১৯৭৫ সালে ২৫ জুন দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরি অবস্থাকে ভারতের রাজনীতির সমচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায় বলা হয়। জরুরি অবস্থা জারির পরেই দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। সেই সময় প্রচুর বিরোধী নেতাকে জেলে পোরা হয়। যদিও অনেকে আবার এর পক্ষেও সওয়াল করেছিলেন। তবে দিন দিন চাপ বাড়তে থাকে ইন্দিরা সরকারের উপর। জরুরি অবস্থা তোলার দাবিতে জোরালো হতে থাকে আন্দোলনও। তাই শেষপর্যন্ত ২১ মাস পর ১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ এই জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু জানেন কি জরুরি অবস্থার সঙ্গে যোগ রয়েছে ভারত সরকারের নিজের উদ্যোগে তৈরি প্রথম কোল্ড ড্রিঙ্কের? তাহলে শুনুন সেই গল্প।
শোনা যায় জরুরি অবস্থা তোলা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী সরকারি সংস্থাগুলির মাধ্যমে দেশের মানুষের মতামত জানার চেষ্টা করেছিলেন। ঠিক অনেকটা এখনকার এক্সিটপোলের মত। তিনি জানতে চান, জরুরি অবস্থা তুলে সাধারণ নির্বাচন হলে তাঁর ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা কতখানি। সেই সময় তাঁকে বলা হয়, তিনি আবার বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরবেন। তাই ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা তুলে নিয়ে দেশের ষষ্ঠ লোকসভা নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধিকে যা ভেবেছিলেন, ফল হয়েছিল ঠিক তার উল্টো। নির্বাচনে হেরে যান নেহেরু কন্যা। ক্ষমতায় আসে জনতা পার্টির জোট সরকার।
১৯৭৭ সালে জানুয়ারিতে জোট সরকারের হয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন মোরারজি দেশাই। মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গেই শপথ নিয়েছিলেন ১৪ জন ক্যাবিনেট মন্ত্রীও। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ। যিনি কেন্দ্রীয় শিল্প মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। সেই বছরই তৈরি হয় ভারতের ‘বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন ’ আইন। এই আইনের ফলে ভারত থেকে ব্যবসা গোটানোর জন্য চাপ বাড়ে মার্কিন বহুজাতিক কোলড্রিঙ্কস সংস্থা ‘কোকা কোলা’-র উপর। কোকা কোলা-কে দেশ ছাড়ার জন্য চাপ দেন খোদ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজও। কারণ তিনি মনে করতেন বাইরের কোম্পানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির উপর বিদেশি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রভাব বিস্তার করছে।
নতুন আইনের ফলে কোকা কোলার সামনে দু’টি রাস্তা ছিল। হয় ভারত থেকে ব্যবসা গোটাতে হবে। না হয় কোকা কোলার ফর্মুলা সরকারের সামনে আনতে হবে। অর্থাৎ ভারতে ব্যবসার ৬০ শতাংশ কোনও ভারতীয় কোম্পানির হাতে দিতে হবে। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই কোকা কোলা তাদের স্বাদের রহস্য কখনও প্রকাশ্যে আনেনি। বহু গবেষণা হয়েছে এই স্বাদের রহস্য জানার জন্য। কিন্তু সংস্থার শীর্ষ স্থানীয় কয়েক জন ছাড়া কোকা কোলার ফর্মুলা আজও কেউ জানেন না। সেই ধারা সংস্থাটি বর্তমানেও বজায় রেখেছেন।
আরও পড়ুন: দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা এবার ১৭ হাজারের কাছাকাছি, রাশিয়াকে টপকাতে আর বেশি দেরি নেই
স্বাধীনতার পরর ১৯৫০ সালে নতুন দিল্লিতে কোকা কোলার প্রথম বটলিং প্লান্ট তৈরি হয়েছিল। ইন্দিরা জমানার পর জোট সরকারের আমলে কোকা কোলা তাই কোনও ভাবেই তাদের স্বাদের গোপন রহস্য ফাঁস করতে রাজি ছিল না ভারত সরকারের কাছে। ফলে সেই সময় এদেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তই নেয় কোকা কোলা। এদেশে ব্যবসা স্থাপনের ২৭ বছর পর তা গুটিয়ে নিয়ে চলে যেতে হয় এই মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাকে। যদিও দেশে বিলগ্নীকরমের হাওয়ায় ১৯৯২ সালে ফের ভারতে পা রাখে কোকা কোলা। ১৯৯৩ সাল থেকে এদেশে ফের উৎপাদন শুরু হয়।
এদিকে ১৯৭৭ সালে কোকা কোলার ভারত ছেড়ে যাওয়ার পর জনতা সরকারের কাছে অন্য এক সমস্যা এসে উপস্থিত হয়। কোকা কোলায় কাজ করা কয়েক হাজার কর্মী বেকার হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। পরিস্থিতি সামলাতে কেন্দ্রের জনতা সরকার তাই নিজেদের উদ্যেগে কোলা ড্রিঙ্ক উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই ‘স্বদেশী’ কোলার নাম রাখা হয় ‘ডবল সেভেন’ বা ‘৭৭’। এই নাম রাখা হয় ইন্দিরা গাঁধীর জারি করা এমার্জেন্সি শেষ হওয়ার বছরের (১৯৭৭) কথা মাথায় রেখেই।
সেই সময় ডবল সেভেন কোলার পাশাপাশি লেমন ফ্লেভারের ড্রিঙ্ক বাজারে এনেছিল। তবে সেই যাত্রা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কোকা কোলা ভারত ছেড়ে যাওয়ার পর সেই খোলা বাজার দখল করতে ডবল সেভেনর প্রতিযোগী হয়ে ওঠে আরও অনেক ভারতীয় সংস্থা। জনতা সরকার প্রচুর চেষ্টা করেও ‘স্বদেশী’ ডবল সেভেনের ব্যবসা বাড়াতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু বেসরকারি সংস্থাগুলির চাপে ডবল সেভেন ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকে ব্যবসায়। তার বদলে অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার কোলা বা ড্রিঙ্কগুলি জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: জরুরি অবস্থা থেকে নসবন্দি, ইন্দিরার প্রতিটি সিদ্ধান্তেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সঞ্জয়ের
তবে জোট সরকারের স্থায়িত্বকাল বেশি ছিল না। রাজনৈতির অস্থিরতার কারণে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই। তার জায়গায় ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হন চরণ সিং। কিন্তু সহযোগী দলগুলি একে একে সমর্থন তুলে নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রথম অকংগ্রেসী সরকার পতন ঘটে ১৯৮০ সালে। এরপরে দিল্লির মসনদে ফের শুরু হয় ইন্দিরা জমানার। ইন্দিরা গাঁধীর নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই ডবল সেভেনের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে যায়। জন্মের পর মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় ভারতের প্রথম এবং শেষ সরকারি উদ্যোগে তৈরি ‘স্বদেশী’ কোলা, ডবল সেভেন। যদিও এই তিন বছরেই ভারতের রাজনৈতিক ওঠাপড়ার অনেক ইতিহাস ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষী ছিল সে।