প্রজাতন্ত্র দিবস থেকে রাজস্থানের জালোর জেলার ১৫ টি গ্রামে তরুণী ও বউদের জন্য নিষিদ্ধ করা হল ক্য়ামেরাযুক্ত মোবাইল ফোন। ইন্টারনেট কানেকশনযুক্ত ফোনই ব্যবহার করতে পারবেন না তাঁরা।
একদিকে দেশ জুড়ে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, অন্যদিকে মেয়েদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে স্মার্টফোন—এই বৈপরীত্যই এখন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে এক রাজ্যের সমাজব্যবস্থাকে। ২১ শতকের ভারতে দাঁড়িয়ে যেখানে মোবাইল ফোন শুধুই যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতার অন্যতম হাতিয়ার—সেখানে মেয়েদের জন্য মোবাইল-ইন্টারনেট কার্যত নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘিরে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে।
রাজস্থানের জালোর জেলার অন্তর্গত প্রায় ১৫টি গ্রামে সম্প্রতি এক অভাবনীয় ‘সামাজিক নির্দেশিকা’ জারি করা হয়েছে। ওই নির্দেশ অনুযায়ী, তরুণী ও বিবাহিত মহিলারা ক্যামেরাযুক্ত বা ইন্টারনেট সংযোগ থাকা কোনও মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। তাঁদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে শুধুমাত্র সাধারণ কি-প্যাড মোবাইল—যাতে না থাকে ক্যামেরা, না থাকে নেট কানেকশন।
প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে গাজীপুর গ্রামে চৌধরি সম্প্রদায়ের এক সভা থেকে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। সভায় উপস্থিত স্থানীয় মহকুমা স্তরের কয়েকজন নেতা জানান, সমাজে ‘শৃঙ্খলা’ বজায় রাখতেই এই নিয়ম। শুধু তাই নয়, মেয়েরা ঘরের বাইরে—বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা প্রতিবেশীর বাড়িতে গেলেও—মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখতে পারবেন না।
তবে এই নিষেধাজ্ঞায় সামান্য ছাড় রয়েছে স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের ক্ষেত্রে। পড়াশোনার প্রয়োজনে তারা বাড়ির ভেতরে সীমিত সময়ের জন্য ফোন ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু বিবাহিত মহিলাদের জন্য সেই ছাড়ও নেই। তাঁদের ক্ষেত্রেও ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই, তাও শুধু কি-প্যাড ফোন ব্যবহারের অনুমতি।
এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে স্থানীয় নেতাদের একাংশ দাবি করেছেন, অনেক সময় বাড়ির মহিলারা শিশুদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন। এর ফলে ছোটদের চোখ ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। সেই কারণেই নাকি এই কড়াকড়ি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—শিশুদের সুরক্ষার অজুহাতে কেন শুধু মহিলাদের উপরই এই বিধিনিষেধ চাপানো হল? পুরুষদের ক্ষেত্রেই বা একই নিয়ম প্রযোজ্য নয় কেন?
আরও বড় প্রশ্ন, জরুরি পরিস্থিতিতে মেয়েরা কীভাবে সাহায্য চাইবেন? হাসপাতাল, পুলিশ বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন হলে কী হবে? এই সব প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর মেলেনি পঞ্চায়েত বা সমাজপতিদের কাছ থেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোন মহিলাদের নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতার অন্যতম মাধ্যম। শিক্ষা থেকে শুরু করে সরকারি প্রকল্প, অনলাইন ব্যাঙ্কিং, এমনকী জরুরি পরিষেবার ক্ষেত্রেও ইন্টারনেট অপরিহার্য। সেখানে একতরফা ভাবে মেয়েদের ডিজিটাল জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত আধুনিক ভারতের ভাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গ্রামগুলির মেয়েদের মতামত নেওয়া হয়নি। ফলে অনেকেরই ধারণা, এটি আসলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণেরই আর এক রূপ—যার ভার শেষ পর্যন্ত বইতে হচ্ছে মেয়েদেরই। ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা তাই শুধু মোবাইল ব্যবহারের নয়, প্রশ্নটা সমানাধিকার ও স্বাধীনতার। আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এখন তাকিয়ে গোটা দেশ।


