১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর আয়ারল্যান্ডে জন্মেছিলেন মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল। স্বামী বিবেকানন্দের সংস্পর্শে আসার পর যিনি সারা বিশ্বে সিস্টার নিবেদিতা নামে জনপ্রিয় হন। আজ তাঁর ১৫৪ তম জন্মদিবস। নিবেদিতার কাছে বিবেকানন্দ ছিলেন 'রাজা'। রাজার মৃত্যুর খবর পেয়ে নিবেদিতা ছুটে গেছিলেন বেলুড় মঠে। চোখের জলে বিদায় জানয়েছিলেন গুরুকে। গুরুর সেই অন্তিম যাত্রার মর্মস্পর্শী কাহিনি শোনাচ্ছেন অনিরুদ্ধ সরকার।।
১৯০২ এর ৫ জুলাই, শনিবার। সকাল ৯ টা নাগাদ সিস্টার নিবেদিতার ঠিকানায় একটি চিঠি এল। নিবেদিতা তখন থাকেন ১৬ নম্বর বাগবাজার লেনের (Bagbazar Lane) বাড়িতে। চিঠি খুলে দেখলেন চিঠি এসেছে বেলুড় মঠ থেকে। চিঠিতে স্বামী সারদানন্দ (Swami Saradananda) লিখছেন, " My Dear Nivedita, the end has come, Swamiji has slept last night at 9 o'clock. Never to rise again" চিঠিটা হাত থেকে পড়ে গেল নিবেদিতার। অস্ফুটে বললেন স্বামীজি আর নেই! নিবেদিতার সাথে স্বামীজির পর বেলুড় মঠে যদি কারো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হত তাহলে তার নাম সারদানন্দ। কারণ সারদানন্দ ভালো ইংরেজি জানতেন। ফলে নিবেদিতার পক্ষে কথাবার্তা বলা সহজ হত। সারদানন্দের চিঠি পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন নিবেদতা। তাঁর রাজা আর নেই! একথা ভাবতেই পারছেন না তিনি। চিঠির অক্ষরগুলো নিবেদিতার চোখের সামনে কাঁপতে লাগল। শরীর অবশ হয়ে গেল তাঁর । ঘরে উপস্থিত নিবেদিতার সেবিকাও কেঁদে উঠলেন। নিবেদিতা আর দেরি না করেই বেলুড় থেকে আসা পত্রবাহকের সঙ্গে রওনা দিলেন বেলুড় মঠ অভিমুখে।
বেলুড় মঠে (Belur Math) পৌঁছেই নিবেদিতা সোজা উঠে গেলেন দোতলায় স্বামীজির (Swami ji) ঘরের দিকে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৭ টা। ঘরে তখন বেশি লোকজন নেই। নিবেদিতা (Nivedita) দেখলেন স্বামীজির দেহ মেঝেতে শায়িত রয়েছে। হলুদ রঙের ফুলমালায় আচ্ছাদিত স্বামীজির দেহ। স্বামীজির মানসকন্যা গিয়ে বসলেন তাঁর প্রিয় 'রাজা'র কাছে। স্বামীজিকে (Swamiji) 'রাজা' বলতেন নিবেদিতা (Nivedita)। নিবেদিতার চোখ দিয়ে বয়ে চলেছে অশ্রুধারা। মুখে কোনও কথা নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে আবেগ-আকুল কম্পিত হাতে তিনি তুলে নিলেন স্বামীজির মাথাটি। শিবরূপী গুরুর সেবা করতে লাগলেন ছোটো একটি পাখা হাতে। নিবেদিতা স্থির ভাবে বসে রয়েছেন। বেলুড় মঠে (Belur Math) সন্ধ্যায় মন্দিরের প্রার্থনার সময় স্বামীজি তাঁর নিজের ঘরে ধ্যানাসনে বসে রাত ৯টায় শান্তভাবে মহাসমাধি লাভ করেছেন। অনিন্দ্যসুন্দর দিব্যকান্তি মুখমণ্ডলের দিকে ইঙ্গিত করে সারদানন্দকে নিবেদিতা বললেন, উনি যান নি। উনি যেতে পারেন না। উনি আছেন। উনি থাকবেন। স্বামীজির সমাধির দু’বছর আগে হিমালয়তীর্থ অমরনাথধামে তুষারলিঙ্গ মহাদেবের কাছে গিয়ে তাঁর ইচ্ছামৃত্যু প্রার্থনা করেছিলেন। আর ফিরে এসে বলেছিলেন "আমি চল্লিশ পেরব না।" হলও তাই ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিন। চল্লিশ পেরলো না। স্বামীজি কিন্তু অমরনাথে নিবেদিতাকে আভাস দিয়েই রেখেছিলেন, মহাদেব-কৃপায় তিনি ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছেন। যার নিহিত অর্থ হল, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত না হলে তাঁর দেহত্যাগ হবে না। স্বামীজির মহাসমাধির আগের অনেক কথা নিবেদিতার মনে পড়েছিল।
আরও পড়ুন- Gold and Silver Price - দিওয়ালির আগে দারুণ সস্তা হল সোনা, রেকর্ডের চেয়ে দাম কমল ৮৫০০ টাকা
১৮৯৮ সালে স্বামীজি (Swamiji) শেষবারের মতো হিমালয় গেছিলেন। শৈবতীর্থ অমরনাথে শিবের কাছে স্বামীজি ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন। গুহা থেকে বেরিয়ে প্রিয় শিষ্যাকে তিনি প্রথম সে কথা জানিয়েছিলেন। স্বামীজির মর্ত্যজীবনের এই পরম প্রার্থনাটির কথা জেনে বিস্মিত হয়েছিলেন নিবেদিতা। আরও বিস্মিত হয়েছিলেন স্বামীজি (Swamiji) যখন তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর এ বার হিমালয়ে আসার অন্যতম উদ্দেশ্য শিবসুন্দরের কাছেই নিবেদিতাকে উৎসর্গ করা তাঁর জীবনব্রত উদ্যাপনের জন্য। স্বামীজির শেষ জীবনে, যখন তাঁর শরীর ক্রমশই ভেঙে পড়ছিল, নিবেদিতা তখন ছায়ায় মতো তাঁর অনুগামী ছিলেন। ১৮৯৮ সালে স্বামীজি-সঙ্গের কথা মর্মস্পর্শী ভাষায় নিবেদিতা উল্লেখ করেছেন ‘স্বামীজির সহিত হিমালয়ে’গ্রন্থে। বেলুড় মঠ। একে একে সন্ন্যাসী-ভাইরা স্বামীজির দেহ নীচে নামিয়ে আনলেন। তাঁরা আরতি ও প্রণাম-শেষে স্বামীজীর পা দু’টি আলতায় রঞ্জিত করলেন। মস্তক অবলুণ্ঠিত করে প্রণাম সারলেন। তারপর গুরুভাইরা স্বামীজির পাদপদ্মের ছাপ নিলেন। নিবেদিতাও অশ্রুসিক্ত নয়নে স্বামীজীর (Swamiji) পা দুটি ধুয়ে একটি পরিষ্কার রেশমি রুমালে তাঁর গুরুর পদচিহ্ন গ্রহণ করলেন। সন্ন্যাসী ও সমবেত জনতার সঙ্গে নিবেদিতাও এগিয়ে গেলেন পায়ে পায়ে।
গঙ্গার ওধারে সিমলাপাড়ায় খবর পৌঁছতে একটু দেরি হয়েছে। সকাল বেলায় খবর পেয়েই ভুবনেশ্বরী দেবী দৌহিত্র ব্রজমোহন ঘোষকে নিয়ে বিলাপ করতে করতে বেলুড়মঠে (Belur Math) ঢুকলেন। মুখে তাঁর একটাই কথা, আমার নরেন (Naren)চলে গেল....ও নরেন তুই ফিরে আয়...ছেলেকে শেষ দেখা দেখার পর সন্ন্যাসীরা তাঁকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে নৌকায় তুলে দিলেন। মাঝগঙ্গা থেকে তখনও ভেসে আসছে মা-ভুবনেশ্বরীর কান্না। নিবেদিতা ভাই মহেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করল, কি হল ব্যাপারটা। মহেন্দ্র জানালো, সবাই উনাকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। এরপর বিবেকানন্দের দেহটি নিয়ে সন্ন্যাসীরা এগিয়ে চললেন। স্বামীজির শেষকৃত্য সমাপনের নির্দিষ্ট স্থানে দেহ পৌঁছলো। স্থানটি বিবেকানন্দ নিজেই চিহ্নিত করেছিলেন মহাপ্রয়াণের কিছু দিন আগে, তাঁর প্রিয় বেলগাছের কাছে অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গায়।
দেহটি নামানো হলে নিবেদিতা (Nivedita) সেই গাছেরই একটু দূরে গিয়ে বসে পড়লেন। চিতাগ্নি প্রজ্বলিত করলেন। প্রথমে নিবেদিতা ও পরে একে একে গুরুভাই ও অন্যান্য সন্ন্যাসী-ভাইয়েরা অগ্নি প্রজ্বলন করলেন। চিতাগ্নির সামনে বিবেকানন্দের প্রিয় ‘জি.সি’ অর্থাৎ নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ (Girish Chandra Ghosh) বিলাপ করে বলে উঠলেন, “নরেন, তুমি তো ঠাকুরের ছেলে, ঠাকুরের কোলে গিয়ে উঠলে। আর আমি বুড়ো মানুষ, কোথায় তোমার আগে যাব, তা না হয়ে আজ আমাকে দেখতে হচ্ছে তোমার এই দৃশ্য!” এ কথা শোনামাত্র নিবেদিতা আর শোক চেপে রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে উঠে স্বামীজির প্রজ্বলিত চিতাগ্নির পাশে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করলেন। এ দৃশ্যে বিচলিত স্বামী ব্রহ্মানন্দ স্বামীজির (Swamiji) শিষ্য নিশ্চলানন্দকে নিবেদিতাকে চিতাগ্নির কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে বললেন। নিশ্চলানন্দ নিবেদিতাকে সেখান থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে, নানা সান্ত্বনাবাক্যে ভোলানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।
নিবেদিতা (Nivedita) একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন প্রজ্বলিত চিতার দিকে। দুচোখের জল তার বাধ মানছে না। নিবেদিতা (Nivedita) মনে মনে ভাবছিলেন গুরুর বস্ত্রখণ্ডের যদি একটা টুকরো পেতেন তো সযত্নে তা নিজের কাছে রাখতেন। হৃদয় হাহাকার করা সেই মুহূর্তে হঠাৎ নিবেদিতা (Nivedita) চমকে উঠলেন। দেখলেন চিতাগ্নি থেকে একখণ্ড গেরুয়া বস্ত্র হাওয়ায় উড়ে এসে নিবেদিতার কোলে এসে পড়েছে! পরম মমতায় ও যত্নে নিবেদিতা তা মাথায় ঠেকালেন। তাঁর প্রাণসখার অন্তিম স্মৃতি।
আরও পড়ুন- Bypoll: দেবতা 'পাথারো' অনুমোদন দেননি, তাই ওঁরা ৩০ অক্টোবর উপনির্বাচনে ভোট দেবেন না