সংক্ষিপ্ত
প্রাচীনপন্থীদের বিশ্বাস, এই পাখি নাকি উড়ে গিয়ে কৈলাসে মহাদেবকে জানায়, সপরিবারে মা দুর্গা ফিরছেন। দশমীর দিন দুটি নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হয়। প্রথমটি মণ্ডপ থেকে দেবী দুর্গার যাত্রা শুরু হওয়ার সময় ও অপরটি দেবী দুর্গার নিরঞ্জনের পর। রামায়ণ অনুসারে, রাবণবধের আগে রামচন্দ্র এই পাখির দর্শন পেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।এই পাখিকে একবার চোখের দেখা দেখতে উত্তরপ্রদেশের বহু মানুষ অনেক টাকা দেন পাখিওয়ালাকে। এই নীলকণ্ঠ পাখিকে 'কৃষকমিত্র'ও বলা হয়।
অনিরুদ্ধ সরকার:- সেকালের অনেক জমিদারবাড়ির (Zamindar) বাবু দুর্গাকে মনে করতেন নিজের বাড়ির মেয়ে আর শিবকে মনে করতেন জামাই। আর সেকারণে দশমীর দিন তাঁরা দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের (Durga Idol immersion) মাধ্যমে মনে করতেন যে তাঁরা তাঁদের মেয়ে দুর্গাকে জামাই শিবের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আর এই কল্পনা থেকেই জন্ম নিয়েছিল এক রেওয়াজের যার নাম, নীলকন্ঠ পাখি (Neelkantha Birds) ওড়ানো।
আরও পড়ুন, Durga Puja: আজ দশমীতে শোভাবাজার রাজবাড়িতে বিষাদের সুর, বিসর্জন নিয়ে কড়া নজরদারি গঙ্গায়
পাখি উড়িয়ে ভাবুক জমিদার তাকিয়ে থাকতেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। জমিদারদের মন চলে যেত 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে'। সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় একখানি বই লিখে ফেলেছিলেন 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' যদিও তার বিষয়বস্তু আলাদা। প্রাচীনপন্থীদের বিশ্বাস, এই পাখি নাকি উড়ে গিয়ে কৈলাসে মহাদেবকে জানায়, সপরিবারে মা দুর্গা ফিরছেন। এই পাখির ডাক কিন্তু মিষ্টি নয়, বরং কিছুটা কর্কশ। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা নীলকণ্ঠকে ওড়িশা, কর্নাটক এবং তেলঙ্গনার 'স্টেট বার্ড' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে এই একরত্তি পাখি গভীর ভাবে জড়িয়ে। আর তার বঙ্গজ নামে তো স্বয়ং মহাদেব বিরাজমান। ২৬ থেকে ২৭ সেন্টিমিটার লম্বা এই পাখির দেহ, লেজ ও ডানায় উজ্জ্বল নীল রঙের জৌলুস দেখার মতো।জমিদার বাবুরা সেযুগে মনে করতেন বিজয়ার দিন এই নীলকন্ঠ পাখি জামাই শিবের কাছে আগাম খবর পৌঁছে দেবে। অনেকটা আজকের ম্যসেঞ্জারের মত। দেখতে দেখতে বিজয়ার দিন নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে খবর পাঠানোর এই রেওয়াজ দুর্গাপুজোর এক চিরস্থায়ী প্রথাতে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন, Covid 19: দশমীর আগেই সংক্রমণ কমল সারা বাংলায়, শীর্ষে কলকাতাই
কলকাতায় শোভাবাজার রাজবাড়ির নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে আর চোরবাগানের মল্লিকবাড়িতে এই প্রথা এখনও চালু আছে বলে জানা যায়। এক কলকাতা গবেষকের তথ্য অনুযায়ী হাওড়া জেলার ডাঁসাই গ্রামের কাঙালীচরণ শিকারি এই দুটি বাড়িতে নীলকণ্ঠ পাখির জোগান দিতেন। কলকাতার বাবুদের সেকালের সংস্কার অনুযায়ী নীলকণ্ঠ পাখি হচ্ছে পবিত্র বার্তাবাহক। আর সেকারণে দশমীর দিন দুটি নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হয়। প্রথমটি মণ্ডপ থেকে দেবী দুর্গার যাত্রা শুরু হওয়ার সময় ও অপরটি দেবী দুর্গার নিরঞ্জনের পর। এই নীলকণ্ঠ পাখিকে 'কৃষকমিত্র'ও বলা হয়। খেত-খামারে ফসলে লেগে থাকা কীট খেয়ে কৃষকদের সহায়তা করে নীলকণ্ঠ পাখি। আর সেকারণে কৃষকরা এই পাখিকে খুব মান্যতা দেয়। বনেদি ও জমিদার পরিবারে দুর্গাপুজোর পর এই পাখি ওড়ানোর দীর্ঘদিনের রীতি বদলাতে শুরু করে নীলকন্ঠ পাখির অভাব জনিত কারণে। আইন করে পশুপাখি ধরা নিষিদ্ধ করার ফলে পাখি ওড়ানোর সেই রীতি পালন করা আর সম্ভব হয় না জমিদারবাড়িগুলির পক্ষে। কিন্তু জমিদারবাড়ির রেওয়াজ বলে কথা। এত সহজে কি বন্ধ করা যায়। একেবারেই না। তাহলে? তাহলে আর কি, জমিদারবাড়িগুলি থেকে এখন নীলকণ্ঠ পাখি আঁকা ফানুস উড়িয়ে সেই রেওয়াজ পালন করা হয়। আবার কোনও কোনও বনেদি বাড়িতে নীলকণ্ঠ পাখির মূর্তি বানানো হয়। আর তা দিয়েই পালিত হয় এই পুরাতন রীতি। নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর রীতি পালন করার পর সবাই অপেক্ষায় থাকে আবার একটি বছরের জন্য।
আরও পড়ুন, আজ দশমীতে আকাশ মেঘলা, বিদায়ের সুরের মাঝেই প্রবল বর্ষণের পূর্বাভাস
ছোট্ট এই নীলকণ্ঠ পাখির সঙ্গে পৌরাণিক আখ্যানের সম্পর্কও বেশ গভীর। রামায়ণ অনুসারে, রাবণবধের আগে রামচন্দ্র এই পাখির দর্শন পেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। আবার অনেকের মতে, নীলকণ্ঠ পাখি নাকি পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রামচন্দ্র ও তাঁর বাহিনীকে। তাই তার দর্শন পাওয়া শুভ বলে ধরা হয়।'নীলকণ্ঠ' শিবের আরেক নাম। সমুদ্র মন্থনের পর ওঠা ভয়ানক বিষের প্রভাব থেকে সৃষ্টিকে রক্ষা করতে সেই বিষ নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন মহাদেব। বিষের জ্বালায় তাঁর গলা নীলবর্ণ ধারণ করে। তাই শিবের আরেক নাম 'নীলকণ্ঠ'। এই নীল বর্ণের জন্য নীলকণ্ঠ পাখিকে শিবের দোসর বলে মনে করা হয়। পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ায় নীলকণ্ঠের দেখা পাওয়াটা আজ একপ্রকার ভাগ্যের বিষয়। এই সুযোগে একশ্রেণির মানুষজন নীলকণ্ঠ পাখি খাঁচাবন্দি করে লুকিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখিয়ে অনেক অর্থ উপার্জন করে। বাংলার দুর্গাপুজোয় নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর যেমন একটা রেওয়াজ তেমনি উত্তরপ্রদেশের বরেলিতে এক ধরনের প্রথা আছে। দশেরার দিন এই নীলকণ্ঠ পাখি দেখা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করেন সেখানকার মানুষজন। শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে উত্তরপ্রদেশের বহু মানুষ অনেক টাকা দেন পাখিওয়ালাকে। আর সেই পাখিওয়ালা পয়সার লোভে নীলকন্ঠ পাখিকে খাঁচাবন্দি করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখান। দশেরার দিন এই পাখি দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় থাকেন সারা উত্তরপ্রদেশের মানুষজন। আর সেই সুুুযোগে কিছু মানুষ নীলকণ্ঠ পাখি খাঁচাবন্দি করে বাড়ি বাড়ি দেখিয়ে বেড়ায় পয়সার বিনিময়ে।
আরও পড়ুন, Durga Puja: ওড়ে না নীলকন্ঠ পাখি, জাঁকজমকে ভাটা পড়লে নবমীতে মাতোয়ারা কাশিমবাজার রাজবাড়ী পুজো
উত্তরপ্রদেশে এই প্রথার নেপথ্যে যে পৌরাণিক ব্যাখ্যা আছে তা হল, রামায়ণ অনুসারে রাবণ বধের পর ব্রহ্ম হত্যার পাপ স্খালনের জন্য রাম ও লক্ষ্মণ শিবের ধ্যান করতে শুরু করেন। পাপ খণ্ডনের আশায় তারা কঠোর তপস্যা শুরু করেন। শিব তাদের কাছে উপস্থিত হন নীলকণ্ঠ পাখি রূপে। আর এই বিশ্বাস থেকে আজও তাই সেখানকার মানুষজন এই পাখি দেখার আশায় থাকেন। যাকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে একশ্রেণির মানুষ। উপার্জনই তাঁদের কাছে সবকিছু। এই প্রাচীন রীতি পালন করতে গিয়ে প্রতি বছর নির্বিচারে মারা পড়ে অগণিত নীলকণ্ঠ। তাদের নৃশংসভাবে ধরে বন্দি করে রাখা হয়। তারপর বিজয়া দশমীতে দশভুজাকে বিসর্জনের আগে খাঁচা খুলে উড়িয়ে দেওয়া হয় আকাশে।সেখানেও দেখা দেয় বিপত্তি। ধরে-বেঁধে রাখা আহত পাখি উড়তে পারে না। কিছু দূর যাওয়ার পরেই তাকে মাঝেমধ্যেই আক্রমণ করে অন্যান্য পাখির দল। ফলে প্রতি বছর প্রাণ যায় বহু নীলকণ্ঠের। কয়েকবছর আগে নীলকণ্ঠ পাখি বন্দি করা আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে বন্ধ হয়েছে নীলকণ্ঠ পাখির অকালনিধন।
আরও দেখুন, বিরিয়ানি থেকে তন্দুরি, রইল কলকাতার সেরা খাবারের ঠিকানার হদিশ
আরও দেখুন, কলকাতার কাছেই সেরা ৫ ঘুরতে যাওয়ার জায়গা, থাকল ছবি সহ ঠিকানা
আরও দেখুন, মাছ ধরতে ভালবাসেন, বেরিয়ে পড়ুন কলকাতার কাছেই এই ঠিকানায়
আরও পড়ুন, ভাইরাসের ভয় নেই তেমন এখানে, ঘুরে আসুন ভুটানে