সংক্ষিপ্ত
চলে গেলেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। দেখুন লেখককে লেখা শেষ চিঠিতে এক পাঠক কী লিখছেন।
প্রিয় লালাবাবু ,
এর আগে আপনাকে আমি একটা মাত্র চিঠি লিখেছিলাম। আপনাকে লেখা সেই চিঠিটা বহুদিন আমার ব্যাগবন্দী ছিল তারপর কখন জানি ব্যাগ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল,সম্ভবত উত্তরবঙ্গে বদলি হওয়ার সময়ে। অথচ আপনাকে আমি দেখেছি আর অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়ে। তখন আমার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ,তাই হাজরা মোড়ের ভবানীপুর টিউটোরিয়াল হোমে মক টেস্ট দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ময়দানের বইমেলায় প্রথম দেখা। আপনি বিকেলের মায়াময় রোদ্দুর মেখে হাসিমুখে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন। এমন ভুবনভুলানো হাসি আমি শুধু উত্তমকুমারকেই হাসতে দেখেছিলাম, টিভির পর্দায় কিংবা রুপোলি পর্দায়। তাই ময়দানের বইমেলায় বিমুগধ চোখে আপনাকে দেখছিলাম। কেমন এক ঘোরলেগেছিল আমার দুই নয়নে। একজন সাহিত্যিকের এত্ত ফ্যান থাকতে পারে ! যাঁরা রোদ্দুর ও ভীড় উপেক্ষা করতে পারেন ! লম্বা ও সর্পিল একসারি মানুষের প্রান্তে মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন অপূর্ব এক আভিজাত্য নিয়ে। প্রত্যেককে তাঁদের নাম এবং কি করা হয় জিগ্যেস করছিলেন,তারপর নতুন কেনা বই কিংবা তাঁদের অটোগ্রাফ খাতায় সুন্দরভাবে লিখে দিচ্ছিলেন দুচার কথা ,আশীর্বাদ বাণী এবং অবশ্যই ছবির মত সুন্দর স্বাক্ষর। সুবেশা এক তন্বী তরুণী নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বলায় আপনি বললেন,"আমি এক অশিক্ষিত সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়া কিংবা লেখা হয়নি।"
কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়লে তবেই সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় তা সত্যি হলে এই পৃথিবীর অধিকাংশ কবি বা লেখক লেখক হয়ে উঠতেন না তা আপনি ভালো করেই জানতেন। তবুও এইটুকু বলে হয়তো তৃপ্তি পেতেন। আমি আপনার ফ্যান হয়ে গেলাম। ডাক্তার হতে পারলাম না। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েও পড়তে না গিয়ে এবার কলকাতায় এলাম সাহিত্য পড়তে। আরেক বিখ্যাত গুহ স্যারের তত্ববধানে ইংরেজি সাহিত্য পড়লেও আপনাকে পড়ি বেশি। সন্তোষপুরে অরবিন্দ রোডের মেস বাড়িতে থাকি তখন,পাড়ার লাইব্রেরিতে থাকা আপনার সবগুলো বই পড়লাম। টুকটাক বই কিনি ,পড়ি আর রেফারেন্স বইয়ের খোঁজে উঠে বসি ওয়ান এ কিংবা এস ডি সিক্সটিন বাসে। ন্যাশনাল লাইব্রেরির মোটা থামের বিল্ডিংয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস বিষয়ক বই খুঁজতে গিয়ে সেসবের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার ফাঁকে পড়ি লবঙ্গীর জঙ্গলে, জঙ্গলের জার্নাল। আপনার প্রেমে পড়ে গেলাম। বিভুতিভূষণকে ভালোবাসতাম , প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশে মজেছিলাম। মাধ্যমিকের আগে শরৎচন্দ্র এবং উচ্চমাধ্যমিকের পড়ার সময়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সব লেখা পড়ে না বুঝলেও আপনার লেখা পড়ে অপার আনন্দ পেলাম।
গ্রামীণ নবকুমার শহুরে কিন্তু চিরন্তন এক বাঙালি লেখককে পেলাম যিনি প্রকৃতির লেখায় , প্রাকৃতিক রহস্যে মজিয়ে রাখেন। কিশোর কাহিনী এবং বড়দের লেখাতে। অনেকেই প্রকৃতির মাঝে ফিরতে বলেছিলেন। রোম্যান্টিক আন্দোলনের সারবত্তা তো ওই অকৃত্রিম প্রকাশ ও স্বাভাবিকতা। আপনি আমার চোখে একজন জন্ম রোমান্টিক লেখক যিনি পাঠককে ভরিয়ে রাখেন। ভাবাতে থাকেন কিন্তু চিন্তাক্লিষ্ট করেননা। জঙ্গল ,নারী ও প্রকৃতির রহস্যের পাশাপাশি রহস্য রোমাঞ্চ ইত্যাদি বিষয়ে উৎসুক করে রাখেন অগণিত পাঠককে। জীবনের প্রতিটি বাঁককে দেখেন অন্যচোখে। আপনি জীবনকে ভালোবাসতে শেখালেন। ছ্যাবলামি নয় প্রেমে পড়ালেন। রবীন্দ্রনাথ , বিভূতিভূষণ ,তারাশঙ্করের লেখা ভালোবাসলেও তাঁদের খুব কাছের মনে হত না ,তাদের আমি চোখেও দেখিনি কিন্তু আপনি আমাদের আটপৌড়ে জীবনের কাহিনী লিখলেন অভিজাত দৃষ্টিতে জীবনকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে পরখ করতে। আপনি ব্রাত্যজনের সখা হলেন। একক এক প্রতিষ্ঠান। দরাজ গলায় গান গাইলেন ,পুরাতনী , টপ্পা এবং রবীন্দ্রগান। আপনাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় ! তবুও মধ্যমেধার কালি ছেটানো অভিযান চলছে। সবই দেখছি । এসব ভালো লাগেনা। আপনি ছবি আঁকছেন ,সময়ের ছবি। সে এক অনবদ্য দলিল। আপনি সুনীল নন ,শক্তি নন ,নন নারায়ণ সান্যাল। তাঁরা তাদের মত ভালো, আপনি আপনার মত ভালো। বিভাজনের রাস্তায় নেই। লালা মিঞার শায়েরিতে মনের কথা ঢের বলেছেন। হ্যাঁ , উর্দু কবিতা বা শায়রীর প্রতি ভালোবাসা আনার ক্ষেত্রে আপনাকে এবং পদাতিকের সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ভুলি কি করে ? এত অজস্র সার্থক রেফারেন্স লেখায় লেখায়। নিত্যদিন নতুন করে আবিষ্কার করি। নতুন করে প্রেমে পড়ি। জীবনের প্রেমে পড়ি।
কে বলবে আপনি একজন চ্যাটার্ড একাউন্ট্যান্ট! বরং একজন শিকারী বললেই ভালো হত কিংবা একজন ট্রাভেলার,এমন এক যাত্রী যার যাত্রাপথ সুবিস্তৃত।জীবনের ব্যালান্স শিট মেলেনা বোধ হয়। অথচ সারা জীবন তাইই পরীক্ষা করে এসেছেন। জীবনের শেষ লগ্নে এসে আপনাকে তাই পৃথু ঘোষেরই মত লাগে। মাধুকরীর পৃথু ঘোষ। পিরথু বাবা। এত মানুষের ভীড়েও আপনি নিঃসঙ্গ। ওয়াল্ট হুইটম্যানেই কবিতা বড় প্রিয় ছিল আপনার। ছিল লিখতে হচ্ছে কারন আপনি এখন না ফেরার দেশে চলে গেলেন এই পঁচাশি বছরের ভরা যৌবনে। আসলে বুদ্ধদেব গুহ চিরযুবক ঋজুদা। আপনার প্রায় সমসাময়িক অতীন বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময়ে আমার বিপরীত মনে হয়েছিল। মার্জনা করবেন এই তুলনা আনছি না কিন্তু আপনার উষ্ণতায় স্নিগধ ও মুগদ্ধতায় অতীনবাবুর লেখার মোহাচ্ছন্ন পাঠক হলেও তাকে তাঁর লেখার সঙ্গে মেলাতে পারিনি। কিন্তু আপনি আপনার লেখার মতই সদা চঞ্চল প্রাণবন্ত।
আপনি বলতেন," সারা জীবনে আমরা একটা লেখাই লিখি। নিজেকে নেগেট করি। বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে আমরা লেখকরা, আমরা কবি সাহিত্যিকরা আমাদের অমিকে প্রকাশ করি। ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাষায় এই ধরনের দক্ষতাই নেগেটিভ ক্যাপাবিলিটি। নিজেকে নেগেট করতে হবে,প্রকাশ করতে হবে। এটাই একজন সাহিত্যিকের প্রথম শর্ত।" দ্বিতীয়ত কপটতা তঞ্চকতা বা শঠতা একজন লেখক বা সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে শোভা পায়না। আপনার মুড সুইং সেই অকপটার প্রমান তা পেয়েছি। আপনি সেবার বিশ্বভারতীর এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। আগে থেকেই কথা হয়েছিল আমি দেখা করতে যাব। তখন আমি সিউড়িতে থাকতাম। বোলপুরে পৌঁছাতে আমার একটু দেরী হয়েছিল। কৃষ্ণনগর থেকে গিয়েছিল রঞ্জন ,ভদ্রেশ্বর থেকে শংকর এবং যথারীতি সুমন গোসাঁই এসেছিল। আপনি আমাকে আপনার বাড়ি 'রবিবার'-এ ঢুকতে দেননি। দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম আমি ও শংকর। দীর্ঘক্ষণ গাড়িতে বসে অপেক্ষার কথা শুনে আপনার এক ভক্ত তথা বীরভূমের তখনকার এডিএফও সাহেব খুলে দিয়েছিলেন বল্লভপুরের নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারের রেস্ট হাউস। শঙ্কর থেকে গেল সেখানে আমি রাত্রে ফিরে গিয়েছিলাম সিউড়ির সরকারি আবাসনে। অথচ কি সমাদরে তার কিছুদিন আগে এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। উপহার দিয়েছিলেন আপনার উপন্যাস 'অভিলাষ'। পরবর্তীতে সুমনকে দিয়ে 'জলতরঙ্গ' পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন - ১২ ঘন্টা পরও নেই মমতার শোকবার্তা, কেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে শেষ দিনও ব্রাত্য বুদ্ধদেব গুহ
আরও পড়ুন - 'মধ্যবিত্ত জীবন থেকে তাঁর সাহিত্যের ভুবন কিছুটা দূরেই' - কবির চোখে বুদ্ধদেব গুহ
আরও পড়ুন - 'মুহূর্তরা মুহুর্তের কাছে ঋণী', সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ-র মৃত্যুতে স্মৃতির শহরে ঋত্বিক
অথচ, সম্পূর্ণ এক ভিন্ন কারনে আমি আপনার 'কোজাগর' পড়ে প্রাণিত হয়েছিলাম। ছাত্রজীবনের শেষের দিকে। অনেকেই বাতুলতা বলবেন কিন্তু পরবর্তীকালে ভি এস নইপালের ম্যাজিক সিড্স পড়ার সময় প্রায় একই রকম ফ্লেভার পেয়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে ক্লাস টুয়েলভের আউট গোয়িং ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার পর ছুটিতে কি বই পড়ব জানতে এলে তাঁদের অবশ্যপাঠ্য হিসাবে এই 'কোজাগর' বইটার কথা বলতাম। অনেকেই পড়ত। পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাতো। ভালো লাগতো। অথচ আপনার সেরা লেখার তালিকায় আসবে 'হলুদ বসন্ত' ,'নগ্ন নির্জন', 'মাধুকরী ' ইত্যাদি নানা লেখা । আমি জানি আমি আপনার অন্ধভক্ত নই ,কারন আমি একজন লেখককে দেবতার আসনে বসাতে পারিনা। আমার কাছে আপনি মহাকবি বাল্মীকি কিংবা কালিদাসের মত চরিত্র ও কাহিনী রচয়িতা। আপনিও আমার কাছে রক্তে-মাংসে একজন আস্ত মানুষ যার জীবনে ওঠা-পড়া আছে,আছে ভাঙা গড়া ,সফলতা ব্যর্থতা। আপনার জীবন একঘেয়ে ঝিঝিপোকার ডাকের নয় কিংবা মাদলের ঘুম জড়ানো মন্দ্র গম্ভীর ছন্দের বরং সেখানে দোয়েলপাখির ডাক আছে , নিস্তরঙ্গ দুপুরে ঘুঘুপাখির আদুরে আলাপ আছে, মাঝরাতে রাতমোহনায় নাইটজার কিংবা ডাহুকের কুহক ডাক আছে। আপনি ঈশ্বর নন। আপনি অসংখ্য পাঠক -পাঠিকা হৃদয়ের ধুকপুকানি কবুতর।
'একটু উষ্ণতার জন্যে' দিয়ে শুরু করে ছিলাম আপনার বড়দের কাহিনী। প্রেমিকাকে দেওয়া প্রথম বইও 'একটু উষ্ণতার জন্যে'। 'চান ঘরে গান' পড়ে চিঠি লেখা শিখেছিলাম। পত্রমিতালীর সৌকর্যের পাঠ ছিল সেই সব লেখা। 'সবিনয় নিবেদন'-এ যেন তার পূর্ণতা।প্রেমে কিভাবে পড়তে হয় তার জন্যে কোন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নেই কিন্তু প্রেমে পড়লে যে টের পাওয়া যায় তা জেনেছি আপনার লেখা পড়ে । শুনুন মশাই আপনার জন্যই গড়িয়াহাট হন্যে হয়ে ওডিকোলন খুঁজেছি প্রবল গ্রীষ্মকালে শীতল হব বলে। চিকুর চ্যাটার্জির অদ্ভুত প্রেম দেখে অবাক হয়েছিলাম আর এখন আমার মেয়েকে বাংলা গল্প -কাহিনীর স্বাদ দিতে অন্য অনেক লেখার সঙ্গে পরিচিত করতে আপনার ঋজুদার কাহিনী শোনাই। এও এক যাত্রা। আপনি আমাদের মধ্যেই থাকবেন। নিশ্চয়ই থাকবেন যেমন আছেন ঋতু গুহ। গানে গানে। আপনি থাকবেন শরতের মেঘ হয়ে , শিউলি ফুলের সুবাসে। বসন্তের কুর্চিবনে। মাছের কানকো ধোয়া কুসুম বনে। কাল বৈশাখীর দিনে দেখা হয়ে যাবে কোয়েলের কাছে। এরকম প্রতি ঋতুতে ,মন খারাপে, মন ভালোতে আপনাকে খুঁজবো আপনার লেখায়, মনে মনে। আপনার সঙ্গে লবঙ্গীর জঙ্গলে আবারো ঝাঁকি দর্শন হয়ে যাবে। সেদিন হয়ত তারাপদ দাও সঙ্গে থাকবেন। সঙ্গে থাকবেন দেবজ্যোতি ও আরো অনেকেই। আফসোস একটাই 'ঋতি কুসুম'-এর পাণ্ডুলিপি আপনাকে দেখতে পারলাম না। চুপিচুপি বলি ওই লেখা কিন্তু আপনাকেই সমর্পিত। যেখানেই যান না কেন তিতির রুদ্র ভটকাই আপনার সঙ্গ ছাড়বে না। ভাল থাকবেন লালাবাবু। আজ আর প্রণাম ফেরাবেন না। নবকুমারের শ্রদ্ধা তো নেবেন। ভালো থাকুন চিরশান্তির দেশে।
বিনীত
নবকুমার দাস