কলকাতার জমিদার বাড়ির মা মেয়েরা দুর্গাকে বিদায়বরণ করতেন ছানার সন্দেশ দিয়ে। ঢাকের বোলে বিদায়ের ছন্দ বাজলেই ময়রাদের কড়াইয়ে তৈরি হওয়া শুরু হত জিবেগজা, রসবড়া, মনোহরা, মিহিদানা, সীতাভোগ আর পান্তুয়ার মত মিষ্টি।সেকালে বনেদী বাড়িগুলিতে দুর্গাপুজো শেষে দশমীর সকাল থেকে মিষ্টির ভিয়েন বসত। আর সেই ভিয়েনে তৈরি হত বিজয়ার হরেকরকম মিষ্টি।
অনিরুদ্ধ সরকার:- সমাজবিজ্ঞানে (Sociology) বলা হয় একটি জাতির সংস্কৃতির নিউক্লিয়াস হচ্ছে তার ঘরোয়া সংস্কৃতি। (Vijaya Dashami) 'বিজয়া দশমী' সেরকমই একটি ঘরোয়া সংস্কৃতি (Culture)। আসলে প্রবাস হোক কিম্বা নিজের পাড়া, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ত বদলেছে অনেককিছুই কিন্তু যা বদলায়নি তা হল বাঙালির নস্টালজিক অনুভূতি। তাই যতদিন বাঙালি থাকবে, থাকবে দুর্গাপুজো; ততদিন থাকবে বিজয়া দশমী আর বিজয়ার মিষ্টি (Sweets)। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ার মিষ্টির বিবর্তন ঘটেছে প্রচুর।
আরও পড়ুন, Durga Puja: আজ দশমীতে শোভাবাজার রাজবাড়িতে বিষাদের সুর, বিসর্জন নিয়ে কড়া নজরদারি গঙ্গায়
বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের পর থেকেই প্রণাম, কোলাকুলি এবং মিষ্টিমুখের পর্ব শুরু হয়ে যেত সেই প্রাচীন কাল থেকেই। বর্ধমানের কাটোয়ায় প্রাপ্ত হাতে লেখা মহাভারতের একটি তালপাতার পুঁথি থেকে জানা যায় ষোড়শ শতকে দুর্গাপুজোয় খরচ হত ৮০ থেকে ৯০ টাকার মত তখন তাতে মিষ্টির জন্য বরাদ্দ থাকত ১৪-১৫ টাকা। যার মধ্যে ক্ষীর কেনা হত ৫ টাকার এবং সন্দেশ কেনা হত ৭ টাকার। সেযুগে প্রতিমার দাম ছিল ৫ টাকার মত। তবে পুজো মানেই ছিল মিষ্টি মুখের আয়োজন।কলকাতার জমিদার বাড়ির মা মেয়েরা দুর্গাকে বিদায়বরণ করতেন ছানার সন্দেশ দিয়ে। সে যুগে তারা মনে করতেন পিত্রালয়ে উমার মুখে ছানার সন্দেশ খাওয়া দেখে নীলকণ্ঠ পাখি কৈলাসে উড়ে গিয়েপ্রবাসে হোক বা নিজের পাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে অনেককিছুই। বাঙালির সঙ্গে আজও জুড়ে আছে বিজয়া দশমী। জানাতে যে উমা পতিগৃহে ফিরছেন। সন্দেশ খাওয়া দেখে উমার ফেরার সন্দেশ নিয়ে যেত নীলকন্ঠ পাখি।কলকাতার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সেকালে বনেদী বাড়িগুলিতে দুর্গাপুজো শেষে দশমীর সকাল থেকে মিষ্টির ভিয়েন বসত। আর সেই ভিয়েনে তৈরি হত বিজয়ার হরেকরকম মিষ্টি। ঢাকের বাদ্যিতে বিজয়ার বিদায় ছন্দ বাজলেই ময়রারা সজাগ হয়ে যেতেন। পুজোর তিনদিন তারা যেমন বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি বানাতেন তেমনি বিজয়ার জন্যও বানাতে হত মিষ্টি। বিজয়ার জন্য বানানো হত ছানার সন্দেশ, জিবেগজা, রসবড়া, মনোহরা, মিহিদানা, সীতাভোগের মত উপাদেয় সব মিষ্টি।
আরও পড়ুন, Covid 19: দশমীর আগেই সংক্রমণ কমল সারা বাংলায়, শীর্ষে কলকাতাই
মহেন্দ্রনাথ দত্ত এক লেখায় লিখছেন, " বনেদী ছাড়া বিজয়ার দিন নারিকেল ছাবা দেওয়া হইত। বিজয়ার কোলাকুলিতে সন্দেশ বা অন্য কোনো খাবার চলিত না।"অমৃতলাল বসু তার স্মৃতিকথায় লিখছেন, " ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে এক মন ছানার সন্দেশ বিক্রি হত ১৬ থেকে ২০ রুপির মধ্যে। যা মধ্যবিত্ত বা গরীবের সাধ্যের বাইরে। তাই ছানার সন্দেশ ছিল ধনীদের জিম্মায়। তার বদলে সেকালে গরীব, মধ্যবিত্তরা উমাকে বিদায় জানাতেন নাড়ু, মালপোয়া, রসবড়া, নারিকেল ও চিনি-গুড় দিয়ে ছাঁচের মিষ্টি বানিয়ে।"কলকাতায় নীলমণি মিত্র স্ট্রিটে রাজকৃষ্ণ মিত্রের বাড়িতে দুর্গোৎসবের কথা না বললে মিষ্টি চর্চা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে এই পুজোয় এক মন খাসা সন্দেশ কিনতে খরচ হয়েছিল ১৫ টাকা। যা সেই সময়ের হিসেবে কিন্তু বেশ দামিই ছিল। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একটা সময় মহালয়ার পর থেকেই বাড়ির মহিলাদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত দশমীর প্রস্তুতির জন্য। গাছ থেকে নারিকেল পাড়ানো হত। তা একজায়গায় জমা করা হত। তারপর তা ঘষে-মেজে প্রস্তুত করা হত এবং সন্দেশের ছাঁচগুলিকে প্রস্তুত করে তা বানিয়ে রাখা হত। মিষ্টির জন্য গুড়-চিনি এসব মজুত রাখার রেওয়াজ ছিল আগে থেকেই।
আরও পড়ুন, আজ দশমীতে আকাশ মেঘলা, বিদায়ের সুরের মাঝেই প্রবল বর্ষণের পূর্বাভাস
বাঙালির বিজয় দশমীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির সংস্কৃতি। তাই দশমীর দিন সেসময় বাঙালিরা কিনতেন জলভরা সন্দেশ, শাঁখ সন্দেশ, কালাকাঁদ, গোলাপ সন্দেশ, কাজু বরফির মত মিষ্টি। সেযুগে মিষ্টির দোকানগুলিতে বিজয়ার দিন থেকেই ময়রাদের ব্যস্ততা বাড়ত। আর সেই ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মত। ঢাকের বোলে বিদায়ের ছন্দ বাজলেই ময়রাদের কড়াইয়ে তৈরি হওয়া শুরু হত জিবেগজা, রসবড়া, মনোহরা, মিহিদানা, সীতাভোগ আর পান্তুয়ার মত মিষ্টি। কলকাতার মুষ্টিমেয় কয়েকটি বনেদী বাড়িতে এখনও দশমীর মিষ্টির সেই সাবেকী রীতি মেনে বসে ভিয়ান। ওড়ে নীলকণ্ঠ পাখি। কিন্তু বেশীরভাগ বাড়িতেই দশমীর ভিয়ান আজ আর বসে না। ময়রা এনে বিজয়ার জন্য হরেকরকম মিষ্টি তৈরি হয় না। বেশিরভাগ বনেদি বাড়িতেই আজকাল বাজার থেকে কেনা মিষ্টির ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুন, Durga Puja 2021: দশমীর দেবীবিদায় ও বিলুপ্তির পথে 'নীলকণ্ঠ পাখি'
অতীতে একটা সময় ছিল যখন অনেকেই বিজয়ায় চিঠি লিখতেন। প্রণাম এবং আশীর্বাদ পাঠাতেন। দূরে থাকা আত্মীয়বন্ধুদের উদ্দেশ্যে পাঠানো সেই চিঠি পড়ে কারো চোখে জল আসত আর কেউ বা আনন্দে ভাবুক হয়ে চিঠির উত্তর লিখতে বসতেন। দশমীর সেই চিঠি লেখার চল আজ আর নেই। বিলুপ্ত। তার বদলে এখন সোশ্যল সাইটেই প্রণাম ও শুভেচ্ছা সেরে নেওয়ার হিড়িক বেড়েছে। আর কেউ কেউ তো 'কানে প্রণাম' জানাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। হাল আমলের ছেলেমেয়েদের কাছে আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিজয়া করার ব্যাপারটা এখন বড়ই 'সেকেলে' বা 'ব্যাকডেটেড'। গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার বিষয়টিও তরুণ প্রজন্মের কাছে একেবারেই নাপসন্দ। কেউ কেউ চাপে পড়ে প্রণাম করলেও তাদের হাত গুরুজনদের হাঁটুর নীচে যেন আর নামতেই চায় না। 'প্রণামে'র মত এভাবেই কোনও একদিন বাঙালি সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে 'বিজয়ার মিষ্টি'। আর সেই জায়গা পুরোপুরিভাবে দখল করে নেবে ফাস্টফুড, পিৎজা বার্গার আর প্যাকেট নারকেল নাড়ু।
আরও দেখুন, বিরিয়ানি থেকে তন্দুরি, রইল কলকাতার সেরা খাবারের ঠিকানার হদিশ
আরও দেখুন, কলকাতার কাছেই সেরা ৫ ঘুরতে যাওয়ার জায়গা, থাকল ছবি সহ ঠিকানা
আরও দেখুন, মাছ ধরতে ভালবাসেন, বেরিয়ে পড়ুন কলকাতার কাছেই এই ঠিকানায়
আরও পড়ুন, ভাইরাসের ভয় নেই তেমন এখানে, ঘুরে আসুন ভুটানে