সংক্ষিপ্ত

দেশভাগ হওয়ার আগেই পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে একাধিকবার ধর্মীয় হিংসা, হানাহানি দেখেছে বাঙালি। স্বাধীনতার পরেও সেই ধারা বদলায়নি। বাঙালি হিন্দু প্রাপ্য অধিকার পায়নি।

দার-উল-হারব সম্পর্কে বাংলার বাসিন্দাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন ড. বি আর আম্বেদকর। তাঁর সতর্কবাণী ছিল মূলত বাঙালি হিন্দুদের জন্য। কিন্তু বাঙালি হিন্দু যতদিনে তাঁর সেই সতর্কবাণীর মর্ম উপলদ্ধি করল, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং'-য়ের সময় আম্বেদকরের সতর্কবাণীর মর্মার্থ উপলদ্ধি করা সম্ভব হয়। ১৯৪৭ সালের ১৬ আগস্ট দুপুর থেকে বাংলার তৎকালীন শাসক মুসলিম লিগের নেতৃত্বে শুরু হয় হিন্দু গণহত্যা। ৪ দিন ধরে চলে গণহত্যা। কয়েক হাজার বাঙালি হিন্দুর প্রাণ যায়। আক্রান্ত বা নিহত হন অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, সঙ্গীতজ্ঞ হরেন্দ্র ঘোষ, গণিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্তী, রাজা দেবেন্দ্র মল্লিক, পুলিশ অফিসার এস এন মুখোপাধ্যায়। এর ২ মাস পর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালিতে ফের শুরু হয় হিন্দু গণহত্যা।

‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ ও নোয়াখালির গণহত্যার পর বাঙালির কাছে আম্বেদকরের সতর্কবার্তা ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথার যৌক্তিকতা স্পষ্ট হয়ে আসছিল। বাংলার তৎকালীন শাসক মুসলিম লিগই গণহত্যার আয়োজক ছিল। ফলে পাকিস্তানে বাঙালি হিন্দুর কী অবস্থা হবে সেটা সহজেই অনুমেয় ছিল। এই পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার পর বাঙালি হিন্দুর জন্য পশ্চিমবঙ্গ গঠনের দাবি উঠতে শুরু করে। ১৯৪৬ সালের শেষদিকে বেঙ্গল পার্টিশন লিগ চালু করেন শ্যামাপ্রসাদ। তিনি বাঙালি হিন্দুর আবেগকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। প্রয়াত সিপিএম নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাবা নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলা কংগ্রেসের নেতা ডা. বিধানচন্দ্র রায় বাংলা ভাগের পক্ষে সওয়াল করেন। 

বাংলার সীমানা নির্ধারণের কমিটিতে ছিলেন অতুল্য ঘোষ। তাঁর চেষ্টায় কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার স্বার্থে মালদা, মুর্শিদাবাদ ও ফারাক্কা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভূক্ত হয়। বাংলা ভাগের পক্ষে কলকাতায় সর্ববৃহৎ সভার পৌরহিত্য করেন স্যার যদুনাথ সরকার। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাগের পক্ষে সায় দেন। দলিত নেতাদের মধ্যে বাংলা ভাগের পক্ষে ছিলেন মতুয়া মহাসংঘের প্রধান প্রথম রঞ্জন ঠাকুর, বাংলার প্রাক্তন তফশিলী মন্ত্রী প্রেমহরি বর্মণ।

কমিউনিস্ট নেতারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। তাঁরা সারা বাংলাকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু সাধারণ কর্মীরা পার্টি লাইন অগ্রাহ্য করেন। কারণ, খিদিরপুর বন্দরে গণহত্যার সময় কমিউনিস্ট পার্টির হিন্দু কর্মীরা মুসলমান সহকর্মীদের হাতে আক্রান্ত হন। দলের সদস্যপদের প্রমাণ দেখিয়েও জীবনরক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সেই কারণেই হয়তো ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগের পক্ষে শ্যামাপ্রসাদের ডাকা পরিবহণ ধর্মঘটে সামিল হন কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত ট্রাম কর্মচারীরা।

অভিজাত হিন্দু বাঙালি ও জমিদাররা বাংলা ভাগের পক্ষে ছিলেন। তাঁরা 'হিন্দু হোমল্যান্ড' হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের দাবি জানান। সাধারণ বাঙালিদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই বাংলা ভাগের পক্ষে ছিলেন। হেমেন বিশ্বাস, যোগেন মণ্ডল, শরৎ বসুরা জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন বলেই হয়তো সাধারণ বাঙালির আবেগ বুঝতে পারেননি। অমুসলমান নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে ৫৮-২১ ব্যবধানে বাংলা ভাগ ও পশ্চিমবঙ্গকে ভারতে অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন স্থাপনের পর সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক চিঠিতে লেখেন, 'নতুন বঙ্গ ভাগ হয়ে গেল, ভালোই হল। বাঙালি হিন্দুরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।'

আপন সত্তাকে টিকিয়ে রাখতেই বাংলা ভাগ করেছিল হিন্দু বাঙালি। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের উপরে উঠে আপন জাতি-সংস্কৃতিকে ভালোবেসেছিলেন তৎকালীন বাঙালি হিন্দুরা। বাঙালি হিন্দুর হোমল্যান্ড হিসেবে গঠিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সেই ভূমিতে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রতিটি হিন্দু উদ্বাস্তুর অধিকার আছে। 

আরও পড়ুন-

বেশ কয়েক বছর ধরেই কেন ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করা হচ্ছে, জেনে নিন এর কারণ

Panchayet Election 2023: পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট না পেয়ে বিক্ষোভ তৃণমুলের নেতা কর্মীদের

অনেকেরই রয়েছে বড় বাড়ি-গাড়ি! পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যদের বেতন জানলে চোখ কপালে উঠবে