সংক্ষিপ্ত
শীত চলেই গেছে বলতে গেলে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তামাটে বর্ণের মসৃণ কপালে। আজ বেশ দেরি হয়ে গেল। খরিদ্দার এক-দু’জন হয়তো এখনও আসবে বসে থাকলে। আর ইচ্ছে করছে না। কয়েকটা মোটে হার আর দুল পড়ে আছে। এবার পাততাড়ি গোটানো যাক।
ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনিতে সন্ধ্যা সূচিত হওয়ার সাথে সাথেই ভিড় ঠাসাঠাসি শুরু হয় গয়নার হাটে। বর্ধমান জেলার অন্তর্বর্তী ছোট্ট এক গ্রামাঞ্চল— কুন্দপুকুর। আজ শনিবার। সপ্তাহের এই দিনটা কেবল গয়নার হাটের দিন। দুপুর গড়াতে না-গড়াতেই যে-যার পণ্যসামগ্রী সাজিয়ে বসে পড়ে পুষ্প, টগর, মঞ্জুরা।
সেই কোন ছোটোবেলা থেকে মায়ের কাছে কড়ি, পুঁতি, ঝুটো পাথরের গয়না গড়তে শিখেছে পুষ্প। নিকটবর্তী আলোকোজ্জ্বল সম্বৃদ্ধ এলাকাগুলিতে থেকে বাবু-বিবিরা আসেন গয়না কিনতে। পুষ্পর রুচিশীল ও সুনিপুণ কাজের গুণে ওর চারপাশ সবসময় পরিপূর্ণ থাকে খরিদ্দারের ভিড়ে।
সন্ধ্যার এই হাটের সময়টুকু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কাটে। নিজের সৃষ্টি অন্যের হাতে তুলে দিয়ে, কড়ায়-গণ্ডায় হিসাবটুকু বুঝে নিয়ে প্রাপ্ত মূল্য পাশে রাখা কাপড়ের ছোট্ট থলিতে রেখে দেয় পুষ্প। তা না-করে কী আর উপায় আছে? একেই পেটের দায়, তার ওপর আবার কুসুমকে ভালোভাবে বড়ো করবার মস্ত স্বপ্ন।
শীত চলেই গেছে বলতে গেলে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তামাটে বর্ণের মসৃণ কপালে। আজ বেশ দেরি হয়ে গেল। খরিদ্দার এক-দু’জন হয়তো এখনও আসবে বসে থাকলে। আর ইচ্ছে করছে না। কয়েকটা মোটে হার আর দুল পড়ে আছে। এবার পাততাড়ি গোটানো যাক।
“কী গো? চিনতে পারছো আমাকে?”— অচেনা কন্ঠস্বর শুনে ঘাড় উঁচু করে তাকাল পুষ্প। আরে? এ যে সেই দিদিমণি! আগের বছর শহরে শিল্পমেলায় দেখা হয়েছিল। এর মুখ খুব ভালোভাবেই মনে আছে। অবর্ণনীয় রূপ—যেন সুদক্ষ কোনও চিত্রকরের জাদুতুলি দিয়ে অঙ্কিত মুখাবয়ব, অদ্ভুত এক মায়াময় ঔজ্জ্বল্য। প্রথমবার দেখার পর পুষ্প শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল কয়েক মুহূর্ত। এমন রূপ তো মন্দিরের দেবীমূর্তির হয়! স্পষ্ট মনে পড়ল সব। সবুজ শাড়িতে সেদিন যেন আরও বেশি মনোমুগ্ধকর দেখাচ্ছিল সেই দীপ্তকান্তিময়ী তরুণীকে। তবে সেদিন সে একা ছিল না। সাথে এক সুদর্শন যুবকও তো ছিল। আহা! বড়ো মানানসই যুগলবন্দী!! পুষ্পর থেকে কড়ির গয়না কিনে নিজে হাতে তরুণীর গলায় পরিয়ে দিচ্ছিল যুবক।
গয়না কিনে চলে যাওয়ার আগে পুষ্পর নাম-ধাম সব জিজ্ঞাসা করেছিল এই দীপ্তকান্তিময়ী। বেশ কয়েক মুহূর্ত চলেছিল পরিশীলিত শহুরে আর রুক্ষ গ্রাম্য ভাষার বাক্যবিনিময়। পুষ্প যদিও তরুণীর নাম জানতে চায় না। ও তো দেবী!! দেবীরাই তো এমন হয়।
দু’জনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেদিন মনটা কেমন উতলা হয়ে উঠেছিল ওর। ওই চরম ব্যস্ততার মধ্যেও বার বার দূরে বসে থাকা লখাইয়ের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। লখাইও তখন মহা ব্যস্ত— সুতলি দড়ির পাপোশ আর ব্যাগের বিক্রিবাটা নিয়ে।
চরম শীত পড়েছিল তখন। ওই দু’জনকে দেখার পর থেকে কাজে মন বসাতেই পারছিল না পুষ্প। শীত বড়ো নিষ্ঠুর... মনকে বড্ড আদর-কাঙাল করে তোলে যেন! উন্মত্তের মতো সেদিন লখাইয়ের স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছিল খুব।
“কী গো? কী এত ভাবছ?”... তরুণীর ডাকে সম্বিত ফিরল পুষ্পর।
“কিস্সু না গো দিদিমুনি, তুমি আমারে মনে রাইখস?”
“মনে রাখবো না কেন? এবারের শিল্পমেলায় তো দেখলাম না তোমাকে?”
“এবারে যাই নাই গো... তা তুমি এখেনে?”
“এখানে আমার দিদার বাড়ি। আজ গয়নার হাট বসে শুনে এলাম।”
“দাদাবাবু কুথায়? আসেন নাই?”
প্রশ্ন শুনে ম্লান হয়ে গেল দেবীর মুখ।—
“আমি একলাই গো!! আমার কোনও দোসর নেই আর। ওই লাল রঙের মালাটার দাম কত? দাও তো দেখি?”
তরুণীকে মালা এগিয়ে দিয়ে অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পুষ্প।—
“আমরা সবাই একলা গো দিদিমুনি!” স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যেন তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কথাগুলো।
হাটশেষে আজ আর টগরদের সঙ্গে ভ্যানে না-ফিরে পুষ্প হাঁটতে শুরু করল। এখন একটু নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে। খুব মনে পড়ছে আগের বছরের শিল্পমেলার কথা।...
শহরের মেলায় বসবার জায়গার ব্যবস্থা লখাই করেছিল। দশদিন ওর সাথে একসঙ্গে থাকা— ভাবতেই কেমন গায়ে কাঁটা দেয়, অদ্ভূত এক শিরশিরানি!
পুষ্প অনুমতি চাইবার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠান্ডা গলায় বলেছিল যমুনা— “লখাইরে কইবি, আশপাশের মন্দিরে গিয়া তুর কপালে যেন সিন্দুর লেইপ্যা দেয়।”
তার মা যমুনা বরাবরই এমন... আবেগের বহিঃপ্রকাশ কম। মা-কে কোনোদিন রাগ, উচ্ছ্বাস, আনন্দ প্রকাশ করতে দেখেনি সে। কথাও বলে মেপে, নির্লিপ্ত স্বরে। কিন্তু দূরদর্শিতার অভাব নেই যমুনার মধ্যে। পুষ্প নিজের বাপকে কোনওদিন চোখে দেখেনি। তার অভিভাবক বলতে যমুনাই।
হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিল লখাই— “বিয়ার দিন কি পলায়ে যাইব? অহন ইদিকে কারবারে মন দে।”
প্রতিদিন মেলা শেষে লখাইয়ের কোনও এক বন্ধুর ফাঁকা ডেরায় গিয়ে উঠত ওরা দু’জন। দশদিনের অস্থায়ী সংসার পুষ্প সাজিয়ে তুলেছিল। তার আর লখাইয়ের সংসার।
স্নান করে শরীর থেকে সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে স্টোভ জ্বালিয়ে ভাত বসাত পুষ্প। গরম ভাতের গন্ধে খিদে আরও চনমন করে উঠত দু’জনের। খাওয়া শেষে হ্যারিকেন নিভিয়ে শীতরাতে আদর-জড়ানো উষ্ণতা খুঁজে নিত ওরা— পরস্পরের শরীরে শরীর মিশিয়ে। লখাই সারাদিনের পরিশ্রম আর শহুরে ধুলোমেশানো বিরক্তিটুকু পুষ্পর নরম শরীরের মধ্যে উজাড় করে দিয়ে তবে শান্ত হতো; আর লখাইয়ের ওই উগ্র অশিষ্ট আদরকে সোহাগরূপে বরণ করে নিত পুষ্প। দূর থেকে ভেসে আসা ব্যস্ত শহরের ট্রাফিকের আওয়াজ আস্তে আস্তে স্তব্ধ হয়ে মিলিয়ে যেত রাতের গভীরতার অন্ধকারে। পুষ্প-লখাই পরম তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করত।
শিল্পমেলায় বিক্রিবাটা মন্দ হয়নি ওদের। পুষ্প যমুনার জন্যে চুড়িদারের পিস আর কাঁচের চুড়ি কিনে নিয়ে গে’ছিল। অতদিন পর মেয়েকে দেখে যমুনা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছিল। তারপর তার হাতটা ধরে টানতে টানতে ঠাকুরের ছোট্ট কুলুঙ্গি থেকে সিঁদুর নিয়ে পুষ্পর মাথায় লাগিয়ে বলেছিল—
“কেউ জিগাইলে কইবি, শহরে গিয়া তুদের বিয়া হইসে।”...
দু’-তিনদিন পরেই লখাই গ্রামছাড়া হয়। পুষ্পকে জানায়, কলকাতা শহরে দোকান খুলবে না-কি সে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার করেছে। সব পাকাপাকি ব্যবস্থা হয়ে গেলে পুষ্পকে এসে নিয়ে যাবে... চিরতরে জীবনসঙ্গিনী করে।
যাবার দিন কপালে চুমু দিয়ে যায় লখাই। ওর চলে যাওয়ার রাস্তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পুষ্প। বিকেল গড়িয়ে রাতের আঁধার নেমে আসে চোখে।
তারপর আর কথা হয়নি লখাইয়ের সাথে। লখাইয়ের মোবাইল নম্বরটারও আর অস্তিত্ব নেই। কয়েকদিনের মধ্যে শীত পেরিয়ে বসন্ত আসে। গোটা গ্রামজুড়ে কৃষ্ণচূড়া ও পলাশের লাল আভার ছড়াছড়ি। সবার অলক্ষ্যে ডুকরে কেঁদে ওঠে কপোতবিহীন কপোতী। দুরু দুরু বুকে যমুনাকে এসে একদিন জানায় পুষ্প,
“মা গো! হয় নাই, এমাসে হয় নাই গো!”
যমুনা একঝলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মায়ের দু’চোখের কোণে সেদিন সে দু’ফোঁটা জল দেখতে পেয়েছিল যেন!!
গ্রামের অনেকের কলকাতায় যাতায়াত আছে। লখাইয়ের সাথে তাদের মাঝেমধ্যেই সাক্ষাৎ ঘটে। পুষ্প খবর পায়— বেশ ভালোই আছে লখাই। বছর ঘুরে আবার শীত আসে, শীত পেরিয়ে বসন্ত— আবার...
আজ ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের মধ্যে ফের সেই দীপ্তকান্তিময়ীকে দেখতে পেল পুষ্প। পরনে তার পলাশরঙা শাড়ি। হাতে, গলায় পলাশফুলের মালা। আহা! কী অপূর্ব দেখাচ্ছে। তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল সেই দেবী। পুষ্প এগিয়ে চলল তার হাতটা ধরে। আজ সে নিজেও পলাশের গয়নায় সুসজ্জিতা। লম্বা, ফাঁকা রাস্তা। হেঁটে চলেছে তারা দু’জন। চারিদিকে আর কেউ কোথাও নেই!...
চকিতে ঘুমটা ভেঙে গেল। ভোরের নরম আলো এসে পড়ছে চোখে-মুখে। পাশে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করছে চার মাসের কুসুম। ওকে কোলে তুলে নিয়ে তাদের মাটির ঘরের সামনের জলাশয়টার কাছে এসে দাঁড়াল পুষ্প। কসুমকে আঁকড়ে ধরে গালে গাল ঘষল সে। ছোট্ট তুলতুলে শরীরের ওমটুকু নিজের মধ্যে মিশিয়ে নিল। অগণিত শালুকফুলে ভরে ওঠা জলাশয়ের কিনারে খেলে বেড়াচ্ছে এক সাদা ধবধবে বক ও তার ছোট্ট ছানা। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল কুসুম। নৈসর্গিক প্রকৃতি প্রতিবারই জানান দেয় পৃথকভাবে, পৃথকরূপে— বসন্ত এসে গেছে।
লেখক পরিচিতি: নীলাঞ্জনা মল্লিক। জন্ম ও বেড়ে ওঠা হুগলী জেলার রিষড়ায়। বেসরকারি চাকরির কাচের ঘরবন্দী জীবনকে ইস্তফা দেওয়ার পরে লেখিকা সত্তার জন্ম। বেশ কিছুদিন একটি শ্রুতিনাটকের গ্রুপে যুক্ত থাকায়, প্রয়োজন এবং ইচ্ছার যৌথ তাগিদেই নাটক, গল্প, কবিতা লেখার সূত্রপাত। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘নবকল্লোল’ পত্রিকায়। বর্তমানে বসবাস অসম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরে।
সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময় মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।