সংক্ষিপ্ত

  • ভোট বাংলায় নির্ধারক হবে উঠবে কতগুলি বিষয় 
  • মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের জনপ্রিয়তা গুরুত্বপূর্ণ 
  • গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বামেরাও 
  • বিজেপির অতীত  ফলাফল খুব একটা সুখকর নয় 

তাপস দাস, প্রতিনিধি, বেশ কিছু আসনের ভোট হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। ২৯৪ আসনের বাংলায় এবার ভোটের মেয়াদ দীর্ঘতম। আট দফার ভোটগ্রহণ শেষ হতে মাস শেষ হয় যাবে। আগামী মাসের গোড়ায় ভোটের ফল। এই দীর্ঘমেয়াদি ভোটে যে যে বিষয়গুলি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে, তার কয়েকটি এখানে আলোচিত হল। 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা

২০১১ সালের ভোট নিয়ে কথা প্রচুর হয় বটে, কথা হয় নন্দীগ্রাম নিয়ে, সিঙ্গুর নিয়ে। কথা হয় মমতার তীব্র বিজেপি বিরোধী অবস্থান নিয়েও। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসকে সিপিএমের বি টিম বলে দল ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস গঠনের পর থেকে ৬ বছর, ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিজেপিকে স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে মনে করেছিলেন মমতা। তাদের এ বঙ্গে পায়ের নিচে জমি দিয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালে নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর আন্দোলনে ভর করে তিনি ক্ষমতা দখল করেন, ২০১৬ সালের ভোটেও মাৎ করে দেয় তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে দেখা যায় পাশার দান উল্টোতে শুরু করেছে। সে ভোট শুধু বিজেপির অনেক আসন লাভের ভোটই ছিল না, ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়ার ভোটও। ২০১১ সালের পর থেকে মমতার জনপ্রিয়তা এত কম কখনও হয়নি বলে দেখিয়েছিল একটি সমীক্ষাও। মমতার জনপ্রিয়তায় যে খাদ এসেছে সে কথা সরাসরি না বললেও, স্থানীয় স্তরে বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ষোভের কথা মেনে নিয়েছেন প্রশান্ত কিশোরের মত ভোটকৌশলীও। ২০১৬র সময়ে ওই একই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, প্রথম পাঁচ বছরে তৃণমূল নেতারা অনেক বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে সাধারণ মানুষ মনে করছেন, কিন্তু মমতার জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণই ছিল তখন। ২০২১-এর ভোট মমতার জনপ্রিয়তা কতটুকু রয়েছে, তারও পরীক্ষা নেবে। 

 

আমফানের প্রভাব

২০২০ সালের মে মাসে যে সুপার সাইক্লোন এ রাজ্যে বয়ে যায়, তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি ও পূর্ব মেদিনীপুরে। মোট ১২৫টি বিধানসভা এলাকা এই সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমফানের ত্রাণ নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের একেবারে নিচের স্তরের কর্মীরা পর্যন্ত দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ ওঠে। দরিদ্রতম মানুষ, যাঁদের প্রাপ্য ত্রাণ মেলেনি, তাঁরা যদি সে হিসেব ভোটের বাক্সে মেটাতে যান, তাহলে তৃণমূলের কপালে দুর্ভোগ রয়েছে। 

ভোট ফর লেফট বনাম নো ভোট টু বিজেপি

রাজ্যে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট তাদের সমর্থকদের মধ্যে যখন ভোট ফর লেফট স্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছে, তার বেশ কিছুদিন আগেই নো ভোট টু বিজেপি প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছিল। মূলত বামফ্রন্টবিরোধী রাজ্যের বাম ও গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত শক্তি নো ভোট টু বিজেপি স্লোগান সামনে রেখে বিভিন্ন মঞ্চ তৈরি করে। ২০১৯ সালের ভোটে রাজ্যে ৪১টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল বামেরা। তাদের কপালে জুটেছিল মাত্র ৭.৫ শতাংশ ভোট। ২০০৯ সালের ভোটের সঙ্গে তুলনা করলে, তাদের ভোট শেয়ার কমেছিল ৩৫.৮ শতাংশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাম ভোটাররা, যারা ২০১৯ সালের ভোটে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন, যে কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে সিপিএমের তরফেও, তাঁরা একেবারে ফেলনা শক্তি নাও হতে পারেন ২০২১-এর ভোটে। তবে সিপিএম এবার কংগ্রেস ও আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে ফ্রন্ট গড়ে নির্বাচন লড়ছে বলে পরিস্থিতি কিঞ্চিৎ জটিল হয়েছে। সিপিএমের হিন্দু ভোটারদের অনেকেই ফুরফুরা শরিফের পীরজাদার সঙ্গে ফ্রন্টের ঘটনায় ক্ষুব্ধ। তাঁরা এ কারণেই আবার বিজেপিকে ভোট দিতে পারেন। এদিকে নো ভোট টু বিজেপি স্লোগানধারী মঞ্চকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধন্যবাদ দেওয়ায় বামফ্রন্ট সমর্থকরা মঞ্চকে তৃণমূলের গোপন সহযোগী বলে চিহ্নিত করছেন। আরেকটা নতুন পরিস্থিতির উদয় হয়েছে তৃণমূলের বহু নেতাকে বিজেপি টিকিট দেওয়ায়। অনেক সিপিএম সমর্থকের বিজেপিকে ভোট দেওয়ার কারণ ছিল তারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়েছিল। তৃণমূলী প্রাক্তনীদের টিকিট দেওয়ায়, সেই বাম ভোটাররা বিজেপিকে পরিত্যাগ করতে পারেন এবার। 

বাঙালি বনাম অবাঙালি

তৃণমূলের বিজেপি বিরোধিতার অন্যতম যুক্তি বহিরাগত তত্ত্ব। তৃণমূল প্রমাণ করতে চাইছে, বিজেপি অবাঙালিদের দল। মমতা নিজেই বলেছেন বিজেপি গুজরাতিদের দল, অবশ্যই তাঁর লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ। তবে এই বাঙালি-অবাঙালি বিভাজন তৃণমূলের কাছে ব্যুমেরাং হতে পারে। কলকাতা, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও উত্তর দিনাজপুর, এই চার জেলায় অবাঙালি জনসংখ্যা ৩০ শতাংশ। 

তৃণমূলের সংগঠন

সংগঠন মানে এখন, এখানে পেশিশক্তি। বাম আমলেও তেমনটা ছিল না, তা নয়। কিন্তু তখন সে সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসত কম। এখন মিডিয়া বুমের যুগে সহজেই জানা যায় গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোটে কী হয়েছিল। ২০১৮ সালের সে ভোট বাংলার ইতিহাসে লজ্জাকর হয়ে থাকবে, যখন দেখা গেল ৩৪ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছেন প্রার্থীরা। অনেকেই মনে করেন, বিজেপির দরজা খুলে দিয়েছিল এই অভূতপূর্ব হিংসা। 

বিজেপির সংগঠনহীনতা

বিজেপির ভোট বেড়েছে, তারা বাংলায় রাজনৈতিক শক্তিও হয়ে উঠেছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু তা নেতিবাচক জায়গা থেকে, তৃণমূলের প্রতি ক্ষোভ থেকে। বিজেপির যে এ রাজ্যে কোনও সংগঠন নেই, তা স্পষ্ট। এই স্পষ্টতা আরও বোঝা যায় তাদের প্রার্থী তালিকা দেখলে। সে তালিকার বহু প্রার্থীই অন্য দল থেকে সদ্য যোগ দেওয়া, এমনকী অন্য দলের জনপ্রতিনিধিও বটে। 

রাজ্য ভোটে বিজেপির খারাপ ফলের ইতিহাস

২০১৯ সালের ভোটে বিধানসভাগুলিতে বিজেপি কত ভাল ফল করেছিল, সে অঙ্ক ধরে বিশ্লেষণ হচ্ছে বটে, কিন্তু মনে রাখতে হবে কেন্দ্রের ভোটে বিজেপি ভাল ফল করে এবং রাজ্যের ভোটে খারাপ ফল। এ একেবারে ইতিহাসস্বীকৃত। অন্য জায়গার কথা যদি ছেড়েও দেওয়া যায়, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে বিজেপি যে ফল করেছিল তার চেয়ে খারপ ফল করেছিল ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে। ফলে ২০১৯ সালের ভোটের হিসেব দেখিয়েই ২০২১ সালের ভোটে বিজেপির জয়ের সম্ভাবনার কথা ঘোষণা করা বাতুলতা হবে। 

 

YouTube video player