সংক্ষিপ্ত

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৭.০১ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। শতাংশের নিরিখে ভারতে চার নম্বর। বৃহত্তর আঙ্গিকে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়কে দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়, উর্দুভাষী ও বাংলাভাষী। শতাংশের হিসাবে উর্দুভাষীরা ৬-৭ শতাংশ। 

মেরুকরণের রাজনীতিতে এবার ভোট হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। বিজেপি যেখানে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ভোট এককাট্টা করে জয়ের পরিকল্পনা করছে, তৃণমূল কংগ্রেসের সেখানে অন্যতম ভরসা রাজ্যের  প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট। কিন্তু ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি প্রকাশ্যে তৃণমূলকে সমর্থন করলেও তার ভাইপো আব্বাস সিদ্দিকি আকা ভাইজান  ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ নামে একটি দল খুলে শাসকদলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। বিরোধী বাম ও কংগ্রেস জোটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংযুক্ত মোর্চা গড়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ছে আইএসএফ। এদিকে ‘দেব কি দেব না’ করে করে শেষবেলা রাজ্যের কিছু আসনে প্রার্থী দিয়েছে তেলঙ্গানার দল ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনি (এআইমআইএম) সংক্ষেপে মিম। বাংলায় ভোটের রাজনীতিতে মিমের তেমন প্রভাব না পড়লেও আব্বাসের নেতৃত্বে আইএসএফ-এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা তৃণমূল নেতৃত্বের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। তৃণমূলের অভিযোগ, মুসলিম ভোট ভাগ করে হিন্দুত্ববাদীর দল বিজেপিকে সুবিধা করে দিচ্ছে আব্বাস। অন্যদিকে ‘কোনও ফুলেই হাত না দেওয়ার’ ডাক দিয়ে আব্বাসের দাবি, বাংলায় বিজেপিকে ঢোকার পথ করে দিয়েছে তৃণমূল। গত দশ বছরে মুসলিমদের উন্নয়নে কোনও কাজ করেনি শাসকদল। 
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৭.০১ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। শতাংশের নিরিখে ভারতে চার নম্বর। বৃহত্তর আঙ্গিকে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়কে দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়, উর্দুভাষী ও বাংলাভাষী। শতাংশের হিসাবে উর্দুভাষীরা ৬-৭ শতাংশ। এরা কেউ বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে তো কেউ পাঞ্জাব, রাজস্থান থেকে এসেছে। এমনকী পাকিস্তান, আফগানিস্তানেও কারও কারও পূর্বপুরুষের বাস ছিল।  প্রভাব প্রতিপত্তি ও আর্থিক সঙ্গতির দিক দিয়ে এদের অবস্থান তুলনায় উঁচু। মূলত শহরাঞ্চল এলাকায় বসবাস। শিয়া-সুন্নী ছাড়াও এই শ্রেণির মধ্যে বেশ কিছু ভাগ রয়েছে। যেমন ইমাম, মৌলবীদের বংশ সৈয়দ। টিপু সুলতান, নাখোদা মসজিদের ইমামরা এই শ্রেণিতে পড়েন।  ফল ও শাল বিক্রেতারা পাশতুন বা কালাল। এই সব ছাড়া মুসলিমদের বড় একটা অংশ বাংলাভাষী। সংখ্যায় এরা অনেক বেশি। গ্রামবাংলার বাসিন্দা। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকার বেশিরভাগের আদি বাসস্থান বাংলাদেশে। আব্বাস সিদ্দিকির জনপ্রিয়তা বেশি এই বাংলাভাষীদের মধ্যে। উর্দুভাষী মুসলিমদের দলে টানতে একটা সময় মিম-এর সঙ্গে জোট করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন আব্বাস। প্রসঙ্গত, প্রতিবেশি বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে ৫টি আসন জয়ের পর বাংলার ভোটে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন এআইমআইএম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি। সেই ঘোষণার পর ধীরগতিতে সাংগঠনিক কাজ শুরু করেন বাংলার মিম নেতারা। বছরের শুরুতে ফুরফুরা শরিফে এসে ওয়াইসি বৈঠক করে নির্বাচনী সমঝোতার কথা বলে যান আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে। কিন্তু শেষমেশ আব্বাস মিমকে ছেড়ে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেধেছেন। এদিকে, উচ্চ নেতৃত্বের কাছ থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে মিমের বেশ কিছু নেতা আইএসএফ-এ যোগ দেন। দলে ভাঙন ধরছে দেখে ওয়াইসি নিজে বাংলায় এসে ১৩টি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে যান। 
প্রসঙ্গত, সংখ্যালঘুরা মূলত দু'টি বিষয়কে মাথায় রেখে কোনও দলকে সমর্থন বা বর্জন করে। এক, তাদের সম্প্রদায়ের পরিচয়সত্তা রক্ষায় কোন দল কতটা আন্তরিক,  দুই,  তাদের উন্নয়নে কতটা কাজ করছে ওই দল।  এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিমদের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন তাঁর শাসনকালে। কখনও যা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত বলে সমালোচনাও হয়েছে। যেমন,  ইমামদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা, ইফতার পার্টি, এমনকী মহরমের জন্য দুর্গাপুজোর শোভাযাত্রা পিছিয়ে দেওয়া।  বিরোধীদের অভিযোগ, ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে সংখ্যালঘু তোষণ করছেন মমতা। কারণ যা-ই হোক না কেন, মমতা বা তৃণমূলের কাছ থেকে কোনও ‘থ্রেট’ পায়নি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তৃণমূল আমলে এই রাজ্যে তাদের জীবনযাত্রার গুণগত মানেরও উন্নতি হয়েছে। বামশাসনের শেষ বছর ২০১০-১১ সালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুদের স্কুলে ভর্তির সংখ্যা যেখানে ১০০ পিছু ৫০ ছিল,  ২০১৭-১৮ সালের এক ক্ষেত্রসমীক্ষার হিসাব অনুযায়ী তা হয়েছে ৯৮ জন। যদিও এক্ষেত্রে সর্বশিক্ষা অভিযানই মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছে। ২০১১-র জনগণনা অনুসারে রাজ্যের প্রতি ১০০ জন সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে ৫৯ জন স্বাক্ষর ছিলেন। ২০১৭-১৮ সালের ক্ষেত্রসমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তা বেড়ে হয়েছে ৭১ শতাংশ। বামফ্রন্টের শেষ বছর স্নাতক স্তরে রাজ্যে মাত্র ৪.৫০ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পড়ুয়া ছিল। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে তা বেড়ে হয়েছে ২২ শতাংশ। এক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার তৃণমূল ক্ষমতায় এসে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওবিসি-দের জন্য যে ১৭ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, তার মধ্যে ওবিসি-এ শ্রেণির সংখ্যালঘুদের জন্য ১০ শতাংশ রয়েছে। সংরক্ষণের এই সুবিধার জন্যই সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘুদের হার ২.৪০ থেকে বেড়ে ৬.৭৮ শতাংশ হয়েছে। 
স্বাভাবিক ভাবেই উন্নয়নের জন্য, বিশেষ করে সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের প্রশ্নে গত কয়েকটা ভোটে তৃণমূলের প্রতি সমর্থনের ঝুলি ভরিয়ে দিয়েছে সংখ্যালঘুরা। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে এই রাজ্যের ১২৫টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কেন্দ্রের মধ্যে ৯১টিতে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট। ২০১৬ সালের ভোটে একা তৃণমূলই এই ১২৫টির মধ্যে ৮৫টি পেয়েছিল। সেবার বাম-কংগ্রেস জোট বেধেও সুবিধা করতে পারেনি। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে মুর্শিদাবাদ সমেত উত্তরবঙ্গের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ৪৬টি বিধানসভা কেন্দ্রে বাম ও কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৮.৪২ শতাংশ। তৃণমূল এই কেন্দ্রগুলিতে প্রায় ১০ ভোট বাড়িয়ে ৩৪ শতাংশের মতে ভোট পেয়েছিল। অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ৭৯টি কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৯.৫০ শতাংশ। যেখানে বাম- কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ৩৮.৬৫ শতাংশ। বিজেপি ওই কেন্দ্রগুলিতে মাত্র ৮.৭৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে রাজ্যের ১৩০টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিধানসভা  কেন্দ্রে তৃণমূল একাই ৪৬.৯০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৯৮টি কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল। বিজেপি ৩৩.৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ওই ১৩০টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৪টিতে এগিয়ে রয়েছে। কংগ্রেস ১০.০৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৮টি আসনে এগিয়ে ছিল। 
এই প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট নিয়ন্ত্রণে বিজেপি দু’টো বিপরীতমুখী কৌশল নিয়েছে। প্রথমত, হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করে মুসলিম অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলিতে জয়ের অঙ্ক কষছে তারা। দ্বিতীয় কৌশলটি হল, হিন্দুত্ববাদের চেয়েও বাংলার উন্নয়নের বিষয়টিকে ভোটের মূল ইস্যু করা। বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, সংখ্যালঘুদের একজন হয়ে ওঠার জন্য যতটা চেষ্টা করছেন মমতা, তাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ততটা করেননি। সাচার কমিটির অনেক সুপারিশ কার্যকরী হয়নি এখনও।
উন্নয়নের প্রশ্নে শাসকদল তৃণমূলকে বিঁধে এক সারিতে অস্ত্র শানাচ্ছে আইএসএফ ও বিজেপি। অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে অনেক বেশি ‘নিরাপদ’ তৃণমূলকে ভোট দেওয়া নিয়ে তাই দোলাচলে পড়েছে সংখ্যালঘুরা।