সংক্ষিপ্ত
তিনি লিখেছেন অনেক কিছুই। সাহিত্যরসে সে সব-ই অসামান্য। কিন্তু, কিশোরবেলার মনে পাণ্ডব গোয়েন্দার রহস্য-রোমাঞ্চ অভিযানে যে দোলা তিনি লাগিয়েছিলেন তার পরিচিতি তাঁকে সারাজীবনটাই আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছিল।
বাংলা সাহিত্যাকাশে খসে পড়ল আরও এক নক্ষত্র। বাংলা কিশোর সাহিত্যকে রহস্য-রোমাঞ্চের আবরণে যিনি মুড়ে দিতে পারতেন। এক লহমায় এক দুষ্ট ছোট্টকেও শান্ত করে দিতে পারতেন অসামান্য গল্পের লেখনিতে- সেই ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় আর নেই। ৮৩ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন মহান লেখক। হাওড়ার এক নার্সিংহোমে শুক্রবার সকাল ১১টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। পরে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়।
বেশকিছুদিন ধরেই বার্দ্ধক্য জনিত রোগে ভুগছিলেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। বহু লেখা লিখেছেন, তারমধ্যে অধিকাংশই খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু সেই পরিমাণ অর্থ কোনওদিন-ই পাননি বাংলা সাহিত্যের কিশোর রোমাঞ্চ কাহিনির এই কিংবদন্তী প্রণেতা। একটা সময় দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। এমনকী রাজ্য সরকারের কাছ থেকেও যে সম্মান পাওয়ার কথা ছিল তাতেও সেভাবে তাঁকে সমাদার দেওয়া হয়নি। খেদ প্রকাশ করেছিলেন, হয়তো পাণ্ডব গোয়েন্দার জন্য সকলেই তাঁকে কিশোর রোমাঞ্চ কাহিনির লেখকের স্বীকৃতিতেই বেঁধে রেখেছেন। কিন্তু, সাহিত্য সৃষ্টির আঙিনায় ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় যে এক জন বড় সাহিত্যিক তার প্রমাণ থাকলেও স্বীকৃতি ছিল না সেভাবে। শেষ বয়সে বর্তমান সরকার ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়কে সাহায্যের হাত বাড়ালেও তা যথেষ্ট ছিল না বলেই সে সময় অনেকে মন্তব্য করেছিলেন। নাহলে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়কে পাণ্ডব গোয়েন্দার কাহিনির কপি রাইট টেলিভিশন ধারাবাহিকের জন্য বিক্রি করতে হত না। মাঝে টিভি-তে ধারাবাহিক হিসাবে শুরু হয়েছিল পাণ্ডব গোয়েন্দা। কিন্তু, সাহিত্যের পাণ্ডব গোয়েন্দার থেকে সেই ধারাবাহিকের বহু জায়গায় অদল-বদল ঘটানো হয়েছিল। যা ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের মনপূত হয়নি। যে পাণ্ডব গোয়েন্দাকে বাঙালি আজীবন সাহিত্যের পাতায় প্রায় ভাই-বোন এবং বন্ধুর সম্পর্কে লালিত হতে দেখেছিল, টেলিভিশনের পর্দায় বদলে গিয়েছিল সেই সম্পর্কের বেড়াজাল। বিষয়টিতে প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। বাঙালির পাণ্ডব গোয়েন্দার প্রতি ভালোবাসায় এটা একটা কুৎসিত আঘাত ছিল বলেও মনে করেছিলেন তিনি। কিন্তু ধারাবাহিকের স্বস্ত্ব বেচে দেওয়ায় এই নিয়ন্ত্রণটা ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
সাহিত্য তাঁর জীবন। পেন আর খাতা- এই নিয়েই যার কেটে যেত সারাটা সময়। লেখার অগোচরে পেন দিয়ে খাতায় চলত আঁকিবুকি- এহেন মানুষটা শেষ কয়েকটা বছরে কতটুকু সাহিত্য তৈরি করতে পেরেছিলেন! সেই ভাবনায় বারবার রিক্ত হয়েছে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় ভক্তকুলের। ভক্তকূল- সত্যিকারে বর্তমান সময়ে এই শব্দটা শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড করা সেলিব্রিটি বা নিউজ মেকারদের সঙ্গেই ট্যাগ হতে দেখা যায়। কিন্তু, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর ভক্তকূলের জন্য কোনও সোশ্যাল মিডিয়ার পেজ কোনও দিনই তৈরি করতে হয়নি। যে সময় একটা গৃহস্থ বাড়িতে সরকারি টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ফোন থাকাটাও একটা বিলাসিতা মনে হত সেই সময় থেকেই প্রতিনিয়ত ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডব গোয়েন্দা অকাতরে তৈরি করে গিয়েছে একের পর এক ভক্ত। যা বাড়তে বাড়তে একুশ শতকে মাঝে এসে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে তা বলাটা কার্যত অসম্ভব। আসলে সাহিত্যের দুনিয়াটা এমনই হয়- এর ব্যপ্তি ছড়াতে ছড়াতে কাল-সীমা ভেদ করে সমাজেরে কোথায় কোথায় পৌঁছে যায় তা মাপতে যাওয়াটাই চরম ভুল। তাই ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় শুধুই একজন সাহিত্যিক নন, বাঙালির কৈশোরের রোমাঞ্চ অনুভূতির এক আত্মা-এক সূত্রধার- যিনি চিনিয়ে দিতে পেরেছিলেন স্বপ্ন কোথায়-স্বপ্নের বাসাটা কোথায়। বর্তমান সময়ে এমন কোনও সাহিত্যিক এই কাজটি করতে পেরেছেন বলে কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না।
২৬ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। হাওড়ার রামরাজাতলার বাড়ি থেকে চিকিৎসার জন্য তাঁকে স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে ভর্তিও করা হয়েছিল। কিন্তু, শারীরিক অবস্থা স্থায়ী উন্নতির কোনও লক্ষণ ছিল না। শেষমেশ ৩ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় প্রয়াত হন প্রবীণ সাহিত্যিক। রেখে গিয়েছেন তিন মেয়ে এবং স্ত্রী মায়া চট্টোপাধ্যায়কে।
আরও পড়ুন-
কানের পাশ দিয়ে নেমে আসা চওড়া ঝুলপি রাজনীতির ময়দানে তাঁকে দিয়েছিল অভিজাত-র তকমা, সেই জলুদা ওরফে সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় প্রয়াত
ফুটপাত ভাড়া নিলে গুনতে হয় রোজ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, দখল করা ফুটপাতের দাম শুনলে চোখ কপালে উঠবে
'গেরুয়া তো সন্ন্যাসীদের রং গেরুয়া', বিতর্কে ইতি টানলেন সঙ্গীত শিল্পী অরিজিৎ সিংহ