সদ্য প্রয়াত হয়েছেন অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। মঞ্চ থেকে সিনেমার পর্দায় যার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে থাকেন দর্শকরা। মঞ্চ দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। সিনেমার পর্দায় যখনই এসেছেন স্বাক্ষর রেখেছেন নিজের অভিনয়ের। পরিচালক দ্বয় নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি 'বেলা শেষে'-র সিক্যুয়েল 'বেলা শুরু' ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা। ছবি পোস্ট প্রোডাকশন থেকে এসে ফাইনাল রিলিজের জন্য অপেক্ষায় থাকলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিমারি। যার ফলে ১ বছরের কাছাকাছি সময় ধরে আটকে রয়েছে বেলা শেষে-র প্রেক্ষাগৃহ মুক্তি। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে চলে গেলেন এই ছবির প্রধান দুই চরিত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।
শোক এর মধ্যেই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জানালেন এই ছবি মুক্তি নিয়ে তাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। মাতৃসমা স্বাতীদির সঙ্গে কটানো নানা মুহূর্ত ভাগ করে নিলেন এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পাঠকদের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে এশিয়ানেট নিউজ বাংলার প্রতিনিধি সুচরিতা দে।
এশিয়ানেট নিউজ বাংলা-- 'বেলা শুরু' র দুই মহিরুহ-কে আকস্মিক ভাবে হারানোতে কতটা দায়িত্ব বেড়ে গেল ছবিটি নিয়ে?
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-- অবশ্যই দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। সব থেকে বড় দায়িত্ব হল তাঁদের কাজটাকে সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সেইটা মনে করি একটা বড় কাজ। সেটা আমি কথাও দিয়েছি তাদেরকে। কাজেই 'বেলা শুরু' মুক্তির জন্য যদি তিন বছরও অপেক্ষা করতে হয়, আমি রাজি আছি, আমার তাতে কিছু অসুবিধা নেই। কারন 'বেলা শুরু' আমার কাছে শুধু একটা সিনেমা নয়তো, সিনেমার থেকেও অনেক বেশি কিছু। আমি বলব যেখানে অনেক প্রতিশ্রুতি , অনেক অঙ্গীকার রয়েছে একটা সিনেমার মধ্যে।
এশিয়ানেট নিউজ বাংলা-- এই যে থিয়েটারের মহিরুহরা চলে যাচ্ছেন অভিনেতা হিসেবে কী মনে হয় ?
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-- আমি যখন ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছিলাম তখন আমি এই সকল লেজেন্ডদের দিকে তাকাতাম। স্বাতীদি, সৌমিত্রদা,আরও অন্যান্য যাদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, শিখেছি-- তাঁরা একটা চরিত্রকে কীভাবে ধরেন , কীভাবে উচ্চারণ করেন, সেটা কীভাবে থাকেন, মানে তাদের জীবন যাত্রা, জীবন চর্যাপদ কীরকম। এই বিষয়গুলো ইন্ডাস্ট্রিতে প্রত্যেকের নিজের গড়ে ওঠার ভেতর একটা কাজ হয়ে যায়। ফলে এই মহিরুহরা, এই বটগাছ গুলো যখন একের পর এক চলে যায় শিকড়টা নড়বড়ে হয়ে যায়, আলগা হয়ে যায় ,জমি তখন নড়বড় করতে থাকে। তখন মনে হয় তাদের দেখে থাকবো, একটা নিদর্শন থাকে জীবন চর্চা থাকে যাদের দেখে এগিয়ে যাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে মনে হয় আমারা একটা বড় গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি!
আরও পড়ুন- থমকে গেল মঞ্চে দাপানো সত্যজিতের 'বিমলা', শেষ থেকে শুরু'র আগেই তারাদের দেশে স্বাতীলেখা
এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত র সঙ্গে আগামী কোন কাজের পরিকল্পনা কি চলেছিল?
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-- হ্যাঁ পরিকল্পনা তো ছিলই। এই বছরেই স্বাতীদির জন্মদিনে যখন আমি ফোন করেছিলাম স্বাতীদি একটু অসুস্থই ছিলেন। আমি বলেছিলাম, শোন তুমি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো, যে ছবিটির পরিকল্পনা হয়ে রয়েছে,তোমাকে তো চরিত্রটা করতে হবে। আমার মনে আছে ফোনের ওপারে বাচ্চাদের মত উচ্ছ্বাস নিয়ে রুদ্রদাকে বলছেন, " দেখো আবার বলছে আমাকে পাঠ করতে হবে!!" আমাকে বলেছিলেন, " আমার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই, তুমি কিন্ত আমায় বেশি বকবেনা।" আমি বলেছিলাম কথা দিলাম, আমি তোমায় বকবো না। এই আরকি!! ( কিছুক্ষণ চুপ) ।
এশিয়ানেট নিউজ বাংলা-- স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত কে সিনেমায় দর্শক কম পেয়েছেন। ওনার ভালোবাসার যায়গা ছিল নাটক। তোমার ছবিতে কীভাবে রাজি করাতে?
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-- আসলে স্বাতীদির সঙ্গে নান্দিকারের সঙ্গে উইন্ডোজ সম্পর্কটা ছিল অনেকটা পরিবারের মতো, এবং আমার নন্দিতাদির ছবিতে স্বাতীদির কাজ করাটা অনেকটা পরিবারের থাকার মতোন। আসলে আমি মনে করি আমি আর বাবুয়া ( সোহিনী) আমরা পিঠোপিঠি ভাই-বোন। সেই কারণেই আমাদের মান-অভিমান, ঝগড়া করা সবকিছু শেয়ার করা, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সময় কাটানো । এমনকী বুধবার মনে হচ্ছিল আমরা দুই ভাই-বোন মাকে হারালাম। আমাদের মা চলে যাচ্ছিল। সেক্ষেত্রে স্বাতীদিকে কোন পাঠ বোঝানো বা বলার নেই, এটা স্বাতীদির কাছে আমার দাবি, আমাদের ছবিতে উনি থাকবেনই। এটা অধিকার বলতে পারো। স্বাতী দি আমাকে বকতে পারেন , অভিমান করতে পারেন, আমি চাইলেই স্বাতীদির কাছে যেতে পারি। এই অধিকারের জায়গাটা কোথাও একটা পরিবারের মতো তৈরি হয়েছিল। আমার এখনও মনে আছে, খুব অভিমান হয়েছিল স্বাতীদি র, যখন 'ইচ্ছে ছবি হয়ে গেছিল বাবুয়া ( সোহিনী সেনগুপ্ত)-কে নিয়ে কাজ করেছিলাম। কিন্তু তারপরও স্বাতীদি র সঙ্গে আমার কাজ হচ্ছিল না। অথচ স্বাতীদির সঙ্গে আমার অনেক দিনের সম্পর্ক। নান্দিকার-এ আমার মা-র মাস্টার মশাই ছিলেন উনি। খুব অভিমান করে আমায় বলছিলেন ,বাবুয়া আমার বন্ধুতাই ওকে নিয়েই আমি কাজ করবো স্বাতীদি-কে নিয়ে কাজ করবো না এটা বুঝে গেছেন। তো এই অভিমান এর জায়গাটাও কোথাও একটা ভেঙেছিল ' বেলা শেষে'।
আরও পড়ুন- ঘরে বাইরে-তে শুরু, বেলাশুরু-তে শেষ, সৌমিত্রর সঙ্গেই শেষ বিমলার রিল-রিয়েল জীবনের অধ্যায়
এশিয়ানেট নিউজ বাংলা-- 'বেলা শুরু ' র প্রধান দুজনেই হঠাৎ করে চলে গেলেন। এই ছবি তৈরির গল্প নিয়ে কিছু করার পরিকল্পনা নিয়েছেন?
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-- সত্যিই কিছু ভাবিনি। ভাবার অবকাশই পাইনি! আকস্মিক ভাবে ধাক্কা গুলো এমনভাবে আসছে, যে আগামী দিনের পরিকল্পনা করে উঠতেই পারছিনা আমরা। বুঝে ওঠার আগেই আর একটি ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। সব থেকে মুশকিল হচ্ছে কাল যা ভাবা হচ্ছে পরের দিন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। সাতদিন পর পরিকল্পনা করে রাখছি আগামী দিন হয়তো এইভাবেই এগুলো যাবে, ঠিক সাতদিন পর পৃথিবীটাই অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। কাজেই এখন প্রতিদিন এর কথা ভাবছি। কেউ প্রশ্ন করলে যেমন বলছি আজ এখনও পর্যন্ত ভালো আছি। তেমনি আগামী দিনে কীভাবে এগোবো, কী করবো বুঝতেই পারছি না আমরা।
আরও পড়ুন- বেলা শেষে ছবি দেখে মুগ্ধ অমিতাভ, হাতে লিখে চিঠি পাঠিয়ে ছিলেন স্বাতিলেখাকে