গত ২০ বছর ধরে আমেরিকা (USA) আফগানিস্তানের (Afghanistan)মাটিতে সেনা মোতায়েন করে রেখেছি। কুড়ি বছর তালিবানদের সঙ্গে নিরন্তন যুদ্ধ চালিয়ে গেছে আমেরিকা ও আফগানিস্তান সরকার। তারপর তালিবানরা জয় পেয়েছে। যা তাদের রীতিমত উৎসাহিত করেছে।
দীর্ঘ যুদ্ধের পর কাবুলের দখল নিয়ে তালিবানরা (Taliban)। তারপর থেকে আতঙ্ক বাড়ছে সেদেশের জনগণের মধ্যে। বিশেষ করে মহিলাদের অকল্পনীয় ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। যা নিয়ে গোটা বিশ্বই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে ভারতও (India) তালিবানদের এই ক্ষমতাদখল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এটি ভারতের কাছে যথেষ্ট উদ্বেগেরও।
গত ২০ বছর ধরে আমেরিকা (USA) আফগানিস্তানের (Afghanistan)মাটিতে সেনা মোতায়েন করে রেখেছি। কুড়ি বছর তালিবানদের সঙ্গে নিরন্তন যুদ্ধ চালিয়ে গেছে আমেরিকা ও আফগানিস্তান সরকার। তারপর তালিবানরা জয় পেয়েছে। যা তাদের রীতিমত উৎসাহিত করেছে। যা আফগানিস্তানের আশেপাশের দেশগুলির রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও যথেষ্ঠ প্রভাবিত করবে। কাবুলের পতনের প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে। এক নজরে দেখেনিন প্রতিবেশী দেশগুলির প্রতিক্রিয়া।
Ladakh Standoff: রবিবার আলোচনার টেবিলে ভারত-চিন সেনা কর্তারা, জোর হটস্প্রিং-এর ওপর
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রতিক্রিয়াঃ তালিবানরা কাবুল দখলের পর তার প্রথম প্রতিক্রিয়াই ছিল 'দাসত্বের শেকল ছিঁড়ে ফেলা'। তালিবান পরিচালিত আফগানিস্তান থাকবে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। তালিবানরা যখন আগে আফগানিস্তানের শাসনভার নিয়েছিল ১৯৯৬-২০০১ তখন পারিস্তান তাদের ইন্টার সার্ফভিসেস ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা আইএসআইকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে কাজ করতে। এবার পারিস্তানের ক্ষমতা কিছুটা কম বলেও মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আইএসআই প্রধান ফয়েজের আফগান সফর তালিবান সরকার গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যা কখনই বাধা দেয়নি পাকিস্তান সরকার।
কিন্তু চিন কিছুটা দূরে থেকেও আফগানিস্তানে তালিবানদের মদত দিচ্ছে। চিন গোটা পরিস্থিতিকেই সংবেদনশীল হিসেবে বর্ণনা করেছে। তবে চিন জানিয়েগিয়েছেন যে তারা তালিবান সরকারের পাশে থাকবে। উন্নয়নের কাজে সহযোগিতা করবে। চিন আফগানিস্তানে ইতিমধ্যে ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। পাশাপাশি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশও হয়েছে আফগানিস্তান।
'দয়া করে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসটা দেখুন', কেন সাধারণের কাছে এমন আর্জি স্বাস্থ্য মন্ত্রকের
একই সঙ্গে চিন তালিবানদের সঙ্গে ব্যবসা করার কথাও ঘোষণা করেছে। চিনের মূল উদ্দেশ্যই হল আর্থিক ও কৌশলগত লাভ। আফগানিস্তানে যথেষ্ট পরিমাণে খনিজ পদার্থ রয়েছে। সেগুলির ওপরেও নজর রয়েছে চিনের।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের নতুন উপপ্রধানমন্ত্রী মোল্লা আব্দুল ঘানি বরাদর ইতিমধ্যেই চিন সফর করেছেন। আফগানিস্তান ও চিন দুটি দেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চিন সংখ্যালঘু মুসলিম নাগরিকদের অত্যাচার চালিয়ে গেলেও সেদিকে নজর দেয়নি তালিবানরা। তারা জানিয়েছেন চিন তাদের বিশ্বস্ব বন্ধু। তার আরও একটি কারণ রয়েছে তালিবানরা আফগানিস্তান দখল করার সময় যে বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ হয়েগিয়েছিল। সেই আর্থিক অনটক দূর করতে সেই সময় চিন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এটা পরিষ্কার যে আফগানিস্থানে চিনের বিশাল অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রয়েছে।
Taliban: ভারত বিরোধী সুর তালিবান নেতার, মাহমুদ মাজার পরিদর্শন করে কী বললেন হাক্কানি
আফগানিস্তানে তালিবানদের সঙ্গে চিন আর পাকিস্তানের ঘনিষ্ট হওয়ার ভারতের কাছে রীতিমত উদ্বেগের। ভারত পাকিস্তানের দীর্ঘ দিনের টার্গেট। সশস্ত্র জঙ্গিদের আর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে পাকিস্তান। ২০০৮ সালে মুম্বই হামলা যার প্রমাণ। অন্যদিকে চিনও ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী। ভারতের কাছে সামরিক ও কৌশগত হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চিন।তার আফগানিস্তান-চিন-পাকিস্তান একই সঙ্গে ভারতের কাছে একটি বড় আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তালিবানদের আফগানিস্তান দখল কেবলমাত্র ভারতীয়দের কআছে একটি কৌশলগত ঝুঁকি নয়। এটি পাকিস্তানের আইএসআইকেও যথেষ্ট মদত দিচ্চে। আফগানিস্তান ইস্যুতে ভারত বরাবরই পাকিস্তান বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। শেষবার তালিবানরা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন পঞ্জশিরে আহমেদ শাহ মাসুদকে পুরোপুরি সমর্থন জানিয়েছিল ভারত। কিন্তু এবার চিন এই বিষয় কিছুটা নীরব। রাশিয়া ও ভারত বিরোধী অবস্থান গ্রহণ না করলেও চিন নিরপেক্ষ পথ নিয়েছে।
অন্যদিকে ইরানও তালিবানদের স্বীকৃতি দিতে রাজি। তাদের একটামাত্র শর্ত রয়েছে। সেটা হল আগের বারের মত শিয়া-বিরোধী নিপীড়ণ চালান যাবে না। তবে ইনার ও রাশিয়া মার্কিন সেনা প্রত্যাহারেই খুশি হয়েছে। আফগানিস্তান নিয়ে তাদের এখনও পর্যন্ত আর তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি।
যদিও ভারতীয় কূটনীতিকরা এখনও পর্যন্ত তালিবান প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। জুন মাসে দোহায় তালিবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভারতীয় কূটনীতিক। ভারত মূলত বরাদর ও শের মহম্মদ আব্বাস স্টানিকজাইয়ের সঙ্গেই কথাবার্তা বলছে।
অন্যদিকে তালিবানদের একটা অংশ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাইছে। তাদের মধ্য একজন হলেন বরাদর। তিনি পাকিস্তানের জেলে আট বছর কাটিয়েছিলেন। ধরে নেওয়া যেতেই পারেন বরাদারের পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। তালিবানরও ভারত বিরোধী বার্তা তেমনভাবে দেয়ি। তবে কাশ্মীর ইস্যুতে তালিবানরা যে মুসলিমদের পাশে রয়েছে সেই বার্তা ইতিমধ্যেই দিয়েছে।
যদিও পাকিস্তানের হাতে খুববেশ তালিবান রাশ নেই। তারই কাবুল বিমান বন্দরে আইসিস বোমা হামলা চালিয়েছিল। বর্তমানে আইসিসরা তালিবানদের বিরুদ্ধেপন্ধী হিসেবে পরিচিত। দুটি জঙ্গি সংস্থাকেই পাকিস্তান পদন দিয়ে যাচ্ছে। তাই পারিস্তানও তালিবানদের নিয়ে এখনও খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য নয় - তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অন্যদিকে আফগানিস্তানে ভারতের তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। বাঁধ, সড়ক, বিদ্যুতের গ্রিড, হাসপাতাল, স্কুল এমনকি সংসদ ভবন তৈরি করছিল ভারত। সেগুলি এখনও তালিবানদের হাতে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বারবার মুসলিম বিরোধী বক্তব্য ও আভ্যন্তরীন নীতির ফলে সেই কাজ বাধা পেতে পারে। কারণ আভ্যন্তরীন নীতি মুসলিম বিরোধী অসন্তোষ তৈরি করতে পারে।
ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া নিয়ে চতুর্ভূজ অংশীদাতিত্ব ভারত মহাসাগরে ভারতের সামুদ্রিক উপস্থিতিতে শক্তিশালী করে। কিন্তু ভারতের প্রধান হুমকি হল চিন আর পাকিস্তান। দুটি দেশের সঙ্গেই ভারত স্থল সীমান্ত ভাগ করে নেয়। সেখানে কোয়াড খুব বেশি ব্যবহার করা সম্ভব নয়। ভারতের উত্তর -পশ্চিমে তালিবান শাসন, পশ্চিমে পারমাণবিক শক্তিধর ও সন্ত্রাসবাদ সমর্থনকারী দেশ আর উত্তর পূর্বে একটি প্রতিকূল প্রতিবেশী দেশ রয়েছে। যার দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য চলমান হুমকির মুখোমুখি। পাশাপাশি আগামী দিনে ভারতের কূটনৈতিক কাছে তা রীতিমত চ্যালেঞ্জের হয়ে দাঁড়াবে।
(লেখক রাষ্ট্র সংঘের প্রাক্তন আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল ও ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও মানব সম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী শশী থারুর। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাংসদ। নিবন্ধটি প্রজেক্ট সিন্ডিকেট পাটনারশিপ ২০২১ এর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে)