চলন্ত ট্রেনে তরুণীকে গণধর্ষণের চেষ্টা, ৪০ ডাকাতের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেন সেনা জওয়ান, বিষ্ণু শ্রেষ্ঠার কাহিনি গায়ে কাঁটা দেয়

এ কোনও সিনেমার গল্প গাথা নয়। এক্কেবারে বাস্তবের মাটিতে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা। যার প্রেক্ষাপট আজ থেকে ১৩ বছর আগে। এক অসামান্য বীরত্বের প্রমাণ দিয়েছিলেন বিষ্ণু শ্রেষ্ঠা।

 

সালটা ২০১০। সেপ্টম্বরের ২ তারিখ। গোরখপুর থেকে রাঁচি যাচ্ছিলেন ভারতীয় সেনার গোর্খা রেজিমেন্টের নায়েক বিষ্ণু শ্রেষ্ঠা। চেপেছিলেন হাতিয়া-গোরখপুর ট্রেনে।  জানলার বাইরে সিন-সিনারি দেখতে দেখতে ভালোই যাচ্ছিলেন। রাত নামতেই ট্রেন প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গের সীমানায়। চিত্তরঞ্জন স্টেশনের আগে গভীর জঙ্গল। আচমকাই ট্রেনের কামরায় চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পান বিষ্ণু।

বিষ্ণু চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। আচমকাই দেখেন তাঁর চাদর ধরে কারা যেন টান মারছে। কোনওমতে হালকা আলোর কামরায় চোখ মেলে বিষ্ণু দেখেন তাঁর পায়ের কাছে বেশকিছু ষণ্ডা টাইপের লোক দাঁড়িয়ে। তাঁর কাছে যাবতীয় যা টাকা-পয়সা এবং মূল্যবান জিনিস রয়েছে তা ওই লোকগুলো চাইছে। বিষ্ণু বুঝতে পেরেছিলেন ডাকাত পড়েছে। তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন আমি ভারতীয় সেনার জওয়ান। তোমরা আমার কাছে জিনিস চাইছো!

Latest Videos

ডাকাতরা কথা না বাড়িয়ে বিষ্ণুর সামনে অন্যান্য সিটে থাকা যাত্রীদের মাল লুঠ-পাটে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আধ ঘুম চোখে বিষ্ণু চুপচাপ ডাকাতদের কীর্তি দেখছিলেন। জানতেন ডাকাতরা তাঁকেও ছাড়বে না। টাকা এবং মূল্যবান জিনিস যা চাইছে দিয়ে দিতেই হবে। বিষ্ণু তৈরিও হচ্ছিলেন ডাকাতদেরকে সর্বস্ব সমর্পণ করে দিতে। কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন এত জন ডাকাতের সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব।

মুহূর্তের মধ্যে সব যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। ডাকাতরা বিষ্ণুর সামনে বসে থাকা এক ১৮ বছরের তরুণীকে অপহরণের চেষ্টা করে। হাত ধরে ওই তরুণীকে ট্রেনের কামরার অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ডাকাতরা। যেভাবে তরুণীর হাত ধরে টান মারছিল এবং কথা বলছিল তাতে বিষ্ণু বুঝতে পেরেছিল আসলে ডাকাতরা ওই তরুণীর সঙ্গে কি করতে চলেছে। তখন অঝোরে কেঁদে চলেছে তরুণী। তাঁর আর্ত চিৎকারে গোটা কামরা কাঁপছে। তরুণী-র পরিবার পরিজন ডাকাতদের কাছে হাতজোর করে মেয়ের সম্মান ও জীবন ভিক্ষা চাইছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নায়েক পদে কর্মরত গোর্খা রেজিমেন্টের জওয়ান বিষ্ণু এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। চোখের সামনে এক বাচ্চা মেয়ের এমন করুণ পরিণতি মেনে নিতে তিনি রাজি ছিলেন না। সেনাবাহিনীতে নেওয়া সেই শপথ তখন যেন মনে মনে আওড়ে চলেছেন বিষ্ণু- করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।

চোখের পলকে বালিশের নিচে রাখা গোর্খাদের খুকুরিটা বের করে হাতে নিয়ে নেন। বিষ্ণু ঝাঁপিয়ে পড়েন ডাকাতদের উপরে। মুহূর্তের মধ্যে খুকুরির ধারাল আঘাতে এক্কেবারে শেষ করে দেন ডাকাতদলের ৩ জনকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ান বিষ্ণু-র তখন রুদ্রমূর্তি। যুদ্ধক্ষেত্রে গোর্খারা শুধুমাত্র খুকুরি হাতেই যে কোনও রেজিমেন্টকে নিকেশ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই যুদ্ধে কোনও গোর্খা খুকুরি হাতে তুলে নিলে হয়ে গেল- এমন প্রবাদ বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে।

সেনাবাহিনীর যে জওয়ান নিজেই কিছুক্ষণ আগে হত্যোদম হয়ে সিটে বসেছিল, সে আচমকাই এমন একটা দৈত্যের মতো মূর্তি কেন ধারণ করল বোধগম্য হচ্ছিল না ডাকাতদলের।

সেনাবাহিনীতে সমরাশক্তিতে প্রশিক্ষিত বিষ্ণুর ধারেকাছে তখন ঘেঁষতে পারছে না ডাকাতরা। মুহূর্তের মধ্যে আরও ৬ ডাকাতকে গুরুতর জখম করে ফেলেন বিষ্ণু। শুধুমাত্র খুকুরি হাতেই এদের প্রাণবায়ু প্রায় বের করে দিয়েছিলেন তিনি।

এদিকে, ডাকাতদলের বাকিরাও তখন ডাকাতি ভুলে বিষ্ণুকে কাত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এরমধ্যেই এক ডাকাতের ছোঁড়া গুলি অল্পের জন্য বিষ্ণু শরীর ঘেঁষে চলে যায়। ৪০ জন ডাকাতের সঙ্গে লড়়াই করা চাট্টিখানি কথা নয়। তারমধ্যে আবার চলন্ত ট্রেনের কামরায়!

ডাকাতরা বিষ্ণুকে কাত করে ফেলে এবং তাঁর হাত থেকে খুকুরি ছিনিয়ে নেয়। এরপর ডাকাতরা পাল্টা বিষ্ণুকে খুকুরি এবং অন্যান্য ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে।

ট্রেনের কামরায় মেঝেতে পড়ে তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছেন বিষ্ণু। কিন্তু লড়াই তিনি থামাননি। আবার উঠে ডাকাতদলের বিরুদ্ধে লড়তে থাকেন। রক্তাক্ত অবস্থায় বিষ্ণু শ্রেষ্ঠার সেই মূর্তি দেখে ভয় পেয়ে যায় ডাকাত দলের বাকি সদস্যরা। তারা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন আজ বিষ্ণুর মাথায় খুন চেপেছে। কাউকে তিনি ছাড়বেন না।

চিত্তরঞ্জন স্টেশনে ট্রেন ঢোকার আগেই লুঠের মালপত্র ফেলে ডাকাত দলের লোকজন চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ মেরে পালিয়ে যায়। চিত্তরঞ্জন স্টেশনে ট্রেন থামার পর যখন রেলপুলিশ কামরায় ওঠে তারা তখন আতঙ্কিত। চারিদিকে রক্তের বন্যা যেন বয়ে যাচ্ছে। তার মাঝে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন বিষ্ণু। ঘটনাস্থল থেকে বিষ্ণুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ২ মাস ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা চলে তার। ট্রেনের কামরা থেকে পুলিশ ৩ ডাকাতের মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল। এছাড়াও আরও ৮ ডাকাতকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এদের সকলকেই গ্রেফতার করে রেল পুলিশ।

এছাড়াও ঘটনাস্থলে ডাকাতদের কাছ থেকে ১০ হাজার নগদ, ৩৪টি লুঠ করা মোবাইল ফোন, অসংখ্য ল্যাপটপ এবং অসংখ্য সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর গয়না, ঘড়ি উদ্ধার করা হয়। পরে রেল পুলিশ জানায় এই ঘটনার তল্লাশি চালিয়ে পরে আরও ৪ লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয় এবং আরও কিছু ডাকাতকে গ্রেফতার করা হয়।

২ মাস হাসপাতালে থাকার পর ছাড়া পান বিষ্ণু। তাঁকে শৌর্য পদক দিয়ে সম্মান জানায় ভারতীয় সেনা। সম্মানিত হন উত্তম জীবন রক্ষা পদক দিয়েও। টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আক্ষেপ করেছিলেন বিষ্ণু। জানিয়েছিলেন তিনি যখন লড়াই করছিলেন কামরায় থাকা যাত্রীদের কেউ এগিয়ে আসেনি। প্রত্যেকেই আতঙ্কিত হয়ে ডাকাত দলের নির্দেশ মানছিলেন। বিষ্ণু ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করলেও আদপে নেপালের পারবাতের বাসিন্দা। সাক্ষাৎকারে তিনি সংবাদমাধ্যমকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেছিলেন, সংবাদমাধ্যম তাঁর সম্পর্কে যদি খবর না করতো তাহলে হয়তো তাঁকে সেদিন পুলিশ খুন এবং ট্রেনের কামরায় মারামারির অভিযোগে গ্রেফতার করে নিতে পারতো।

যে তরুণীর প্রাণ ও সম্মান বাঁচিয়েছিলেন বিষ্ণু, সেই পরিবার তাঁকে বিশাল অঙ্কের অর্থ পুরষ্কার হিসাবে দিতে চেয়েছিল। বিষ্ণু সম্মতি দেননি। তিনি ওই তরুণীর পরিবারকে জানিয়েছিলেন একজন যোদ্ধা হিসাবে ওটা তাঁর কর্তব্য ছিল। হায়! আরও মানুষ যদি বিষ্ণু-র মতো ভাবতে পারতেন, তাহলে হয়তো সমাজের বুকে দুর্নীতি-খুনোখুনির সংখ্যাটা এক্কেবারে নেমে যেত। বিষ্ণুর এই অসামান্য লড়াই নিয়ে বলিউডে সিনেমা বানাতে রাইটসও কেনেন হিমেশ রেশমিয়া। কিন্তু, সেই ছবি এখনও দিনের আলো দেখেনি। তবে, বিষ্ণু শ্রেষ্ঠার এই বীর গাথা আজও যে কোনও অসহায়দের কাছে প্রেরণার।
আরও পড়ুন--  
ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী ও প্রাণঘাতী করতে ৬টি প্রকল্প, যা অনেকবেশি প্রযুক্তি নির্ভর 
এরো ইন্ডিয়া শো ২০২৩ জেট স্যুটে উড়বে ভারতীয় সেনা জওয়ানরা, দেখুন ভিডিও  
সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে মাল্টি রোল হেলিকপ্টার, শক্তিশালী হবে ভারতীয় সেনা
 

Share this article
click me!

Latest Videos

শীতের রাতে যমুনার আতঙ্ক! একের পর এক জঙ্গল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাঘিনী | Bandwan Tiger News
চমকে উঠবেন! কৃষ্ণনগর পক্সো আদালতের বড় সাজা ঘোষণা | Nadia Latest News
জঙ্গি গ্রেফতারে কড়া বার্তা মিঠুনের | Mithun Chakraborty #shorts #mithunchakraborty #shortsvideo
Viral Video! আবাসের টাকা ঢুকতেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাটমানি চাইছেন TMC কর্মী | Murshidabad Latest News
'তৃণমূলের দুয়ারে সরকার এখন দুয়ারে জঙ্গি', তীব্র আক্রমণ শুভেন্দু অধিকারীর | Suvendu Adhikari