রূপক সাহা এশিয়ানেট নিউজ বাংলার সঙ্গে কথোপকথনে আরও জানিয়েছেন যে, ভারতীয় ফুটবল যে দুর্বীনিতদের হাতে গিয়েছে তার সূচনা আজকে নয় স্বাধীনতার পর থেকেই তার পরিচয় মিলেছে। সে সময় বড় ছিল ফুটবলারদের খেলাকে ঘিরে আবেগ। অর্থলাভ নয়, নিছক আনন্দ এবং ভালোবেসে খেলাটা খেলে যাওয়া।
ভারতীয় ফুটবলের উপরে ফিফার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মুখ খুললেন প্রাক্তন ক্রীড়া সম্পাদক তথা সাহিত্যিক এবং প্রাক্তন ফুটবলার রূপক সাহা। তাঁর সাফ কথা, এই নিষেধাজ্ঞা কোনওভাবেই ধোপে টিকবে না। কারণ, অনুর্ধ্ব ১৭ মহিলা বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখেই ফিফাকে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। বিশ্বের সর্বোচ্চ ফুটবল নিয়ামক সংস্থার কাছে এমন কোনও দেশ এই মুহূর্তে নেই যে এত তাড়াতাড়ি বিশ্বকাপের আয়োজন করতে পারবে। যা হয়েছে তা আসলে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বানচাল করতে।
ভারতীয় ফুটবলের অতিত দিনের সঙ্গে বর্তমান দিনের কেউ তুলনা টানতে চান- তাহলে ভুল বলেই মনে করছেন রূপক সাহা। ভারতীয় ফুটবলে আজ যে হতাশার দিন তৈরি হয়েছে তার পিছনে ফুটবল কর্তাদেরই হাত রয়েছে বলেই মত তাঁর। তিনি আরও জানিয়েছেন, এর মানে এই নয় যে এখন ফুটবলে অর্থ নেই। কিন্তু, সেই অর্থের বিনিময়ে এমন কোনও সাফল্যের সিড়ি ভারতীয় ফুটবল চড়তে পারছে না যার উপরে ভরসা রাখতে পারেন ফুটবলপ্রেমীরা। ফুটবল উন্মাদনায় ভারত বিশ্বের প্রথম সারির ফুটবল দেশগুলির কাছাকাছি। খেলাকে বেচার জন্য আদর্শ এক বাজার। চিনের পর বিশ্বের কাছে সবচেয়ে ফলদায়ক বাজার এই ভারতবর্ষ। কিন্তু, ফুটবলকে ঘিরে যে অর্থ আজ ভারতীয় ফুটবলে আসছে তার সিংহভাগ কুক্ষিগত করছে অধিকাংশ ফুটবল কর্তা এবং প্রাক্তন কিছু ফুটবলার ও এই পুরো প্রক্রিয়াটার পিছনে থাকা কিছু এমবিএ মার্কা কর্পোরেট লিডার।
রূপক সাহা এশিয়ানেট নিউজ বাংলার সঙ্গে কথোপকথনে আরও জানিয়েছেন যে, ভারতীয় ফুটবল যে দুর্বীনিতদের হাতে গিয়েছে তার সূচনা আজকে নয় স্বাধীনতার পর থেকেই তার পরিচয় মিলেছে। সে সময় বড় ছিল ফুটবলারদের খেলাকে ঘিরে আবেগ। অর্থলাভ নয়, নিছক আনন্দ এবং ভালোবেসে খেলাটা খেলে যাওয়া, আর ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করা। ফুটবলারদের এই ভালোবাসা এবং আবেগের প্রচুর ফায়দা তুলেছেন ফুটবল কর্তারা। রূপক সাহা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন প্রাক্তন আইএফ কর্তা এম এন দত্তরায়ের নাম। ৬০ দশকে আইএএফ-এর কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বও সামলিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় ৮০ হাজার টাকার এক অর্থ নয়ছয় নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে আইএফএর নামে মামলা হয়। এম এন দত্তরায় আদালতে বয়ান দিয়েছিলেন যে, স্বপ্নে নাকি তিনি দেখেছিলেন মা কালী এসে সব টাকা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। এরপর থেকেই ৮০ হাজার টাকার আর কোনও খোঁজ নেই। রূপক সাহা-র আরও কিছু তথ্য এই প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বর্তমান সময়ে এআইএফএফ-এর প্রভাবশালী ফুটবল কর্তা কুশল দাসের বিরুদ্ধেও কয়েক লক্ষ টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠে। তখন তিনি বলেছিলেন ভারতীয় ফুটবল দলের জন্য জ্যোতিষী রাখতে গিয়ে ওই অর্থ ব্যয় হয়েছে।
ফুটবলের অর্থে কর্মকর্তাদের এই লুঠেরা মার্কা ভাব আজকের নয়। আগে ফুটবল কর্তাদের এই নয়ছয়-কে ঢাকার জন্য অনেকে থাকতেন। যেমন ছোট ছোট শহর বা শহরতলি অথবা জেলার ফুটবল পাগলের দল। যারা একের এপর এক প্রতিভাকে কলকাতার ময়দান ছুঁইয়ে ভারতীয় দলে পৌঁছে দিত। এই কুশীলবদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করত আবার কলকাতা ময়দানের কিছু ফুটবল পাগল ছেলে ও লোকেরা। যারা কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে প্রতিভাবান ফুটবলারদের ময়দানে নিয়ে আসত। কিন্তু, দীর্ঘদিন ধরেই অযোগ্য ফুটবল কর্তাদের জন্য এই ইকো-সিস্টেম ভেঙে পড়েছে। ফলে সেভাবে আর ঝাঁকে ঝাঁকে স্থানীয় ফুটবলার উঠে আসছে না। যারা আসছে তাদের মানও যে বিশাল কিছু সেটাও নয়। বলতে গেলে একটা গোজামিল দেওয়া ফুটবল ইকো-সিস্টেম বর্তমান সময়ে ভারতীয় ফুটবলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
ফুটবল ময়দানে অযোগ্য কর্তাদের ভিড় বাড়তে বাড়়তে এখন এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে বলেই মনে করছেন রূপক সাহা। তার মধ্যে অনৈতিকভাবে অর্থ লাভের মধু সংগ্রহ সুযোগ পেয়ে এঁদের লুঠেরা মার্কা ভাবটাও সাংঘাতিক জায়গায় পৌঁছেছে। এম এন দত্ত রায় যখন ফুটবল কর্তার শীর্ষ পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তখন তিনি ভারতীয় ফুটবলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সিকে। তাঁর আমলেও ফুটবলের যতটা উন্নতি হয়েছিল তার থেকে বেশি ফুটবল কর্তা হিসাবে উন্নতি ছিল এক অসামান্য পর্যায়ে। আবার প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সময় যখন ঘনিয়ে এসেছে তখন শরদ পাওয়ারের কর্তৃত্বকে হাতিয়ার করে ভারতীয় ফুটবলের কাঁধে চেপে বসেছিলেন প্রফুল প্যাটেল। এরা কস্মিনকালে এক দান ফুটবল খেলেছেন বলে জানা যায় না, বা কোনও ক্লাবের কর্তা ছিলেন এমনটাও নয়। স্রেফ রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় ফুটবলের মাসিহা হিসাবে প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে গিয়েছেন। যার ফলে বাজার অর্থনীতির হাত ধরে ফুটবলে অর্থ এলেও তাকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি মিথ্যা স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে।
কমিশন ভিত্তিতে বাইরের টিম নিয়ে এসে ভারতে ফুটবল খেলানোর চলটা নেহেরু কাপের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল। সেই সময় প্রচুর অর্থ ঢুকেছিল ভারতীয় ফুটবলে। কিন্তু, এর লাভ ফুটবলাররা পাননি। বর্তমান সময়ে এখন তো এই কমিশন বিদেশি ফুটবলার পিছু হয়ে গিয়েছে। এমন এক অগোছালো, অবৈজ্ঞানিক প্রথার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু কর্পোরেট মার্কা ফুটবলারকে এআইএফএফ-এর অন্দরে আনার চেষ্টা। এদের প্রচার রয়েছে, ব্র্যান্ড রয়েছে। কিন্তু, এই সব ফুটবলার যে অর্থ আনতে সক্ষম বা আর্থিক অনুদানকে দেশের ফুটবলের উন্নতির মান্নোনয়নে কাজে লাগাতে সক্ষম তাও প্রমাণিত নয়। এরা যে কাজটাই করেছেন তাতে অর্থলাভ হলেও কাঙ্খিত লক্ষে আর পৌঁছাতে পারেননি। ভারতীয় ফুটবল অবশ্যই একটা নিরাশার দোলাচলে চলছে, আর তার সঙ্গে এই ব্যান, যা ফুটবলপ্রেমীদের মনকে ভারাক্রান্ত করে দিয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ এখনও লড়ে যাচ্ছে ফুটবলকে ভালোবেসে। এটাই যা একমাত্র আশা।
আরও পড়ুন-
ঘোর সংকটে ভারতীয় ফুটবল, এআইএফএফকে ব্যান করল ফিফা
নির্বাচনকে ভন্ডুল করতেই কি ফিফাকে কাজে লাগাল প্রফুল প্যাটেল গোষ্ঠী, জানুন নির্বাসনের কারণগুলি
৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা, কী বললেন সচিন থেকে কোহলি-রোহিতরা