সংক্ষিপ্ত

শেষ দফার নির্বাচনে বিজেপি যেভাবে ঘুঁটি সাজিয়েছে তাতে তারা হিন্দু ভোটের ঐক্যবদ্ধতা এবং দলিত ভোটকে তাঁদের অভিমুখে আনার চেষ্টা করেছে। যেমন বীরভূম জেলার ১১টি আসনেই বিজেপি দলিত ভোটব্যাঙ্ককে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের শেষ দফায় ভোট হচ্ছে ৩৫টি আসনে। আর এই আসনগুলি অবস্থান করছে এক অভূতপূর্ব ভৌগলিক অবস্থান এবং জনজাতির নিরিখে। যেখানে একটা ট্রাম্প কার্ডের মতো ভূমিকা নিয়েছে দলিত ভোট। এই শেষ দফায় মালদহ জেলার ৬টি আসনে, মুর্শিদাবাদের ১১টি আসনে, কলকাতার ৭টি আসনে এবং বীরভূমের ১১টি আসনে ভোটগ্রহণ। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলকে ধরে দেখলে যেটা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে যে তৃণমূল এই ৩৫টি আসনের মধ্যে ১৭টি-তেই জয় পেয়েছিল। কিন্তু, হিসেব উল্টে দিয়েছে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফল। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে এই ৩৫ আসনের মধ্যে বিজেপি ১১টি-তে এগিয়ে ছিল। 

শেষ দফার নির্বাচনে বিজেপি যেভাবে ঘুঁটি সাজিয়েছে তাতে তারা হিন্দু ভোটের ঐক্যবদ্ধতা এবং দলিত ভোটকে তাঁদের অভিমুখে আনার চেষ্টা করেছে। যেমন বীরভূম জেলার ১১টি আসনেই বিজেপি দলিত ভোটব্যাঙ্ককে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে। বিশেষ করে একবার সমগ্র বীরভূম জেলায় বিজেপি ভোট শেয়ারিং-এর অঙ্কে নজর রাখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে। কারণ, ২০১৬ সালে বিজেপি এই জেলাতে মাত্র ১০.৯৫ শতাংশ ভোটশেয়ারিং অবস্থান করছিল। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পর দেখা গিয়েছে বীরভূম জেলায় বিজেপি প্রায় ৪১ শতাংশ ভোট শেয়ারিং-এ উঠে এসেছে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের থেকে তাদের ব্যবধান মাত্র ৫ শতাংশের সামান্য কিছু বেশি ভোটের। বীরভূমের বুকে বিজেপি-র এই উত্থান সম্ভব হয়েছিল মূলত দলিত ভোট ব্যাঙ্ককে সামনে রেখে। কিছু অঞ্চলে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কও বিজেপি-র দখলে এসেছিল কিন্তু, সেটা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ও অন্তর্কলহে। এই সব সংখ্যালঘু ভোটদাতারা ছিলেন আদি তৃণমূল। কিন্তু, ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেস এবং সিপিএম থেকে অসংখ্য লোক তৃণমূলে যোগ দেন। এই নিয়ে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে যারা আদি তৃণমূল বলে পরিচিত ছিলেন তারা বিজেপি-র দিকে তাঁদের সমর্থনের অভিমূখ নিয়ে আসেন। এর প্রমাণ ইলামবাজারের কয়েকটি অঞ্চল এবং বোলপুর, সিউড়ি লাগায়ো কিছু এলাকা। মালদহের ক্ষেত্রে বিজেপি-র আবার জোর হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের উপরে। সেই সঙ্গে দলিতদের ভোট। মালদহের এমনকিছু এলাকা রয়েছে যেখানে অসংখ্য আদিবাসীদের বসবাস। কিন্তু, তৃণমূল কংগ্রেস এই আদিবাসীদের জন্য সেভাবে কিছুই করেনি। রাজ্যে ক্ষমতায় পালাবদলের পর যে মাত্রা উন্নয়ন এদের কাছে পৌঁছানো উচিত ছিল তা আদপে তৃণমূল শাসিত সরকার করে উঠতে পারেনি বলেই অভিযোগ। আর এরই সুযোগ নিয়েছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে যেখানে যেখানে বিজেপি এবং আরএসএস-এর শক্ত ঘাঁটি রয়েছে, তারমধ্যে মালদহ অন্যতম। এমনকী, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিজেপি-কে যিনি একটা স্তরে তুলে এনেছিলেন যে তপন শিকদার। তাঁর বাড়িও এই মালদহের বুলবুলচণ্ডীতে। কিন্তু, এর সত্ত্বেও ২০১৬ সালের আগে বিজেপি-র ভোট শেয়ারিং-এ বৃদ্ধিতে উল্কার গতি ছিল না। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে খগেন মূর্মূর বিজেপি-তে যোগদান মালদহের দলিত ভোটব্যাঙ্ককে পদ্মফুলের কাছে নিয়ে আসে। এরসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই মালদহে সংখ্যাগুরু মুসলিম জনজাতির বিরুদ্ধে অসহায় বোধ করছিলেন হিন্দুরা। বিশেষ মালদহ লাগোয়া যে সব অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্যে বেশি- যেমন কোতোয়ালি, রতুয়া, মানিকচক, হরিশ্চন্দ্রপুর, মালতিপুর- এর বসবাসকারী হিন্দুরা তাঁদের অভাব অভিযোগ জানানোরও ঠিকানা পাচ্ছিলেন না। কারণ, এই অঞ্চলে তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেসের রাজনীতির ভিত্তি হল মুসলিম তোষণ। বিজেপি-এই সুযোগটা নিয়ে এই অঞ্চলে হিন্দুভোটকে সংগঠিত করে ফেলেছে। যার ফলে যেখানে ২০১৬ সালে মালদহ জেলাতে বিজেপি-র ভোট শেয়ারিং ছিল ১৭ শতাংশের কাছাকাছি। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সেই ভোট শেয়ারিং সাড়ে আটত্রিশ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। মুর্শিদাবাদের যে ১১টি আসনে ভোট হচ্ছে সেখানে বিজেপি-র নিশানায় রয়েছে হিন্দু ভোট। কলকাতার যে ৭টি আসনে ভোট হচ্ছে সেখানে শুধু বাঙালিদের আধিক্য রয়েছে এমনটা নয়, সেখানে প্রচুর সংখ্যক অবাঙালি হিন্দুও বাস করেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন মারোয়াড়ি থেকে শুরু করে গুজরাটি, কেরালাইট, তামিল, তেলেগু। এই ভোটব্যাঙ্কে নিজেদের দিকে সংগঠিত করে এই নির্বাচনে কৌশল সাজিয়েছিল বিজেপি। 

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল ব্যাখ্যা করলে দেখা যাচ্ছে, শেষ দফার আসনগুলিতে বিজেপি-র আতঙ্কে কীভাবে প্রার্থী বদল করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। লোকসভা নির্বাচন ২০১৯-এর ফলাফলে এই দফায় ৩৫টি আসনের মধ্যে ১৯টি আসনে তৃমমূল এগিয়ে থাকলেও বিজেপি-র সঙ্গে ভোটশেয়ারিং-এর ব্যবধান ছিল নামমাত্র। এছাড়াও বিজেপি এগিয়ে ছিল ১১টি আসনে। ৫টি আসনে কংগ্রেস এগিয়ে থাকলেও বামেরা একটি আসনেও আধিপত্য বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মালদহে যে ৬টি আসনে তৃণমূল পিছিয়ে ছিল, তারমধ্যে ৪টি আসনেই প্রার্থী বদল করেছে তারা। মুর্শিদাবাদে ১১টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৯টি আসনেই এবার নতুন মুখ দাঁড় করিয়েছে। কলকাতাতেও যে ৭টি আসনে শেষ দফায় ভোটগ্রহণ হচ্ছে তাতেও ২টি নতুন মুখ রয়েছে তৃণমূলের। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এত প্রার্থী বদল শুধুমাত্র ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা বিজেপি-র জন্য। কারণ, প্রার্থীদের জন্যও যে ২০১৯ লোকসভা ভোটে অসংখ্য আসনে তৃণমূল ও বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান নামমাত্র হয়েছিল তা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।