সংক্ষিপ্ত
সারা বছর রেডিওর খোঁজ না পড়লেও মহালয়ার দিন কয়েক আগে থেকেই তা ঝাড়া মোছা শুরু হয়। পুরোনো ব্যাটারি পাল্টে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে ঝালিয়েও নেন বেশ কয়েকবার।
বছর ঘুরে খোঁজ পড়েছে তার। ধুলো ঝেড়ে স্টোররুম থেকে বের করে আনা হয়েছে তাকে। বুধবার মহালয়া (Mahalaya) যে। মহালয়ার আগে নস্টালজিয়ায় ভাসছে মুর্শিদাবাদ (Murshidabad)। বেতার বাণী শোনার আগ্রহে উত্তর থেকে দক্ষিণ রেডিও (Radio) সারাইয়ের হিড়িকে বেসামাল অবস্থা।দেবীপক্ষের শুরু হতে আর মাত্র কিছু মুহূর্ত বাকি। আর সেই দেবীপক্ষের আগমনকে মহালয়ার আগে স্মরণীয় করে রাখতে নস্টালজিয়ায় মঙ্গলবার দিনভর ভেসে উঠছে মুর্শিদাবাদের উত্তর থেকে দক্ষিণ। সারা বছর যারা ভুলেও পা দেন না, তারাও এদিন রেডিও সারাইয়ে দোকানে লাইন দিয়েছেন।
কেউ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন পাড়ার মোড়ের রেডিওর দোকানে। এমনকি কেউ কেউ আবার সটান রেডিও মেকানিককে বেশি টাকার টোপ দিয়ে বাড়ীতে ডাকতেও ছাড়লেন না পুরোনো অচল রেডিও সারাই করার জন্য। তবে তাতে শেষ পর্যন্ত লাভ হয়নি কিছুই। নবাব নগরী লালবাগের আস্তাবল মোড় থেকে শুরু করে সদর বহরমপুর শহরের জনবহুল এলাকা কাদাই মোড়, খাগড়া, গোড়াবাজার, নিমতলা, স্বর্ণময়ী সর্বত্র ছবিটা একই।
এমনকি প্রত্যন্ত এলাকা কান্দি থেকে থেকে শুরু করে সামসেরগঞ্জ, লালগোলা মিলে মিশে একাকার। আর এই সুযোগে দম ফেলার ফুরসৎ নেই রেডিও দোকানের মালিকের। ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটসআপ, টিভি মোবাইলের রমরমায় রেডিও তার গুরুত্ব হারিয়েছে বহুদিন। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই রেডিও সেটটিকে অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় সারাবছর। সেই রেডিওর চাহিদা বাড়ে বছরের এই একটি দিনেই। আর সেই দিনটি হল মহালয়া।
মহালয়া নিয়ে বাঙালির আবেগ সম্পূর্ণ আলাদা। তাই টিভিতে বা মোবাইলে মহিষাসুরমর্দিনী দেখে বা শুনে মন ভরে না আপামর বাঙালির। পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনার ভোরে ঠিক ৪ টায় রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ গলায় সংস্কৃত স্তোত্রপাঠ ও তাঁর কণ্ঠে শোনা দেবীর আগমনী বার্তা না শুনলে যেন মনেই হয় না দুর্গাপুজো আসছে। তাঁর গলার মহালয়া সমগ্র বাংলার মানুষকে এক সুতোয় বেঁধে দেয়। তাই মহালয়ার আগের দিন বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকা রেডিও সেটটিকে চাঙ্গা করে নেওয়ার তোড়জোড় লক্ষ্য করা যায়।
তাই সকলেই লাইনে দাঁড়িয়ে মহালয়ার আগে নিজের বাড়ীর অচল রেডিওটি সারিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকেই তাড়া দিতে দেখা যায় রেডিও মেকানিকদের ধরে ধরেই। নতুন যুগের রেডিও যেমন আসছে সারাইয়ের জন্য, তেমনই বহু পুরনো দিনের রেডিওর মডেল সারাই করতে নিয়ে আসেন বহু মানুষ। তার মধ্যে কিছু রেডিওর বয়স প্রায় ৬০-৭০ বছরেরও উপরে।
কান্দির বাসিন্দা স্বপন ভট্টাচার্য বলেন,‘‘রেডিও চালানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছু শোনা যেত না। তাই ঘড়িতে চারটে বাজার আগে থেকেই রেডিও চালিয়ে দেওয়া হত। খানিকক্ষণ কোঁ শব্দের পরেই ঘোষণা হত ‘এখন আপনারা শুনছেন আকাশবাণী কলকাতা’। শঙ্খধ্বনির সঙ্গে শুরু হয়ে যেত আমাদের দুর্গা পূজা। তিনি জানান, ‘‘পাড়ার আর চার পাঁচটা বাড়ি থেকেও ভেসে আসত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মন্ত্রমুগ্ধ করা চণ্ডীপাঠ। কিন্তু এখন সে সব দিন আর কোথায়, আগের মতো সময় বেঁধে শহরাঞ্চলের এখন খুব কম বাড়িতেই শোনা যায় মহিষাসুরমর্দিনী । অনুষ্ঠান শোনার জন্য রেডিওর বদলে ব্যবহার করা হয় মোবাইল ফোন অথবা এমপিথ্রি প্লেয়ার"।
কিন্তু প্রৌঢ়রা এখনও সেই প্রথা ভাঙেননি। সারা বছর রেডিওর খোঁজ না পড়লেও মহালয়ার দিন কয়েক আগে থেকেই তা ঝাড়া মোছা শুরু হয়। পুরোনো ব্যাটারি পাল্টে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে ঝালিয়েও নেন বেশ কয়েকবার। তাদের মতে, ইন্টারনেট বলুন আর সিডি ডিভিডি-ই বলুন, মহালয়ার ভোরের আগে আকাশবাণীতে উদাক্ত কন্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনার দমবন্ধ করা উৎকণ্ঠা আর কোথাও নেই। তাই যত রাতই হোক না কেন রেডিও সারিয়েই বাড়ী ফিরব"।