সোমবার চার বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হল মায়ানমারের (Myanmar) ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রনেতা আং সান সু চি'কে (Aung San Suu Kyi)। কীভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী হিরো থেকে ভিলেন হয়ে গেলেন?
নায়ক থেকে খলনায়ক হয়ে ওঠার এমন নিদর্শন গোটা বিশ্বেই বিরল। মায়ানমারের (Myanmar) ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রনেতা আং সান সু চি'কে (Aung San Suu Kyi) সোমবার চার বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হল। এর আগে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারী, সেই দেশের সামরিক বাহিনী এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাঁর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছিল। তারপর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে এক ডজনেরও বেশি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারই প্রথম মামলায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় আইন লঙ্ঘনের দায়ে ৭৬ বছরের সু চি'কে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
মায়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক আং সানের কন্যা সু চি। ১৯৪৭ সালে আং সান যখন নিহত হন, সেই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২ বছর। প্রথম জীবনের বেশিরভাগটাই তাঁর বিদেশে কেটেছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, সেখানেই দেখা হয়েছিল স্বামী, ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ মাইকেল অ্যারিসের সঙ্গে। তাঁদের দুই ছেলেও আছে। ১৯৮৮ সালে মা মরণাপন্ন শুনে, দেশে ফিরে এসেছিলেন সু চি। আর দেশ ছাড়েননি। রাজধানী ইয়াঙ্গনে, তৎকালীন জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সু চিকে তার লেকের পাশের বাড়িতে বন্দী করেছিল সরকার। সেই সময় থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত গৃহবন্দি ছিলেন তিনি।
তাঁর উদ্যোগেই মায়ানমারের জুন্টা সরকারের মানবাধিকার হননের প্রতি নজর পড়েছিল বহির্বিশ্বের। যার জন্য ১৯৯১ সালে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার পর, তিনি ইয়াঙ্গনের বাইরে সমর্থকদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পথে, সেনাবাহিনী তাঁকে আটকেছিল। প্রচন্ড গরমে ডিহাইড্রেশন হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর ভ্যানের ভিতরেই বেশ কয়েক দিন এবং কয়েক রাত কাটিয়েছিলেন। ছাতা খুলে বৃষ্টির জল ধরে, তা পান করতেন। ২০০৩ সালে জুন্টা-পন্থীরা তাঁর কনভয়ে হামলা চালিয়েছিল। তাঁর বেশ কিছু সমর্থক হতাহত হলেও, বেঁচে গিয়েছিলেন সু চি। এরপরই আবার সেনাবাহিনী তাঁকে গৃহবন্দী করে। তবে সেখান থেকেও প্রতি সপ্তাহে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশ্যে নিয়মিত ভাষণ দিতেন, গণতন্ত্রের কথা বলতেন।
আরও পড়ুন - ফের সেনার দখলে মায়ানমার, আটক সুপ্রিম নেত্রী 'সান সু কি', দেশে জারি জরুরি অবস্থা
আরও পড়ুন - সেনার তাড়া খেয়ে মায়ানমার থেকে ভারতে, ১৯ অনুপ্রবেশকারী পুলিশ কর্তা চাইছেন আশ্রয়
২০১০ সালে, ভিতরের ও বাইরে চাপের মুখে মাযানমারের জুন্টা সরকার বেশ কিছু গণতান্ত্রিক সংস্কার করে। সু চিকেও মুক্তি দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে সালের সেই দেশে ৫০ বছরেরও বেশি সময় হওয়া নির্বাচনে বিশাল জয়লাভ করেছিলেন সু চি। এই অবধি দেশে ও বহির্বিশ্বে নায়ক ছিলেন সু চি। ২০১২ সালে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে মায়ানমার সফরে গিয়েছিলেন বারাক ওবামা। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বারাক, আরেক নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সু চি-কে 'তাঁর এবং সারা বিশ্বের মানুষের অনুপ্রেরণা' বলে অভিহিত করেছিলেন।
তবে, ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মধ্য়েই সু চির এই নায়কের তকমা বাষ্পের মতো উবে গিয়েছিল। রোহিঙ্গা জঙ্গিরা মায়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা চালিয়েছিল। জবাবে, ভয়ানক আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল সামরিক বাহিনী। যার ফলে সাড়ে সাত লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা, মায়ানমার ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাষ্ট্রসংঘ ২০১৮ সালে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছিল, মায়ানমার সেনাবাহিনী নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও গণধর্ষণ করেছে। কিন্তু, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে, সু চি রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের সামনে, এই সামরিক অভিযানের পক্ষেই সওয়াল করেন। তাঁর দাবি ছিল, এটা সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ছাড়া কিছু নয়। দেশে তখনও তাঁর জনপ্রিয়তা না পড়লেও, আন্তর্জাতিক মহলে তখন থেকেই ভিলেন হয়ে যান সু চি।
আর নিয়তির এমন পরিহাস, সামরিক অভ্যুত্থানের ১৪ মাস আগে, যে সামরিক জেনারেলদের জন্য রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতে লড়াই করেছিলেন সু চি, তারাই আজ তাঁকে কারাবন্দি করল। ২০২০ সালের নভেম্বরে তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই সামরিক বাহিনী অস্বস্তিতে পড়েছিল এবং তা থেকেই ঘটেছিল অভ্যুত্থান, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। ১৫ বছর গৃহবন্দী থেকে যে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিলেন তিনি, সেই গণতন্ত্রকেই নয়ছয় করার, ভোটে জালিয়াতি করার অভিযোগ উঠেছে তাঁর এবং তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি পার্টির বিরুদ্ধে৷ জনগণকে উসকানি দেওয়া, দুর্নীতি এবং অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট লঙ্ঘন-সহ আরও অনেক গুরুতর অভিযোগ করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। যা থেকে সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ বছরেরও বেশি সাজা পেতে পারেন তিনি।