যেসময় বেড়ালের বিয়ে দিতে রাজা জমিদার ও ব্যবসায়ীরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেন সেযুগে মতিলালের মত মানুষ সমাজ সংস্কারের জন্য অকাতরে দান করেছেন। স্কুল-কলেজ থেকে চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতির জন্য জনহিতকর নানা কাজ করেছেন কিন্তু ইতিহাস রামমোহন দ্বারকানাথ বিদ্যাসাগরকে মনে রাখলেও ভুলে গেছে মতিলাল শীলকে!
বিদ্যাসাগরের বহু আগে মতিলাল প্রথম ব্যক্তি যিনি বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন।শুধু তাই নয় বিধবা বিবাহকারীকে বিশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন প্রকাশ্যে। গড়েন সম্পূর্ণ অবৈতনিক ‘শীলস্ ফ্রি কলেজ’। গরীব রোগীদের জন্য বানিয়েছিলেন ‘ফিভার হাসপাতাল’। তাঁর দান করা জায়গাতে গড়ে ওঠে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। লিখছেন - অনিরুদ্ধ সরকার
ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ, এর জন্য জমি দান করেছিলেন মতিলাল শীল
১৮৩০ সাল। কলুটোলার শীল বাড়িতে ধর্মসভা বসেছে। সভার আলোচনার বিষয়, সতীদাহ প্রথা আটকানোর যে চেষ্টা চলছে তা শাস্ত্র বিরুদ্ধ, তার বিরুদ্ধে হিন্দুদের জনমত তৈরি করতে হবে। কলকাতার ধণাঢ্য শীল বাড়ির সন্তান মতিলাল শীল সাত্বিক বৈষ্ণব, ধর্ম মানেন অতএব রক্ষণশীলদের সঙ্গেই তিনি থাকবেন এই ভাবনা ভেবেই তাঁর বাড়িতে সভা ডেকেছেন পণ্ডিতরা। সভায় হাজির রাজা রাধাকান্ত দেব, মহারাজা কালীকৃষ্ণ ঠাকুর, গোপীমোহন দেব প্রমুখের মত মানুষ। মতিলাল এলেন এবং বললেন, " Sati Regulation Act-এর বিরোধিতা করে আজকের যে সভা বসেছে তা আসলে ‘ধর্মসভা নয় অধর্মসভা’। আমি সতীদাহ প্রথার পক্ষে নই, বিপক্ষে।" মতিলালের বিরোধিতার পরে আর এইধরনের 'ধর্মসভা’ হয়নি।এই সভার আহ্বায়কদের একদিন তিনি ডেকে বলেন, " অনাথ ও বিধবাদের দুঃখ মোচনের জন্য ‘সাহায্যভাণ্ডার’ গড়ুন।আমি আছি। এই কাজে আমি নিজে ত্রিশ হাজার টাকা দান করছি।" মতিলাল এধরণের তহবিল গড়তে চাইলে অন্যরা কেউই ই সাড়া দেননি।
মতিলাল শীল-এর ছবি, সৌজন্যে- মতিলালশীল ডট কম
যেসময় বেড়ালের বিয়ে দিতে রাজা জমিদার ও ব্যবসায়ীরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেন সেযুগে মতিলালের মত মানুষ সমাজ সংস্কারের জন্য অকাতরে দান করেছেন। স্কুল-কলেজ থেকে চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতির জন্য জনহিতকর নানা কাজ করেছেন কিন্তু ইতিহাস রামমোহন দ্বারকানাথ বিদ্যাসাগরকে মনে রাখলেও ভুলে গেছে মতিলাল শীলকে!
আরও পড়ুন- ইংরাজি শিক্ষার অন্ধভক্ত তখন বাঙালিরা, কিন্তু বিদ্যাসাগরের ছাত্রবৃত্তিতে সংস্কৃত টোল খুললেন ঠাকুরদাস
রামমোহনের হঠাৎ মৃত্যুতে ধাক্কা খেল একাধিক সমাজ সংস্কারের কাজ কিন্তু থামলেন না মতিলাল। বিদ্যাসাগরের বহু আগে মতিলাল প্রথম ব্যক্তি যিনি সমাজের সর্বস্তরে বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুললেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বিধবা বিবাহকারীকে বিশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন প্রকাশ্যে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনেক আগেই মতিলালের বিধবা বিবাহ-আন্দোলন নিয়ে ভারতবর্ষ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয় –"মতিলাল শীল হিন্দু বিধবার পুনর্বার বিবাহের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ঘোষণা করিয়াছিলেন যে যিনি সাহসপূর্বক সর্বপ্রথম বিধবা বিবাহ করিবেন তাঁহাকে তিনি কুড়ি হাজার টাকা দিবেন। এক ব্যক্তি এই পুরস্কার পাইয়া ছিলেন বলিয়া প্রকাশ।"
মতিলাল শীল-এর তৈরি করা অবৈতনিক কলেজ, ছবি সৌজন্যে- মতিলাল শীল ডট কম
বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ সালে বিধবা বিবাহ চালু হওয়া উচিত কি না এবিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন। ১৮৫৫ সালে ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন রাখেন। অনেক বিপত্তির পরে ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। ঠিক তার দুবছর আগে মতিলাল দেহ রাখেন।
আরও পড়ুন- Sekaler Galpo- শেঠ বৈষ্ণবচরণের ছিল গঙ্গাজলের ব্যবসা, আর সেই সূত্রেই উত্থান জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির
মতিলাল বুঝেছিলেন, দেশের মানুষকে শিক্ষার মধ্য দিয়েই আত্মশক্তিতে জাগরিত করতে হবে। একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপনের সংকল্প করেন। তার ইচ্ছের কথা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এক জেসুইট পাদ্রি। পাদ্রি মতিলালের সঙ্গে দেখা করে সমস্ত বিষয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। কলুটোলায় মতিলালের বাড়িতে ১৮৪৩ সালের ১ মার্চ একটি সভা হয়। আর সেই সভায় ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়টি পাকাপাকি ভাবে গৃহীত হয়। বিদ্যালয়টির নাম রাখা হয় হিন্দু কলেজের অনুকরণে ‘শীলস্ কলেজ’। সেখানে ছাত্রদের বই, খাতা, কলম ইত্যাদি বিনামূল্যে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমদিকে বিদ্যালয়ে এক টাকা বেতন নেওয়া হলেও পরে মতিলাল এই বিদ্যালয়কে সম্পূর্ণ অবৈতনিক করে দেন ও এর নাম হয় ‘শীলস্ ফ্রি কলেজ’। প্রথমে জেসুইট পাদ্রিরা শিক্ষা ও পরিচালন ব্যবস্থা দেখলেও পরে দেশীয় শিক্ষকদের ওপর সব দায়িত্ব অর্পিত হয়।
মতিলাল শীল-এর তৈরি করা অবৈতনিক কলেজ, ছবি সৌজন্যে- মতিলাল শীল ডট কম
হীরাবুলবুল নামে এক পতিতার ছেলের হিন্দু কলেজে পড়াকে কেন্দ্র করে সেই সময় বেশ আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। সংবাদপত্রে কয়েকদিন বেশ লেখালেখি হয়। গোঁড়া হিন্দুরা ক্ষুব্ধ হয়ে পতিতার ছেলেকে হিন্দু কলেজ থেকে বের করে দেন। একথা কানে গেল মতিলালের। তিনি পরামর্শ করলেন বউবাজারের রাজা রাজেন্দ্র দত্তের সঙ্গে। আর ঠিক তার পরেই দুজনে মিলে গড়ে তুললেন হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজ। আর সেখানে ভর্তি হল পতিতা হীরার ছেলে।
আরও পড়ুন- বরানগর খেয়া ঘাটে দাঁড়িয়ে গঙ্গার ওপারে বেলুড়কে দেখলেন স্বামীজি, বেলুড় মঠ তৈরির ইতিহাস যেন এক রূপকথা
মতিলাল শীল জন্মেছিলেন ১৭৯২ সালে। সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের একটি নিম্নবিত্ত পরিবার বলতে যা বোঝায় মতিলালের ছিল তাই। বাবা চৈতন্যচরণ শীলের কাপড়ের ব্যবসা ছিল তখনকার চীনাবাজারে। কিন্তু তিনি পিতাকে হারান মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। এক আত্মীয়ের সংসারে বাস করলেও পড়াশোনা বেশিদূর এগোয় নি। ১৪-১৫ বছর বয়স থেকেই ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির 'বেনিয়ান' হিসেবে কাজ করতে শুরু করে মতিলাল।
ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের স্কেচ, ছবি সৌজন্যে- মতিলাল শীল ডট কম
ইংরেজ কোম্পানির অধীনে সামান্য বেতনে কিছুকাল তিনি চাকরি করেন। তারপর অল্প পুঁজি নিয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করেন। একসময় তিনি জাহাজের কারবারে মন দেন। তিনি ছোট ও বড় মিলিয়ে বারো-তেরোটি জাহাজের মালিক হন। দেশি পণ্য নিয়ে তাঁর জাহাজ ভিড়তে থাকে পৃথিবীর নানান বন্দরে এবং ফেরে সেসব দেশের সামগ্রী নিয়ে। আরেক বাঙালি তখন জাহাজের কারবার করছেন, ঠাকুরবাড়ির প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি তখন জাহাজ তৈরি করছেন গার্ডেনরিচে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথম বাষ্পীয় পোত বা জাহাজ নির্মাণের পথিকৃৎ এই মতিলাল শীল। একসময় জাহাজ ব্যবসার গুরুত্ব কমে গেল। তখন মতিলাল জাহাজব্যবসা গুটিয়ে জমিদারি কিনলেন বাগনান, মঙ্গলঘাট ও মহিষাদলে। জ্যাকসন সাহেবের কাছ থেকে ধর্মতলা বাজারও কিনে নেন। এই মানুষটি দুর্গাপূজা করলেও বেশি আনন্দ পেতেন পুজোর সময় যদি কোনও মানুষ বিনাকারণে কারাবন্দি থাকত তো তা দেখে। মতিলাল নিজ খরচে পুজোর সময় দরিদ্র কারাবন্দি মানুষদের মুক্ত করতেন। পুজোয় আনন্দ করার জন্য টাকা দান করতেন।
মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের আগে সংস্কৃত কলেজের সঙ্গে একটি অস্থায়ী মেডিক্যাল কলেজ ছিল। সেখানে ত্রিশজনের মত রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করাতে পারতেন। এই অস্থায়ী মেডিক্যালের ব্যয়ভার বহন করতেন মতিলাল। ১৮৪০ সালে 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকা লিখেছে, "শ্রীযুক্ত বাবু মতিলাল শীল লক্ষমুদ্রা বার্ষিক ব্যয়ে ডাক্তার ওসাগ্রসী সাহেবের অধীনে গর্ভিণী স্ত্রী লোকদিগের উপকারার্থে এক চিকিৎসালয় স্থাপন করিয়াছেন।’'
মতিলাল শীল-এর তৈরি করা গঙ্গা ঘাট, ছবি সৌজন্যে- মতিলাল শীল ডট কম
তখনকার কলকাতায় ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, কালাজ্বর, টাইফয়েড এসব রোগ লেগেই থাকত। এইসব রোগীদের চিকিৎসার জন্য মতিলাল বানিয়েছিলেন ‘ফিভার হাসপাতাল’। সমাচার দর্পণ লিখছে – ‘শুনিলাম শ্রীযুক্ত বাবু মতিলাল শীল কুষ্ঠু রোগীদের বাস নিমিত্ত মীর্জাপুরে একটি স্থান করিয়াছেন।’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে গেলে আমরা যে " Mutty Lal Seal word " দেখি তা এই মতিলালের স্মৃতি রক্ষায় বানানো। ইংরেজ সরকারের প্রচেষ্টায় এবং দেশীয় ধনী ব্যক্তিদের উদ্যোগে যখন কলকাতায় একটি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন এগিয়ে আসেন মতিলাল। মতিলাল ছাড়াও প্রতাপ চন্দ্র সিংহ, সত্যচরণ ঘোষাল বিশেষ ভূমিকা পালন করেন মতিলাল জায়গা ছাড়াও মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য দিয়েছিলেন ১২০০০ টাকা। মেডিক্যাল কলেজের জন্য জমি দান করায় তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ির দক্ষিণ-পূর্বদিকের বাগানের পুরোটাই চলে যায় কলেজের জায়গায়, কিন্তু মতিলাল ভালো কাজে সব সময় সবার আগে থেকেছেন। প্রচারের জন্য কখনও কোনো কাজ করেন নি।
মতিলালের উদ্যোগে ধনী অথচ সমাজ হিতৈষি আগ্রহী ব্যক্তিদের নিয়ে একবার একটি সভা হয়। মতিলাল সেই সভায় জানান কলকাতার ১৬ মাইলের মধ্যে যেন কেউ অভুক্ত না থাকে তার ব্যবস্থা করা হবে। চোরবাগানের মার্বেল প্যালেসের প্রতিষ্ঠাতা রাজেন্দ্র মল্লিক কলকাতার অন্নসত্রের ভার নিলেন। আর মতিলাল নিজ দায়িত্ব বেহালা ও বেলঘরিয়া অঞ্চলে দুটি বিশাল অতিথিশালা নির্মাণ করান। যেখানে প্রতিদিন তিন-চার হাজার মানুষকে বিনামূল্যে খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়। মতিলাল ব্রিটিশদের দেওয়া রাজা, মহারাজা, রায়বাহাদুর, স্যার ইত্যাদি খেতাব গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলেন না।
আরও পড়ুন- প্রযুক্তিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া এবং সস্তা করাতে তিনি ছিলেন জাদুকর, চলে গেলেন হোম কমপিউটারের জনক
কলকাতায় সেসময় গঙ্গার ধারে ভালো ঘাট ছিল না। পুরনো ঘাটগুলিও সংস্কারের অভাবে তখন জরাজীর্ণ। মতিলাল তখন হাওড়া ব্রিজের দক্ষিণে আর্মানি ঘাটের
দক্ষিণে একটি সুন্দর স্নানের ঘাট নির্মাণ করালেন। ১৮৫৪ সালের ২১ মে মতিলালের মৃত্যু হলে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী এই ঘাটেই তাঁকে দাহ করা হয়।
ঋণ:
১| রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ- শিবনাথ শাস্ত্রী
২| দ্বারকানাথ ঠাকুর : বিস্মৃত পথিক- কৃষ্ণ কৃপালনী, অনুবাদ : ক্ষিতীশ রায়,
৩| বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ- বিনয় ঘোষ
৪| Lectures From Colombo to Almora : Swami Vivekananda, Advaita Ashrama, Kolkata.
৫| Mutty Lall seal : Kissory chaund Mitter, Edited by Syamal Das,