....
হ্যাঁ, ওদিকের গলা এবার নিস্তেজ শোনায়....
তুমি তো জানো, আমার স্ত্রীকে আমি কত ভালোবাসতাম....
কে না জানে সে-কথা? ওদিকের কণ্ঠ বলে। গোটা দুনিয়া জানে....
   
একটু পরে অদ্বয় ফোনটা রেখে দেয়। আর হঠাৎ তার চোখ চলে যায় সামনের ফটোর দিকে। তার স্ত্রী’র ফটো। সেদিকে তাকিয়ে সে বলতে থাকে, তোমাকে আমি ভালোবাসতাম। এখনও বাসি। বিশ্বাস করো আমাকে....
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অদ্বয়। অন্য কেউ বিশ্বাস করুক বা না-করুক, সে নিজে যেখানে এখনও বিশ্বাস করে....
কিন্তু তবুও, পিকনিক বা পার্টিতে তার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়। অসম্ভব। পাপিয়াকে ছেড়ে গেলে যে-কোনও জায়গাই তার কাছে নরক হয়ে উঠবে।
পাপিয়াকেই-বা সে অস্বীকার করে কী করে?

 

লেখক পরিচিতি- রাহুল দাশগুপ্ত, জন্ম ২৪ এপ্রিল, ১৯৭৭। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট। পড়িয়েছেন যাদবপুর ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘ প্রায় দু’দশক ধরে সাহিত্য-প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ও কবিতা লিখে চলেছেন। কর্মসূত্রে যুক্ত ছিলেন সাহিত্য একাডেমির সঙ্গেও। ২০১৭ সালে পেয়েছেন “কৃত্তিবাস সাহিত্য পুরস্কার”। “উপন্যাসকোষ” বইটির জন্য পেয়েছেন “দীপক মজুমদার সম্মাননা”। বর্তমানে নামি স্কুলের শিক্ষক।

সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময়  মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।