সংক্ষিপ্ত

নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করছেন মমতা

সত্যিই কি নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক সংস্থাটির এই অবস্থা

তাহলে তো ভেঙে পড়বে গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাই

নাকি প্রশ্ন তুলে রাজ্যজুড়ে অরাজকতা ডেকে আনতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

কঠিন পরীক্ষার মুখে ভারতের নির্বাচন কমিশন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। ভোট ঘোষণার দিন থেকেই বিজেপির কথায় কমিশন চলছে, বলে দাবি করে আসছিল তৃণমূল কংগ্রেস। উস্কানিমূলক মন্তব্য করার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচার ২৪ ঘন্টার জন্য নিষিদ্ধ করার পর, এবার সরাসরি কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ধর্নায় বসলেন মমতা। কিন্তু, সত্য়িই কি এই সিদ্ধান্তের জন্য, নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়? সেই ক্ষেত্রে তো ভেঙে পড়বে গোটা ব্যবস্থাই। নাকি শুধুই বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করছেন তৃণমূল নেত্রী?  

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কমিশন শাস্তি দিয়েছে জনসভার মঞ্চ থেকে করা তাঁর দুটি মন্তব্যের জেরে। প্রথম, মুসলিম সম্প্রদায়কে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান করা। অপর মন্তব্যে তিনি জনগণকে ভোট দিতে বাধা দিলে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন এর প্রেক্ষিতে মমতাকে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করতে বলেছিল। তা করতে পারেননি বলেই, তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছে।

এই প্রথম কোনও রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীর প্রচার সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করল নির্বাচন কমিশন, তা কিন্তু নয়। এর আগে বহুবার দেখা গিয়েছে, নির্বাচন কমিশন সাধারণত hate speech অর্থাৎ বিদ্বেষমূলক বাচনের জন্যই কোনও ব্যক্তির প্রচার নিষিদ্ধ করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক বিদ্বেষ-বাচন নয়। তবে তাঁর প্রথম মন্তব্য যে স্পষ্ট সাম্প্রদায়িক আহ্বান, তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না। আর কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করার হুমকি দিলে যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কী মারাত্মক অবস্থা হতে পারে, তা শীতলকুচির ঘটনাতেই প্রমাণিত। অবশ্য, সেখানে ঠিক কী ঘটেছিল, তা প্রশ্নাতীত নয়।

সাম্প্রতিককালে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের প্রচারও নিষিদ্ধ করেছিল নির্বাচন কমিশন। তিনি বলেছিলেন ওদের আলি থাকলে আমাদেরও বজরঙ্গবলী রয়েছেন। সেই সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক মন্তব্যের জেরে তাঁর প্রচার নিষিদ্ধ হয়েছিল ৭২ ঘন্টা। একইভাবে মুসলিম ভোটারদের উদ্দেশ্য করে কংগ্রেসকে ভোট না দেওয়ার আবেদন করার জন্য ৪৮ ঘন্টা নিষিদ্ধ হয়েছিল বসপা নেত্রী মায়াবতীরও। জয়া প্রদা সম্পর্কে আপত্তিজনক মন্তব্য করায় ৭২ ঘন্টা প্রচার নিষিদ্ধ হয়েছিল সপা নেতা  নেতা আজম খানের, মুসলমানদের আলাদা করে ভোট দেওয়ার আবেদন করার জন্য  ৪৮ ঘন্টা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বিজেপি নেত্রী মানেকা গান্ধীর প্রচারও। বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুরের প্রচারও ৭২ ঘন্টা নিষিদ্ধ ছিল। আরও কাছের সময়ে, ২০২০ সালের দিল্লি নির্বাচনের সময় বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর এবং পরবেশ ভার্মার প্রচার যথাক্রমে ৭২ ঘন্টা এবং ৯৬  ঘন্টা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

এমনকী, চলতি ৫ রাজ্যের নির্বাচনেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই শুধু নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা নয়। তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী এডাপাদ্দি পলানিস্বামী সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করায় দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজঘাম বা ডিএমকে দলের নেতা ডি রাজাকে ৪৮ ঘন্টা প্রচার থেকে বিরত করা হয়েছে। অসমে বিজেপির বিদায়ী মন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার প্রচারও ৪৮ ঘন্টার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, উস্কানিমূলক মন্তব্যের জন্যই। পরে অবশ্য শাস্তি কমিয়ে ২৪ ঘন্টা করা হয়। কারণ, সেই ক্ষেত্রে মন্তব্যের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়েছিলেন হিমন্তবিশ্ব।

"

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু, ক্ষমা চাওয়ার ধারকাছ দিয়েও যাচ্ছেন না। উল্টে কেন্দ্রীয় বাহিনীর পর তিনি নিশানা করেছেন নির্বাচন কমিশনকেই। ধর্নায় বসছেন তিনি, তাঁর দলের নেতারা এই সিদ্ধান্ত্রের প্রেক্ষিতে ১২ এপ্রিল ২০২১ দিনটিকে বলছেন 'গণতন্ত্রের কালো দিন'। অবাক লাগছে, দিন দুই আগেই ভোট দিতে গিয়ে ৫ নাগরিকের মৃত্যু হওয়ার দিন তাঁদের কাউকে বলতে শোনা যায়নি, এটা গণতন্ত্রের কালো দিন। তাঁরা অভিযোগ করেছিলেন বিদেপি নেতারাও উস্কানি দিচ্ছেন, তাঁদের কিছু বলছে না কমিশন। 'মিনি পাকিস্তান' মন্তব্য করা শুভেন্দু অধিকারীকেও কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। মমতার মতো 'বেশ করেছি' মনোভাব না নিয়ে তিনি জবাব দিয়েছেন। শীতলকুচিতে ৪-এর বদলে ৮টি মৃতদেহ চাওয়া রাহুল সিনহাকেও ৭২ ঘন্টার জন্য প্রচার থেকে বিরত করা হয়েছে। কাজেই সেই অভিযোগও ধোপে টেকে না।    

আরও পড়ুন - ধর্নায় বসেই মমতার হাতে রঙ-তুলি-ক্যানভাস - কী ছবি আঁকলেন মুখ্যমন্ত্রী, দেখুন

আরও পড়ুন - বিজেপি এলে CAA হবেই, কিন্তু NRC-র কথা তুলছে কেন তৃণমূল - গেরুয়া শিবিরের কী পরিকল্পনা

আরও পড়ুন - কাকে ভোট দেবেন, কোন 'বন্ধু' মমতার প্রিয়তম - ধন্দে পাহাড়ের তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা

ভারতবর্ষ একটা গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক বাছা হয়, বন্দুকের নলে নয়। নির্বাচন পরিচালনার জন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আছে, যা হল নির্বাচন কমিশন। আর আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজে রাজ্য প্রশাসনকে সহায়তা করতে আসে কেন্দ্রীয় বাহিনী। এটাই ব্যবস্থা। মমতা প্রথমে আক্রমণ করলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। যার প্রেক্ষিতে বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে মানুষের মনে। এবার তিনি প্রশ্ন তুলছেন কমিশনকে নিয়েও। একই বিভ্রান্তি মানুষের মনে ছড়াচ্ছে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকেও। এর ফল কিন্তু মারাত্বক হতে পারে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর পর আক্রান্ত হতে পারে কমিশনের সদস্য-কর্মীরাও। ভেঙে পড়তে পারে পুরো ব্যবস্থাটাই। তৈরি হতে পারে অরাজকতা। সেইক্ষেত্রে বোমা-গুলি যাদের বেশি, তারাই দখল করবে নির্বাচন। সেটাই কি চাইছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী?

YouTube video player