৮ সেপ্টেম্বর নেতাজির যে মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে দিল্লির কর্তব্যপথে ,সেই মূর্তি যিনি তৈরী করেছেন সেই অরুন যোগীরাজ এশিয়ানেট নিউজ এর সংলাপের মঞ্চে একান্ত আলাপচারিতায়। শোনালেন ২৮০ টন থেকে নেতাজি মূর্তি তৈরির পিছনের নানান অজানা কাহিনী
'এখনও পুরোটা স্বপ্ন মনে হয়'- এমনই উত্তর এসেছিলো যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে 'কেমন লেগেছিলো যখন কর্তব্যপথে আপনার বানানো মূর্তি স্থাপন করা হলো ?' ...ভারতবর্ষে এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে তাদের মধ্যে সাম্প্রতিকতম হল কর্তব্যপথে নেতাজি মূর্তি স্থাপন। আর এই পুরো বিষয়টির যিনি প্রধান কান্ডারি তিনি হলেন অরুণ যোগীরাজ। এশিয়ানেট নিউজ নেটওয়ার্কের বিশেষ সিরিজ 'সংলাপ'-এ একান্ত আলাপচারিতায় ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর অরুণ যোগীরাজ।
দক্ষিণ ভারতের মইসুরের এই ভাস্করকে আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম 'কেমন ছিল আপনার এই দীর্ঘ যাত্রাপথ ? মইসুরের একজন ছোট ভাস্কর থেকে ভারতের সেরা ভাস্কর হয়ে ওঠার গল্পটা ঠিক কেমন ছিল ?' শুনে দীর্ঘশ্বাস আর হাসির এক মিশ্রিত অভিব্যক্তি দিয়ে অরুণ বললেন , 'সে অনেক কাহিনি ,আমার যখন ১১ বছর বয়স তখন থেকেই বাবার সঙ্গে আমি ভাস্কর্য তৈরী করতাম, ভাস্কর্য তৈরি করতে করতেই আমার বড় হাওয়া। আমার যখন ৪-৫ বছর বয়স তখন আমি ক্রিকেট, ফুটবল না খেলে , পাথরের সঙ্গে খেলা করতাম। মনে আছে ছেলেবেলায় সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃরাশ খেয়েই ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে খেলা করতে শুরু করতাম। এটাই ছিল তখন আমার রোজকার রুটিন। তারপর যখন আমার ৭ বছর বয়স ,তখন থেকে এটিকে আমি শিল্প হিসাবে গুরুত্ব দিতে শুরু করি। আমার পড়াশুনা আর ভাস্কর্য একসঙ্গেই চলছিল। এমবিএ শেষ করার পর বেঙ্গালুরুতে একটি প্রাইভেট সেক্টরে চাকরিও করতে শুরু করি আমি। কিন্তু কোথাও সেসময় ভাস্কর্যকে খুব মিস করতে শুরু করলাম। এই সময়টাতেই উপলব্ধি করি যে জীবনে মন থেকে যদি কিছু করতে চাই , সেটা হল ভাস্কর্য । আমার পক্ষে ওটাকে ছেড়ে থাকা সম্ভব না। এরপর শুরু হলো নতুন এক লড়াই। নিশ্চিত চাকরিজীবন ছাড়তে চাই এটা যখন মাকে জানালাম তিনি প্রথমে কিছুতেই সম্মতি দেননি। কারণ তিনি দেখেছেন আমার বাবা ভাস্কর্যকে ভালোবেসে সারাজীবন কিভাবে কাটিয়েছেন। আমার বাবা দিনরাত কাজ করতেন। ঘামে, ধুলোয় ঢাকা এই কষ্টের মধ্যে বাবা কিভাবে থাকতেন সেটা মা দেখেছেন। তাই মা কোনোদিনও চাননি আমিও ওই জীবনটাই বেছে নেই। আমার মা সবসময় চেয়েছিলো আমি হোয়াইট কালারের চাকরি করি। দুবছর লেগে গেছিলো মাকে বোঝাতে।'
নেতাজি মূর্তির আগেও কেদারনাথের আদি শঙ্করাচার্যের ১২ ফুটের মূর্তি খোদাই করেছিলেন অরুণ। তারপর থেকে ভাস্কর হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পরে চারিদিকে। 'শঙ্করাচার্যের মূর্তি তৈরির পিছনের গল্পটা কেমন ছিল? কিভাবেই বা এই প্রকল্পের সঙ্গে আপনি ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়লেন?' প্রশ্ন করলে অরুণ বলেন, 'জে এস ডবলিউ-কে যখন কেদারনাথ পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তখন তাঁরা সারা ভারত জুড়েই শিল্পীদের খোঁজ করছিলেন। কর্ণাটকেও তাদের একটি অফিস রয়েছে। মোহন হাম্পি ইউনিভার্সিটির ভিজ্যুয়াল আর্ট বিভাগের প্রধান পাঞ্চাল আমার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করেছিল এই বিষয়ে । আমার কিছু কাজের ছবি উনি বলেছিলেন ওনার সঙ্গে শেয়ার করতে। আমিও করেছিলাম। তারপর আমি সিলেক্ট হই কর্ণাটক থেকে। প্রকল্পে যখন অংশ নিলাম আমাকে বলা হয়েছিল ছোট একটি আদি শঙ্করাচার্যের মূর্তি তৈরি করতে, যেটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সামনে পেশ করা হবে। এটা শুনে খানিক ভয় তো পেয়েছিলামই কিন্তু অনুপ্রাণিতও হয়েছিলাম খুব। পাথর খোদাই করে মাত্র ২০ দিনের মধ্যে তৈরি করেছিলাম শঙ্করাচার্যের মূর্তি। কাজটা সহজ ছিল একেবারেই। যখন হোমওয়ার্ক করছি তখন সামনে আদি শঙ্করাচার্যের একটা ছবি রেখেছিলাম শুধু। এই ছবিটি মাত্র ১ ডিগ্রি ভিউ দিয়েছিলো। কিন্তু ভাস্কর্য তৈরির জন্য যে কোনও জিনিসের ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ লাগে। তাই ওই ১ ডিগ্রি দেখে বাকি ৩৫৯ ডিগ্রি ভিউ আমাকেই খুঁজে বার করতে হয়েছিল। ভাস্কর্যটি তৈরির জন্য কৃষ্ণশীলা ব্যবহার করেছিলাম কারণ কৃষ্ণশীলা যে কোনও আবহাওয়াতেই একইরকম জৌলুস ধরে রাখতে পারে। আর সেভাবে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়াও করে না। সারাভারত থেকে প্রায় ৮ টা মডেল প্রধানমন্ত্রীর সামনে পেশ করা হয়েছিল। অবশেষে আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফোন পাই।'
নেতাজি মূর্তি তৈরির দায়িত্ব পাওয়াটা কে কিভাবে ডিফাইন করবেন ? প্রশ্নের উত্তরে অরুণ বললেন, 'চ্যালেঞ্জিং। দু-মাসের মধ্যে আমাকে ২৮ ফুটের একশিলা মূর্তি তৈরি করার দায়িত্ব ভার দেওয়া হয়েছিল। যে পাথর থেকে তৈরি হবে সেই পাথরটি ছিল স্টিলের মতো আর আমি যখন দেখেছিলাম তখন এটি ২৮০ টোনের ছিল। এটা ভারতের সবচেয়ে বড় গ্রানাইট ভাস্কর্য। এই ধরণের ভাস্কর্য আর ভারতে খুঁজে পাবেন না। অনেক চাপ ছিল। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এই চ্যালেঞ্জ সম্পূর্ণ করতেই হবে। ঠিক করেছিলাম তিনদিনের কাজ একদিনে করবো বা একদিনে তিন শিফটে কাজ করব। প্রাথমিকভাবে এইভাবেই পরিকল্পনা করেছিলাম। আর এই পরিকল্পনা কার্যকরিও হয়েছে। আমি তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং রাজস্থান থেকে কারিগরদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তারা তাদের সব কাজ ফেলে আমার ডাকে এসে আমার হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। আমাদের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টারই ফসল এটি।
নেতাজি মূর্তি তৈরির বিশদ বিবরণ জানতে চাইলে অরুণ জানান , '২৮০ টন পাথরকে কেটে কিভাবে নেতাজি মূর্তি বানানো হবে তার পরিকল্পনা করাটাই আসল ছিল। একটি খুব বড় ক্রেন এনেছিলাম আমরা যেটি পাথরটিকে উল্টোনোর কাজে বা ঘোরানোর কাজে ব্যবহার করতাম আমরা। কারণ পাথরটি ঘোরাতে যদি দুদিন সময় লাগে তাহলে দুদিন সময় আমরা হারাবো, তাই কাজটি শেষ হতে যেভাবে প্রশংসা পেয়েছে সেটি বেশ ভালো লাগার জায়গা'