সংক্ষিপ্ত
- বিজেপির কাছে জোর ধাক্কা খায় তৃণমূল
- বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল হিসেব কষে এগনোর চেষ্টা চালাচ্ছে
- দাবি অনুযায়ী গোর্খাদের সাংবিধানিক অধিকার দিতে হবে
- উত্তরবঙ্গের ৫৪টি আসনে বিজেপিকে হারানোই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য
তপন মল্লিক, কলকাতা- ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি বার বার ছুটে যেতেন অশান্ত পাহাড়ে। তারপর বার বার বলতেন পাহাড় হাসছে। কিন্তু গত লোকসভা ভোটে সেই পাহাড়-সহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ তাকে হতাশ করে। বিজেপির কাছে জোর ধাক্কা খায় তৃণমূল। গোটা উত্তরবঙ্গের কোথাও একটি ঘাস-ফুলও ফোটে না। তাই ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের কাছে বিরাট চ্যালেঞ্জ পাহাড় এবং উত্তরবঙ্গ। যদিও আভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে শুরু করে দল ছেড়ে যাওয়ার লম্বা লাইনে উত্তরবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস যথেষ্ট বিধ্বস্ত, কিন্তু একুশের ভোটে উত্তরবঙ্গে আবার ফিরে আসাই তৃণমূলের অন্যতম লক্ষ্য। তাই বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল হিসেব কষে এগনোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
আরও পড়ুন- এক ধাক্কায় চড়ল তাপমাত্রার পারদ, রাজ্য থেকে কি বিদায় নিচ্ছে শীত
এদিকে দীর্ঘ কাল বেপাত্তা বিমল গুরুং পাহাড়ে ফিরে প্রকাশ্যে গোর্খ্যাল্যান্ড নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপরেই খোলাখুলি আস্থা ও সমর্থন জানিয়েছেন। কেবল তাই নয়, বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিমল গুরুং বলেছেন, আমরা চাই ২০২১-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসুন। পাহাড় থেকে ডুয়ার্সের ভোট প্রচারের দায়িত্ব নিজে কাঁধে তুলে নিয়েছেন বিমল গুরুং। শুধু পাহাড় নয়; সঙ্গে ডুয়ার্সকেও একুশে টার্গেট করেছেন গুরুং। মমতার হাতে পাহাড়-ডুয়ার্সের ১৮টি আসন তুলে দেওয়ার পণ করেছেন গুরুং। আদিবাসী বিকাশ পরিষদ এখন বিজেপির বিপক্ষে। সেই হিসেব অনুযায়ি এবার আদিবাসী ও নেপালি ভোট তৃণমূলের পক্ষে আসবে বলেই মনে হচ্ছে।
অন্যদিকে গুরুং পাহাড়ে ফেরার পর থেকে পাহাড়ের হাওয়া অন্যরকম। রাজনৈতিক বিশেষঙ্গদের একাংশ মনে করছেন, বিজেপি পাহাড়ের আসনগুলির আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছে। কারণ, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ পরপর তিনবার দার্জিলিং লোকসভা আসন থেকে বিজেপি বিপুল ভোটে জয়ী হলেও সেটা সম্ভব হয় বিমল গুরুংয়ের নেতত্বাধীন মোর্চার সৌজন্যে। পাশাপাশি গত ১০ বছরে বিধানসভার বিভিন্ন ভোটে বিমল গুরুংয়ের নেতত্বাধীন মোর্চার জয় হয়য় বিজেপির জোটসঙ্গী হয়ে। প্রশ্ন; তাহলেকেন আবার বিজেপিকে হারাতে তৃণমূলকে সমর্থন? বিজেপিকে এত বছর সমর্থন দিলেও, মোদী-শাহরা কথা রাখেনি। তাই গুরুং খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সমর্থন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকেই। তাছাড়া আগামী দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই থাকবে রাজ্যপাট। তাই এবার বিজেপি ডুয়ার্সের আসনগুলি নিয়ে বেশ দোটানায় রয়েছে। একথা ঠিক যে বিমল এবার ডুয়ার্সকেও তার টার্গেট করেছেন। কারণ আলিপুরদুয়ারে গুরুংয়ের প্রভাব রয়েছে। তৃণমূলকে প্রকাশ্যে সমর্থনের কথা ঘোষণা করার পর গুরুং পাহাড় থেকে উত্তরবঙ্গের সমতলেও তৃণমূলকে জেতানোর দায়িত্ব প্রায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আর তারপর থেকেই বিজেপি সাংসদ জন বার্লা গুরুংয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তাঁকে পরম মিত্র মেনে নিয়েছেন।
এই ঘটনা উত্তরের রাজনীতিতে যমন জল্পনা বাড়িয়েছে তেমনই পাহাড়ের রাজনৈতিক সমীকরণও অনেকাংশে বদলাবে বলেই মনে হচ্ছে। উত্তরবঙ্গে বিজেপির এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ বিমল গুরুং বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিমল গুরুং মমতার পক্ষে ময়দানে নেমে পড়ায় বেশ চাপে পড়ে গিয়েছেন বিনয় তামাং-অনীত থাপারা। নবান্নে ডেকে এনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করলেও কোনও সমন্বয় তৈরি হয়নি। বরং বিমল বনাম বিনয় অর্থাৎ গুরুং বনাম তামাং যুদ্ধের উত্তেজনা আরও টানটান হয়েছে। বিনয় তামাংকে কোনওভাবেই মেনে নিতে নারাজ বিমল গুরুং। তবে এই পরিস্থিতিটা কিন্তু বিজেপির পক্ষে খুব লাভজনক। বিজেপি এবার যে কিছুতেই বিমল গুরুংকে পাবে না সেটা খুবই স্পষ্ট। সেজন্যেই তারা পেতে চাইছে বিনয় তামাংকে। বিনয় তামাঙকে পেলেই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার ভোট ভাগ হয়ে যাবে। এছাড়া জিএনএলএফের সমর্থন তো বিজেপির পক্ষেই আছে। ফলে বিমল গুরুং আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জোটকে চ্যালেঞ্জ জানানোটা অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।
তবে বিজেপির এমন ভাবনা কার্যত ডুমুর গাছে ফুল দেখার মতো। কারণ, একুশের বিধানসভা ভোটের প্রাকমুহুর্তে যা পরিস্থিতি, তাতে বিনয় তামাং শিবির বিমল গুরুঙের থেকে একটু কোণঠাসা অবস্থাতেই রয়েছে। বিমল গুরুং পাহাড়ে ফিরেই নতুন করে গোর্খাল্যান্ডের দাবি চারিয়ে দিয়েছে। পাহাড়ে রাজনীতি করতে গেলে এবং পাহাড়বাসীর মনে পেতে গেলে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে জিইয়ে রাখতে হবে। তাই পাহাড়ের মানুষদের দীর্ঘদিনের দাবি নতুন করে উস্কে দিয়েছেন গুরুং। অন্যদিকে বিনয় তামাং গত ৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে গোর্খাল্যান্ডের দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি দার্জিলিং পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্সের বাসিন্দা ও গোর্খাদের সাংবিধানিক ন্যাসের দাবি জানান। পাহাড়ে টিকে থাকতে গেলে জনতার দাবি মেনেই যে কাজ করতে হবে সেটা দেরিতে হলেও বুঝেছেন বিনয় তামাংও। তাঁর দাবি অনুযায়ী গোর্খাদের সাংবিধানিক অধিকার দিতে হবে। উত্তর-পূর্ব পর্ষদে গোর্খাল্যান্ডের অংশকে ঢোকাতে হবে। তৈরি করতে সারা ভারত গোর্খা সমিতি। সেটা গড়তে গেলে তামাংকে গুরুংয়ের সঙ্গেই হাত মেলাতে হবে। অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছেন বিনয় তামাং।
কিন্তু বিজেপি জানে পাহাড়ে বা সমতলে ভোটের হিসেবটা এত সহজ নয়। কারন বিমল গুরুং ইতিমধ্যে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ থুড়ে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, কেবল পাহাড়ের তিনটি আসন নয়, তাছাড়াও উত্তরবঙ্গের ৫৪টি আসনে বিজেপিকে হারানোই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। তিনি হঙ্কার দিয়ে জানিয়েছেন, বিজেপিকে উত্তরবঙ্গ থেকে পুরোপুরি মুছে দেবেন। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি কার্শিয়াংয়ে বিমল গুরুঙের সভা। বোঝাই যাচ্ছে সেই সভা থেকে তিনি আরও কিছু ঘোষণাকরবেন। সেদিন গুরুং কী বলেন, এখন সেদিকে তাকিয়ে পাহাড়বাসী।