সংক্ষিপ্ত
ত্রিবেণী ঘাটের এক কিলোমিটারের মধ্যে দুটি প্রধান রাস্তার সংযোগস্থলের পাশেই জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে রয়েছে এই ডাকাত কালীর মন্দির। বাসুদেবপুরের দুই কুখ্যাত ডাকাত রঘু ডাকাত আর বুধো ডাকাতের আরাধ্যা দক্ষিণা কালী মন্দিরটি গম্বুজাকার, এক চূড়াবিশিষ্ট, এবং সামনে বিশাল চাতাল রয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে (Sriramkrishna Paramhangsa Dev) হুগলিতে দেখতে যাওয়ার সময় একবার সারদামা পড়েছিলেন ডাকাতদের ক্ষপ্পরে। রঘু ডাকাতের দল রামপ্রসাদকে ধরে বলি দিতে উদ্যত হয়েছিল তারপর শ্যামা-সঙ্গীত শুনিয়ে নাক বেঁচেছিলেন রামপ্রসাদ। কোথাও বা ল্যাটা মাছ পোড়া মাকে অর্পণ করে ডাকাতিতে বের হত ডাকাতরা তো কোথাও আবার চিঠি লিখে ডাকাতি করতে যেত ডাকাতদল। রঘু ডাকাত, বিশে ডাকাত, কেলে ডাকাত ও তাদের কালীপুজোর (Kalipuja) কিছু রোহমর্ষক গল্প শোনাচ্ছেন - অনিরুদ্ধ সরকার
গগন ডাকাতের কালীপুজোর গল্প:
হুগলির সিঙ্গুরে গগন ডাকাতের (Gagan dacoit)কালীকে সবাই একডাকে চেনে । এই মন্দির প্রতিষ্ঠা ঘিরে বিভিন্ন কাাহিনি প্রচলিত। শোনা যায়,স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসকদের বিরোধিতা করতে বহু জমিদার বাড়িতেই পালন করা হত লেঠেল। গগন নাকি তেমনই এক লেঠেল ছিল প্রথম জীবনে তারপর সে ডাকাতিতে নামে ও এলাকার ত্রাস হয়ে ওঠে। ব্রিটিশরাও গগন ডাকাতকে বেশ ভয় পেত। একবার কি হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে (Sriramkrishna Paramhangsha Dev) এই হুগলির পথ দিয়ে দেখতে যাচ্ছিলেন সারদামা। সেই সময় তাঁর পথ আটকায় গগন ডাকাত। পথ রুদ্ধ হতেই সারদামাকে কালীরূপে দেখতে পায় গগন। এই অলৌকিক ঘটনায় ভীত হয়েই গগন নাকি এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিল ডাকাত কালীর মন্দির। ডাকাতরা সারদা মা-কে চাল কলাই ভাজা খেতে দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই চাল কলাই ভাজা ও কারন-মদ হয়ে ওঠে গগন ডাকাতের মা কালীর মূল প্রসাদ। কথিত আছে এই কালী মন্দিরে রঘু ডাকাতও বিভিন্ন সময়ে এসে পুজো দিত। কালীমন্দিরে এককালে প্রচলিত ছিল নরবলী। মন্দির গাত্রে টেরাকোটার কাজ লক্ষ্যণীয়। তিন খিলান যুক্ত এই মন্দিরের একটিই প্রবেশদ্বার। মন্দির সম্মুখে একটি নাটমন্দির রয়েছে।এখানে কালীপুজো হয় তন্ত্রমতে। চার প্রহরে চারবার মায়ের পুজো হয়। নয় রকম বলি দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে মন্দিরে।
রঘু ডাকাতের কালী প্রতিষ্ঠার গল্প:
রঘু ডাকাতের (Raghu dacoit) স্মৃতি বিজড়িত ত্রিবেণীর বাসুদেবপুরের ডাকাত কালী রঘু ডাকাতের কালী (Raghu dacoit kali) বলে জনপ্রিয়। কথিত রয়েছে, বাঁশবেড়িয়ার বাসুদেবপুরের এই কালী মন্দিরে একবার এসেছিলেন সাধক রামপ্রসাদ। সেই সময় রঘু ডাকাতের দল তাঁকে ধরে বলি দিতে উদ্যত হয়। হাড়িকাঠে রামপ্রসাদকে রাখতেই তিনি শ্যামাসঙ্গীত গেয়ে ওঠেন। এরপরই আচমকা অলৌকিকভাবে নিরস্ত্র হয়ে যায় ডাকাত দল। তারপর থেকে বাঁশবেড়িয়ার ডাকাত কালীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। একসময় সাতটি গ্রাম নিয়ে সপ্তগ্রামের সৃষ্টি হয়েছিল। যারমধ্যে অন্যতম ছিল এই বাসুদেবপুর। যেখানে ছিল একচেটিয়া রঘু ডাকাতের দাপট। রঘুর ডাকাতদল অনেকসময় নীলকর সাহেবদের হত্যা করে তাদের গাছে ঝুলিয়ে রেখে দিত। কথিত রয়েছে, সপ্তমগ্রাম বন্দরে কোনও জাহাজ এসে দাঁড়ালেই তা লুঠ করতে রঘু ডাকাতের দল। আর লুঠতরাজের সাফল্যের জন্যই বাঁশবেড়িয়ার ত্রিবেণীর কাছে রঘু ডাকাত প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর ডাকাত কালী। যেখানে প্রতিদিন ল্যাটা মাছের পোড়া মাকে অর্পণ করে ডাকাতিতে বের হত রঘু ডাকাত।
ত্রিবেণী ঘাটের এক কিলোমিটারের মধ্যে দুটি প্রধান রাস্তার সংযোগস্থলের পাশেই জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে রয়েছে এই ডাকাত কালীর মন্দির (Kali Mata Temple) । বাসুদেবপুরের দুই কুখ্যাত ডাকাত রঘু ডাকাত আর বুধো ডাকাতের আরাধ্যা দক্ষিণা কালী মন্দিরটি গম্বুজাকার, এক চূড়াবিশিষ্ট, এবং সামনে বিশাল চাতাল রয়েছে। মন্দিরের পেছনে রয়েছে একটি পুকুর যেখানে নাকি ডাকাতরা (Dacoits)স্নান সেরে পুজো দিত বলে শোনা যায় এই ডাকাত কালী মন্দিরে একসময় নরবলির রীতি চালু ছিল। এখন প্রতি অমাবস্যায় ছাগবলি দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে বলে শোনা যায়। বিশেষ বিশেষ পুজোর দিনগুলোতে মা-কে ল্যাটামাছ পোড়া ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে অন্নকূট এবং কার্তিক মাসের দীপাবলি এই মন্দিরের প্রধান উৎসব।
বিশে ডাকাতের কালী:
এবার চলে আসি বিশে ডাকাতের কালী প্রতিষ্ঠার গল্পে। ডুমুরদহের ডাকাতকালী বা বুনো কালী মন্দিরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (Biswanath Banerjee) ওরফে বিশে ডাকাতের নাম। ডুমুরদহের বিশে ডাকাত ছিল ইংরেজদের কাছে ত্রাস। দুর্গাচরণ রায় তাঁর ‘দেবগণের মর্ত্যে আগমন’ বইয়ে বিশে ডাকাত ওরফে বিশ্বনাথ বন্দোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখেছেন-" প্রায় ৬০ বৎসর অতীত হইল বিখ্যাত ডাকাত বিশ্বনাথবাবু (Dacoit Biswanath)এখানে বাস করিতেন। ইহার অধীনে ডাকাইতেরা নৌকাযোগে যশোহর পর্যন্ত্য ডাকাতি করিয়ে বেড়াইত। ডুমুরদহ অঞ্চলে গঙ্গার ধরে তার এক প্রকান্ড বাড়ি ছিল, যেখান থেকে নদীর বহুদূর অব্দি নজর রাখা সম্ভব হতো।"
রঘু ডাকাতের 'সতীপীঠের কালী':
আবার রঘু ডাকাতের গল্পে ফিরে এলাম। রঘু ডাকাতের (Raghu dacoit) নাম তখন সারা বাংলা জুড়ে।পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামের অট্টহাসের সতীপীঠে রঘু ডাকাতের আরাধ্য মাকালী আজও পূজিত। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, রঘু ডাকাত নদীয়া থেকে ব্রিটিশ পুলিশের তাড়া খেয়ে কেতুগ্রামের অট্টহাসের জঙ্গলে নাকি ডেরা বেঁধেছিল। সেযুগে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানে অবাধে লুটপাট চালাত রঘু । এমনকী স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, চিঠি দিয়ে ডাকাতি করতে যেত রঘু ডাকাত। আর যাওয়ার আগে অট্টহাস জঙ্গলে মা কালীর পুজো দিয়ে ডাকাতির উদ্দেশ্যে রওনা দিত। ব্রিটিশশাসন কালে রঘু তার দল-বল নিয়ে ঈশাণী নদীর (Ishani River) তীরে অট্টহাসের জঙ্গলে বছর সাতেক আস্তানা করে ছিল। জনশ্রুতি আছে একসময় অট্টহাসের মা কালীকে তুষ্ট করতে রঘু ডাকাত নরবলি দিত। যদিও পরে মা কালীর আদেশেই তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কালিকাতন্ত্র অনুসারে এই সতীপীঠ তন্ত্র সাধকদের সাধন স্থল হিসাবে স্বীকৃত। সাধক বামাক্ষ্যাপা,মোক্ষদা, গিরীশ ঘোষ থেকে বহু বিখ্যাত সাধক এই সতীপীঠে থাকা পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তন্ত্র সাধনা করেছেন।
মেটে পাড়ার ডাকাতদলের কালী:
এবার মেটে পাড়ার ডাকাতদলের কাহিনি। এই কাহিনি বর্ধমানের আউশগ্রামের। সেখানকার বননগ্রাম বা বনগ্রামে ছিল ডাকাতদের একটি দল। ডাকাতদলের অত্যাচারে জমিদাররা ত্রস্ত ছিলেন। মেটেপাড়ার ডাকাতরা এলাকায় চরম লুঠপাট চালাত। একবার এই ডাকাতদের শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করে গ্রামের জমিদাররা। তারা ঠিক করে লুকিয়ে আক্রমণের করবে তারা ডাকাতদলের ওপর। আর সেচেষ্টায় সমবেত হন বননগ্রামের আশপাশের জমিদাররা। হামলা হয় মেটেপাড়ার ডাকাতদের ওপর। কিন্তু জমিদারদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাত। শোনা যায়, মা কালীই নাকি সেদিন রক্ষা করেছিলেন মেটেপাড়ার ডাকাতদের। সেই সময় থেকেই মেটেপাড়ার ডাকাতরা কালীর পুজোর (Kali Puja) উদ্যোগ নেয়। তাদের উদ্যোগে প্রচলন হয় কালীপুজোর (Kali Puja)। প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দির।
কেলে ডাকাতের কালী:
এবার কেলে ডাকাতের (Dacoits) কাহিনি। কালী ডাকাতের নাম লোক মুখে নাকি হয়ে যায় কেলে ডাকাত। জিরাটের কালীগড়ের কালীর সঙ্গে নাম জড়িয়ে রয়েছে কালী ডাকাত ও তার সঙ্গীদের। কালী ডাকাতের ডাকাতিকে কেন্দ্র করে আছে নানান রোমাঞ্চকর কাহিনি। বহু বছর আগে নাকি, এই এলাকার জমিদার কালী পুজোর (Kali Puja) পর বেড়িয়ে পড়তেন ডাকাতি করতেন।এই জমিদার কালীই কেলে ডাকাত ছিলেন কিনা সেনিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। আবার একদল গবেষকদের মতে কালীগড় থেকেই নাকি এই এলাকার নাম হয় কেলেগড় বা কালিয়াগড়। তবে লোকবিশ্বাস, কালী বা কেলে ডাকাতের নাম থেকেই নাকি এলাকার নাম হয়েছে কেলেগড়। কেলে ডাকাত এলাকায় সজ্জন হিসাবেই পরিচিত ছিল। স্থানীয় ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা যায় জমিদার কালিচাঁদ ছলেন অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। রাতের অন্ধকারে তিনি নাকি ডাকাতি করতেন। আর এই জমিদার কালাচাঁদ রাতের অন্ধকারে হয়ে যায় কেলে ডাকাত।জমিদার কালাচাঁদের (Kalachand) প্রতিষ্ঠিত সেই মন্দিরে আজও পুজো হয়। পঞ্চমুণ্ডির আসনের ওপর দেবী অধিষ্ঠিতা। দেবীর পুজা হয় তন্ত্রমতে। মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় গঙ্গার পশ্চিম পাড় থেকে এক ব্রাহ্মন সন্তান জিরাটে এসে পৌঁছান। তিনিই স্বপ্নাদেশ পেয়ে নাকি এখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। হুগলীর জিরাট গ্রামের নামটি এসেছে ফারসি ‘জিরায়ৎ’ শব্দ থেকে। এই জিরাটের আগের নাম ছিল মহম্মদপুর। সেযুগে এই অঞ্চল জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। আর তাই ছিল ডাকাতদের স্বর্গরাজ্য। মন্দিরের ঠিক পাশ দিয়েই বয়ে চলত গঙ্গা নদী।কালিরগড় থেকে এই স্থানের নাম কালিয়াগড় হয়। আবার কারোর কারোর মতে কালী ডাকাতের হাতে এই কালি মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কেলে ডাকাতের নাম থেকেই নাকি এলাকার নাম হয় কালিয়াগড়।
রঘু ডাকাতের জঙ্গলী কালী:
গল্প শেষ করব রঘু ডাকাতের জঙ্গলী কালীর (Maa Kali) কথা বলে। রঘু ডাকাতের জঙ্গলী কালীর কাহিনি বেশ আশ্চর্যের। কারণ এই জঙ্গলী কালীমার সামনেই রঘু ডাকাত ডাকাতি ছাড়ার শপথ নেন। লালবাগে অবস্থিত নশীপুরের জঙ্গলী কালীর পুজো ঠিক কত সাল নাগাদ শুরু হয়েছিল তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও কিছু জানা যায়না। জঙ্গলে বেদী বানিয়ে সেখানে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে জঙ্গলী কালীর প্রথম পুজো নাকি শুরু করে রঘু ডাকাত। ডাকাতির আগে সে পুজো করে বের হত বলে শোনা যায়। রঘু ডাকাতের (Raghu Dacoit) সঙ্গে এই কালী পুজোর সম্পর্ক নিয়ে অনেক গল্পগাথা এই এলাকায় প্রচলিত। রঘু ডাকাত (Raghu Dacoit) শুধু ডাকাত ছিল না, সে গরিব মানুষকে সাহায্যও করত। এলাকায় তার একটা দাতাকর্ণ গোছের ব্যাপার ছিল। ধনীর ধন সে গরীবের মধ্যে বিলিয়ে দিত। তাই এলাকার গরীব মানুষরা তার পক্ষেই থাকত সবসময়। জনশ্রুতি একবার ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে রঘু ডাকাত ও তার দলবল মায়ের পুজো শুরু করেছে কিন্তু মা নাকি সেদিন তাকে ডাকাতি করতে যেতে নিষেধ করেন। রঘু ডাকাত তাতে রেগে যায় ও মাকালীকে মারতে উদ্যত হন। সেসময় মা কালী (Maa Kali) একটি বাচ্চা মেয়ের রুপ নিয়ে মন্দিরের পাশের একটা কুয়োয় নেমে যান।এই ঘটনার পর রঘু ডাকাত ওই স্থান ত্যাগ করে চলে যান। জঙ্গলী কালীর বেদিতে আজও সেই বাচ্চার পায়ের ছাপও দেখতে পাওয়া যায়।