সংক্ষিপ্ত

  • ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে দেশভাগ হয়েছিল 
  • ভারতকে ভেঙে তৈরি হয়েছিল ২ দেশের 
  • একদিকে ভারতবর্ষ, আর অন্যদিকে পাকিস্তান
  • এই সময়ই জন্ম হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ নামে এক অঙ্গরাজ্যের

(এই প্রতিবেদন সম্পর্কে কিছু কথা- প্রতিবেদনে বর্ণিত সমস্ত তথ্য এবং তার প্রভাব-এর সঙ্গে এশিয়ানেট নিউজ বাংলা বা এশিয়ানেট নিউজ ডট কম কোনওভাবেই সংযুক্ত নয়। একটি নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম হিসাবে আমাদের অফ-এড পেজে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হচ্ছে। অফ-এড-এ দলমত এবং ধর্মীয় ভেদাভেদ নির্বিশেষে মানুষ বা সংগঠন তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন। আমরা আশা রাখি যে কোনও ধরনের উস্কানিমূলক প্রতিবেদন প্রকাশের অনুরোধ কেউ করবেন না। এই প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিটি তথ্য এবং তার প্রভাবের জন্য লেখক চয়ন মুখোপাধ্যায় এবং পশ্চিমবঙ্গের জন্য সংগঠনকেই দায়ভার নিতে হবে।)  


একটি সমীক্ষা, শ্যামাপ্রসাদ এবং পশ্চিমবঙ্গ
-------------------------------------------------------------
চয়ন মুখার্জী
=========
৭ ই এপ্রিল, ১৯৪৭। অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল দুটি চিঠি।

প্রথমটি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, জনৈক পূর্ববঙ্গ নিবাসী হিন্দুর বয়ান -

"Sir,
The points recently put forward in the Press by prominent Hindus of Bengal in favour of partition of Bengal are well crystalised and need not be elucidated. The Hindus should bear in mind that their divided policy for common welfare is the only cause of their present day troubles and sorrows. History will corroborate this statenent from the time of Mohammad Ghory. The Hindus should unite at this time of their peril and forget all party politics if they want to survive. Partition of Bengal is the only solution for the survival of the Hindus of Bengal."
- An East Bengal Hindu

কেন এই চিঠি?

উত্তর পেতে গেলে তার ঠিক এক মাস সময় আগের ঘটনা দেখতে হবে।

মার্চ, ১৯৪৭। 

বিধিরেখা স্পষ্ট। দেশভাগ আসন্ন।

কিন্তু প্রশ্ন এই যে, বাঙ্গালী হিন্দুর কী হবে? মুসলিম লীগ দাবী তুলেছে, গোটা বাংলাকে পাকিস্তানে চাই। সেই দাবি মেনে গোটা বাংলা পাকিস্তানে তুলে দিল বাঙালি হিন্দুর ভবিষ্যৎ কী হবে? ডোডো পাখির মতো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া? কলকাতায় ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে এবং তারপরে নোয়াখালি গণহত্যায় বাঙালি হিন্দু নিধন যজ্ঞ ততদিনে হয়ে গিয়েছে, লোকের মুখে মুখে প্রবচন চালু হয়ে গেছে ," সোহরাওয়ার্দীর নরক"! কী হবে তাহলে?

উত্তর দিতে, বাঙালি হিন্দুকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন একজন। ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।

তিনি ঘোষণা করলেন, যে কোনও জাতির মতোই বাঙালি হিন্দুরও আত্মনিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ অধিকার আছে। মুসলিম লিগ যেমন আজ পাকিস্তান চায়, বাঙালি হিন্দুও নিজেদের হোমল্যান্ড চায়। 

কিন্তু এই দাবির বৈধতা কোথায়? শ্যামাপ্রসাদের দাবি যে বাঙালি হিন্দুর দাবী, তার প্রমাণ কোথায়?

শ্যামাপ্রসাদের হাত শক্ত করতে, জাতির প্রয়োজনে, এই সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তে এগিয়ে এলেন বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা, সেইসঙ্গে এগিয়ে এলো অমৃতবাজার পত্রিকা। ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া অমৃতবাজার পত্রিকা।

দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সংবাদপত্র যদি নিজের ভূমিকা পালন না করে, তাহলে সংবাদপত্রের প্রাসঙ্গিকতা কী? এমনটাই মনে করতেন তৎকালীন অমৃতবাজার পত্রিকার কর্ণধারগণ।

২৩ শে মার্চ, ১৯৪৭। অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হলো সেই ঐতিহাসিক সমীক্ষার কথা। একটি মাত্র প্রশ্ন, পাঠকরা উত্তর দেবেন, "হ্যাঁ" অথবা "না"!

প্রশ্নটি কী?

"Do you want a separate Homeland for Bengal Hindus?"

- আপনি কি বাঙ্গালার হিন্দুদের জন্য পৃথক হোমল্যান্ড চান?

প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল, ৭ ই এপ্রিল, ১৯৪৭-এর মধ্যে পাঠকদের উত্তর পাঠাতে হবে। কিন্তু পাঠকদের বিপুল অর্জিত সেই সময়সীমা বর্ধিত করা হলো, ১৫ ই এপ্রিল, ১৯৪৭ অবধি।

উত্তরগুলির স্ক্রুটিনি করার দায়িত্ব দেওয়া হলো তৎকালীন বিখ্যাত চাটার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট কোম্পানি, গুপ্ত অ্যান্ড মিত্র মেসার্সকে। সেই সঙ্গে স্বেচ্ছায় স্ক্রুটিনি করার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র মোহন বসু।

পাশাপাশি চললো আরেকটি প্রক্রিয়া। শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে তারকেশ্বরে বসলো বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার অধিবেশন। গোটা বাঙ্গালা থেকে ৪০০ জন প্রতিনিধি তাতে উপস্থিত হলেন এবং ৫০ হাজার মানুষের জনসমাগম প্রত্যক্ষ করলো সেই অধিবেশন। সভাপতি হিসাবে ভাষণে নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বললেন,

"it is a question of life or death for the Bengali Hindus. " - অর্থাৎ "বাঙালি হিন্দুর মরণ-বাঁচনের প্রশ্ন"। 

শ্যামাপ্রসাদকে সমর্থন জানাতে বক্তব্য রাখলেন সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সমর্থন করলেন মেঘনাদ সাহা, যদুনাথ সরকার প্রমুখ বুদ্ধিজীবিগণ। বাঙালি হিন্দুর পৃথক হোমল্যান্ড চাই, সনৎ কুমার রায়চৌধুরী এবং সূর্য কুমার বসুর পেশ করা প্রস্তাব বিপুল সমর্থন পাশ হয়ে গেলো। ১০,০০০ স্বেচ্ছাসেবকের বাহিনী প্রস্তুত হলো।

চুপ রইলো না বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেসও। ৪ ঠা এপ্রিল, ১৯৪৭-এ বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেসের একটি মিটিং আহ্বান করা হলো, যাতে আমন্ত্রণ জানানো হলো স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদকে মুখোপাধ্যায়কে। সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ডক্টর বিধান চন্দ্র রায়, ক্ষিতীশ চন্দ্র নিয়োগী, নলিনী রঞ্জন সরকার, প্রমথনাথ ব্যানার্জি, মাখনলাল সেন, অতুলচন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ। একই মর্মে 'বাঙ্গালী হিন্দুর পৃথক হোমল্যান্ড চাই" -- এই প্রস্তাব পাশ হয়ে গেলো।

জাতির স্বার্থে হাত মেলালো বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভা এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস। এই প্রস্তাবের প্রচারে সর্বমোট ৭৬ টি সভা অনুষ্ঠিত হলো, যার মধ্যে ৫৯ টি কংগ্রেসের উদ্যোগে, ১২ টি হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে এবং ৫ টি যৌথভাবে।

কিন্তু একই সঙ্গে সবার চোখ ছিল অমৃতবাজার পত্রিকার সমীক্ষার দিকে। কী হতে পারে ফলাফল?

পত্রিকার অফিস উত্তরের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিল। শুধু কী উত্তর, সেই সঙ্গে নিজেদের মতের সমর্থনে অসংখ্য চিঠি। সেরকমই একটি চিঠি দেখে নেওয়া যাক-

"Sir, 
In forwarding herewith my vote in connection with the poll demanded by you, I beg to leave my reasons as they may appear to be interesting to you.

I have first considered the question from the point of sentiment. As an East Bengal man having no prospect of changing over to the West, my first impulse was to say "No". Mature consideration, however, weighed with me. The smaller number should sacrifice foe the sake of the larger as otherwise the entire community will be doomed.

So, I say " Yes". 

I have then considered from narrow individual interest , I say "No" first but again I say "Yes" because a large number of my own kith and kin will change over and their happiness and prosperity will be my consolation.

Then from the larger interests of the community, I say "Yes". Bengal, as an independent sovereign state with a communal electorate and perpetual Muslim majority in the legislature is sure to crush "Hindu talent". 20 p.c. ruled by 80 p.c. has a bigger chance of development by sufferance than 45 p.c. ruled bg 55 p.c. with a bigey of being outmanovered by the talented minority.

The fourth test is that of logic. Muslims want to rule where they are in a majority. They are not so in West Bengal. They want partition for separation from the Union, we want separation from Pakistan for uniting with ghe Union. 

So, I say "Yes" to your question. "

- P. Sen , Wari, Dacca

যুক্ত বঙ্গের প্রস্তাবে সায় দেওয়া এবং শেয়ালের কাছে কুমিরছানা জমা রাখা যে একই জিনিস -- বাঙালি হিন্দু তা সেদিন ভালোই বুঝেছিল।

পরের ঘটনাগুলি ঘটলো খুব দ্রুত।

২২ শে এপ্রিল দিল্লির পাবলিক র‍্যালিতে শ্যামাপ্রসাদ ব্যাঘ্রগর্জনে বাঙালি হিন্দুর পৃথক হোমল্যান্ডের দাবী জানালেন জনসমক্ষে এবং ঘোষণা করলেন, গোটা বাংলাকে পাকিস্তানে পাঠানোর চক্রান্তের প্রতিবাদ স্বরূপ ২৩ শে এপ্রিল বাংলা বনধ পালন করা হবে।

এদিকে অমৃতবাজার পত্রিকা ঘোষণা করলো, ২৩ শে এপ্রিলই তারা সমীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করবে। গোটা বাংলা সাগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো সেই দিনের।

২৩ শে এপ্রিল পত্রিকায় সমীক্ষায় ফলাফল প্রকাশিত হতেই উল্লাসে ফেটে পড়লো বাঙালি হিন্দু। নিশ্চিন্ত হলেন শ্যামাপ্রসাদ। বাঙালি হিন্দুর পৃথক হোমল্যান্ডের দাবির সমর্থনে বাঙালি তার রায় জানিয়ে দিলো।

ফলাফলটি এক নজরে এরকম।

Question : Do you wang a separate homeland for Bengal Hindus?

Total number of votes cast 534249
of which 98.3% returned YES
0.6% returned NO
1.1% of the papers were rejected

পাঁচ লক্ষ কুড়ি হাজারেরও বেশি বাঙালি, বাঙালি হিন্দুর হোমল্যান্ড গড়ার প্রস্তাবকে সমর্থন জানালেন। তিন হাজার জন বিপক্ষে ভোট দিলেন। ছয় হাজার ভোটার স্লিপ টেকনিক্যাল ভুলের কারণে বাতিল করা হলো।

ভোটারদের আরো কয়েকটি বিশেষত্ব দেখে নেওয়া যাক।

মোট ভোটারদের মধ্যে 

Non-Muslims: 99.6%
Muslims: 0.4%

যা প্ৰমাণ করে বাঙালি হিন্দু এবং অমুসলিম ভোটাররা প্রায় সবাই এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন।

ভোটারদের মধ্যে পুরুষ: 93.6%
মহিলা: 6.4%

সমীক্ষাকে সার্টিফায়েড করলো গুপ্ত অ্যান্ড মিত্র চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট কোম্পানি। তৎকালীন কলকাতার মিশন রো এক্সটেনশন, উইন্ডসর হাউসে ছিল এদের অফিস। তাঁরা লিখলেন,

"We have carried out test check by taking random sample of 10 bundles of 1,000 papers each and are satisfied that the result of the Gallup Poll set forth above is substantially accurate. We are satisfied about the method adopted by the Statistical Department of the "Patrika" in the compilation of the result.

পত্রিকাকে অভিনন্দন জানিয়ে সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ, বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট, লিখলেন,

"I have carefully watched the counting of the Gallup Polls taken by the "Amrita Bazar Patrika" regarding the partition of Bengal.

I have every reason to believe that the polls were genuine and the counting was regular and valid. The large number of votes cast only shows the intensity of public feeling on this question.

I should congratulate the Patrika authoritieson their taking this Gallup Poll for focussing the public feeling on this vital question."


- এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা গো তরী!

ইতিহাস বলে, ২৩ শে এপ্রিল, ১৯৪৭, শ্যামাপ্রসাদের আহ্বানে সেই ঐতিহাসিক বনধ সম্পূর্ণ সফল হয়েছিল। একমাত্র অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ব্যতিরেকে সব দল একে সমর্থন করেছিল। এমনকি শ্যামাপ্রসাদের আহ্বানে এবং উপস্থিততিতে কলকাতার ট্রাম ডিপোর শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মীরাও সিটুর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে বনধ পালন করেছিলেন।

১৪ ই মে, ১৯৪৭ আরেকটি সাপ্লিমেন্টারি ফলাফল প্রকাশ করেছিল অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৫ ই এপ্রিলের পরে প্রাপ্ত উত্তরগুলিকে গণ্য করে। সেখানে ৭০,৬১৮ টি ভোটের মধ্যে ৭০,০৫০ টি ভোট অর্থাৎ ৯৮.৭৭% ভোট পড়েছিল "হ্যাঁ"- র পক্ষে, ২৯১ টি ভোট অর্থাৎ ০.৪১% ভোট পড়েছিল "না" এর পক্ষে। ৫৮১ টি ভোট টেকনিক্যাল কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। হিন্দু ভোটার ৯৯.৮% এবং মুসলিম ভোটার ০.২%।

শেষ বাক্যে বিদ্রুপ করেছিল পত্রিকা,

"It is noteworthy that all Muslims polled in favour of partition, but not in favour of partition of Bengal."

আশ্চর্যজনকভাবে ২০ শে জুন বঙ্গীয় বিধানসভায় যখন বিপুল সংখ্যাধিক্যে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাব পাশ হয়েছিল, যে ২১ জনের ভোট প্রস্তাবের বিপক্ষে পড়েছিল, তারা সবাই মুসলিম এবং বাঙ্গালা ভাগের বিপক্ষে থেকে শ্যামাপ্রসাদের বিরোধিতা করা, কমিউনিস্ট পার্টির দু'জন বিধায়ক জ্যোতি বসু ও রতনলাল ব্রহ্মচারী পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন। কারণ, "চাচা আপন প্রাণ বাঁচা" নীতিটি তারা ভালোভাবেই জানতেন!

ইতিহাস এভাবেই বিশ্বাসঘাতক এবং সুবিধাবাদীদের চিনিয়ে দেয়।