সংক্ষিপ্ত
- সব দলেরই ভরসার নাম প্রশান্ত, এবার ডাকলেন মমতা
- বিজেপি-র নির্বাচনী কৌশল ঠিক করে প্রথম নজর কাড়েন প্রশান্ত
- কাজ করেছেন জেডিইউ, কংগ্রেস, ওয়াইএসআর কংগ্রেসের হয়েও
আদতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। দীর্ঘদিন রাষ্ট্রসংঘের হয়ে বিদেশে কাজও করেছেন। আবার ২০১৪ সালে বিজেপি-র ঐতিহাসিক 'চায়ে পে চর্চার'-র প্রচার কৌশলও তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এ হেন প্রশান্ত কিশোরই এবার তৃণমূলের সহায়। তাঁর বর্তমান রাজনৈতিক পরিচয় বলতে তিনি নীতিশ কুমারের দল জেডিইউ-এর শীর্ষ নেতা। যে জেডিইউ আবার বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র অন্যতম প্রধান শরিক। কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করার ক্ষেত্রে তাঁর কদর এতটাই যে কখনও তাঁকে কংগ্রেস ডাকে, কখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডেকে নেন।
রাজনৈতিক প্রচার কৌশল ঠিক করার ক্ষেত্রে প্রথম ২০১২ সালে শিরোনামে আসেন প্রশান্ত। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পিছনে বড় কৃতিত্ব ছিল প্রশান্তের ঠিক করে দেওয়া প্রচারকৌশলের। হাইটেক প্রযুক্তিতে মোদীর প্রচারের বন্দোবস্ত করে গোটা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন প্রশান্ত। তার পরেই ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের জন্য বিজেপি-র প্রচার টিমের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রশান্তকে।
শোনা যায়, ২০১৪ সালে বিজেপি-র যে 'চায় পে চর্চা' ঝড় তুলেছিল, তার নেপথ্যে ছিল প্রশান্ত কিশোরের মাথা। শুধু তাই নয়, ভোটের সর্বভারতীয় একটি নিউজ চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মেজাজ হারিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী। যা দেখিয়ে বার বার মোদীকে সতর্ক করে দেন প্রশান্ত। বিজেপি-র প্রচার কৌশলের খুঁটিনাটি দিক ঠিক করতে সেবার দেশের সেরা কিছু কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং বিভিন্ন সংস্থার ২০০জন পেশাদারদের নিয়ে সিটিজেন্স ফর অ্যাকাউন্টেবেল রেভিনিউ বা ক্যাগ নামে একটি অলাভজনক সংস্থাও তৈরি করেন প্রশান্ত। পাঁচ বছর আগে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি-র ক্ষমতা দখলের পিছনে বড় কৃতিত্ব দেওয়া হয় প্রশান্তকে।
বিজেপি-কে এমন সাফল্য দেওয়ার পরের বছরই অবশ্য বিহারে বিজেপি-র জয়ের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ান প্রশান্ত। বিজেপি থেকে বেরিয়ে এসে ক্যাগের বদলে ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন প্রশান্ত। ২০১৫-তে নীতিশ কুমারের দল জেডিইউ-এর হয়ে বিধানসভা নির্বাচনে কাজ করে প্রশান্তের সংস্থা। তাঁর ঠিক করে দেওয়া কৌশলের হাত মেলান চিরশত্রু নীতিশ কুমার এবং লালুপ্রসাদ যাদব। যে জোটের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি বিজেপি জোট।
এর পর ২০১৬-র শুরুতেই পঞ্জাবে ক্ষমতায় আসার জন্য প্রশান্তের সাহায্য নেয় কংগ্রেস। ২০১৭ সালে তার সুফলও পায় তারা। বিজেপি-অকালি দলের জোটকে পরাস্ত করে পঞ্জাব দখল করে নেয় কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হন ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ। তবে পঞ্জাবে কংগ্রেসকে সাফল্য দিতে পারলেও উত্তর প্রদেশে প্রশান্তের সাহায্য নিয়েও লাভ হয়নি কংগ্রেসের। বিধানসভা নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে একপেশে জয় পায় বিজেপি। প্রশান্তের কেরিয়ারে যা বড়সড় ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এর পরে ২০১৮ সালে নীতিশ কুমারের জেডিইউ-তে যোগ দেন প্রশান্ত। বলা হয়, গুরুত্বের বিচারে নীতিশের পরেই আসেন প্রশান্ত। এখনও ওই দলেই রয়েছেন তিনি।
উত্তর প্রদেশের ব্যর্থতা কাটিয়ে অবশ্য ২০১৯ সালেই অন্ধ্রে সাফল্যের স্বাদ পেয়েছেন প্রশান্ত। এবার বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচন ভাল ফল করতে প্রশান্তের সাহায্য নিয়েছিল ওয়াইএসআর কংগ্রেস। ভোটের ফল বেরোতে দেখা যায়, ১৭৫ আসন বিশিষ্ট অন্ধ্র বিধানসভায় ১৫১টি আসনেই জিতেছে জগন্মোহন রেড্ডির দল। লোকসভাতেও চন্দ্রবাবু নাইডুর দল টিডিপি-কে ধরাশায়ী করেছে তারা। রাজ্যের ২৫টির মধ্যে ২২টি আসনেই জেতে ওয়াইএসআর কংগ্রেস।
কিন্তু ঠিক কীভাবে কাজ করেন প্রশান্ত? তাঁর সাফল্যের রসায়নও বা কী? প্রশান্তের নিন্দুকরা বলেন, নিজে রাজনীতি করলেও প্রশান্ত খুব একটা রাজনৈতিক মতাদর্শের ধার ধারেন না। বরং পেশাদার পরামর্শদাতা হিসেবে তাঁর সংস্থা কোনও দলকে সাফল্য দিতে অর্থের ব্যবহার আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রথাগত কায়দায় রাজনৈতিক নেতারা যে প্রচার করেন, সেটাই অনেক পেশাদারি মোড়কে মানুষের কাছে উপস্থাপন করার উপায় বাতলে দেন প্রশান্ত এবং তাঁর সংস্থার কর্মীরা।
উদাহরণস্বরূপ ২০১৭ সালে পঞ্জাব এবং উত্তর প্রদেশের বিধানসভা ভোটের কথা বলা যায়। সেবার পঞ্জাবে কংগ্রেস এবং উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস-সমাজবাদী পার্টি জোটের হয়ে কাজ করেছিলেন প্রশান্ত। মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় অখিলেশ যাদব ফের উত্তর প্রদেশের ক্ষমতায় ফিরলে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সি তরুণ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের স্মার্টফোন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই কৌশলই একটু অন্যভাবে পঞ্জাবে কংগ্রেসের হয়ে কাজে লাগান প্রশান্ত। পঞ্জাবে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহের সমর্থনে প্রকল্পের নাম দেন 'ক্যাপ্টেন স্মার্ট কানেক্ট'। যে কৌশলে একবছরের জন্য ওই রাজ্যের স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারীদের নম্বরে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়। তার বদলে ওই সমস্ত স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর মোবাইল নম্বর এবং তথ্য চলে আসে প্রশান্তের দলের হাতে। পরবর্তী সময়ে ওই সমস্ত নম্বরেই ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ এবং কংগ্রেসের সমর্থনে ভোট চেয়ে বার্তা পাঠাতে শুরু করে প্রশান্তের সংস্থা।
এবার সেই প্রশান্তের পরীক্ষাই পশ্চিমবঙ্গে। এবং এবারে বিজেপি-র উত্থান থামিয়ে তৃণমূলকে ক্ষমতায় ফেরানোর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি প্রশান্ত। ২০১৫-র বিহার, ২০১৭- পঞ্জাব এবং উত্তর প্রদেশের মতো এবারও বিজেপি-কে থামানোর রণকৌশল ঠিক করতে হবে তাঁকে। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার নিজে বলেন, অমিত শাহের সুপারিশেই তিনি প্রশান্তকে দলে নিয়েছিলেন। তাঁকে তিনি খুব স্নেহও করেন বলে অকপটে স্বীকার করেন নীতিশ।
বিজেপি-র সামান্যতম ছোঁয়াও যেখানে এড়িয়ে চলছেন তৃণমূল নেত্রী, সেখানে বিজেপি সভাপতির সুনজরে থাকা প্রশান্তের উপরে ভরসা করতে দ্বিধা করেননি তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ভরসার মূল্য প্রশান্ত কতটা দিতে পারেন, তা হয়তো সময় বলবে। তার আগে প্রশান্তের কৌশলে মমতা এবং তাঁর দলের প্রচার কৌশল কতটা বদলাল, আগামী কয়েক মাসেই হয়তো তা বোঝা সম্ভব হবে। আর ২০২১-এর আগে আগামী বছর কলকাতা পুরসভা-সহ বাকি পুরসভার ভোটগুলিতেও প্রশান্তর সাফল্য-ব্যর্থতার একটা আন্দাজ পেয়ে যাবে তৃণমূল নেতৃত্ব।