'বাধা সরিয়ে আসছে পেশা স্বাধীনতা', সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে আরও এক জয় দেখছে সোনাগাছি

পুলিশ প্রশাসনের খবরদারি, রাজনৈতিক দাদাগিরি থেকে শুরু করে যখন তখন ক্রেতাকে তুলে নিয়ে যাওয়া অথবা যৌনকর্মীদের যখন-তখন আটক করা এবং যৌনকর্মীদের ছেলে-মেয়েদের হেনস্থা এসবই গাসওয়া হয়ে গিয়েছে সোনাগাছির। তবে এই সমস্যা যে একাই সোনাগাছি পোহাচ্ছে এমনটা নয়, এই ছবিটা দেশের প্রতিটি যৌনপল্লির। 

debojyoti AN | Published : May 28, 2022 3:35 AM IST / Updated: May 28 2022, 09:25 AM IST

কেউ হতে চায় ডাক্তার, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু যিনি যৌনকর্মী হতে চান! তার জন্য কি আজও সমাজ দরাজহস্ত? সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি এল নাগেশ্বরা রাও, বিচারপতি বি আর গিভাই এবং বিচারপতি এ এস বোপান্না বৃহস্পতিবার তাঁদের যে পর্যবেক্ষণ এবং মতামত ব্যক্ত করেছেন তাতে এখন আশার আলো দেখছে সোনাগাছি। শুধু কলকাতা বা ভারতবর্ষ নয় এশিয়ার সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি। যেখানে অতিমারির সঙ্কটের পরও কাজ করছেন অন্তত দশ হাজার যৌনকর্মী। পুলিশ প্রশাসনের খবরদারি, রাজনৈতিক দাদাগিরি থেকে শুরু করে যখন তখন ক্রেতাকে তুলে নিয়ে যাওয়া অথবা যৌনকর্মীদের যখন-তখন আটক করা এবং যৌনকর্মীদের ছেলে-মেয়েদের হেনস্থা এসবই গাসওয়া হয়ে গিয়েছে সোনাগাছির। তবে এই সমস্যা যে একাই সোনাগাছি পোহাচ্ছে এমনটা নয়, এই ছবিটা দেশের প্রতিটি যৌনপল্লির। এর মানে যৌন ব্যবসাকে আজও সমাজের বিভিন্ন প্রান্তে অবেহলা এবং দাদাগিরি ফলানোর একটা স্থান হিসাবেই দেখা হয়। সোনাগাছির যৌনকর্মীদের আশা সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে এবার হয়তো একটা আইন সুরক্ষা তৈরি হল তাঁদের জন্য। 

কথা হচ্ছিল সোনাগাছির যৌনকর্মী বিশাখা নস্কর-এর সঙ্গে, যিনি আবার বর্তমানে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির প্রেসিডেন্ট। যৌন কর্মীদের অধিকার রক্ষা এবং যৌনপল্লিগুলি উন্নয়নে সওয়াল করতে প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করে আসছে দুর্বার। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের নির্দেশে তাঁরাও এখন এতে জয় খুঁজে পেয়েছেন। বিশাখা জানিয়েছেন, 'দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে আমরা যৌনকর্মীরা আন্দোলন করছি যে আমাদের আইনি সুরক্ষা কবচ দেওয়ার জন্য। আমরা যে একটা পেশাকে বেছে নিচ্ছি এবং সেই পেশাকে সম্মানের সঙ্গে আমাদের করতে দেওয়া উচিত, সেটা কখনই হয়ে ওঠে না। একদিকে প্রশাসনের ধরপাকড়, তল্লাশি লেগেই থাকে, সেই সঙ্গে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের সমানে আমাদের উপরে দাদাগিরি চলতে থাকে। এখান থেকে আজও আমরা মুক্তি পাইনি। কোনও সাধারণ লোকালয়ে তো এমন অত্যাচার হয় না। আর যদি হয় তাহলে তো প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু যৌনপল্লিগুলোতে ঠিক এর উলট পূরাণ। অত্যাচারের প্রতিবাদ তো করাই যায় না, উল্টে অত্যাচারের বহরটা বেড়েই যায়, কমে আর না। এখন সোনাগাছি-সহ বেশকিছু যৌনপল্লিতে দুর্বারের সংগঠন অতি সক্রিয় তাই এখানে লড়াইয়ের একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু, রাজ্যের বুকে এখনও এমন বহু যৌনপল্লি রয়েছে সেখানে পুলিশ থেকে স্থানীয় গুণ্ডা ও রাজনীতির চাপ সারাক্ষণ-ই পোহাতে হয় যৌনকর্মীদের। সেদিক থেকে দেখতে গেলে যৌনকর্মীদের নিয়ে বৃহস্পতিবার সুপ্রিমকোর্টের অবস্থান একটা আশার আলো জাগিয়েছে নিশ্চিতভাবে।' 

 সেই সঙ্গে বিশাখা আরও উল্লেখ করেন যে যৌনকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনকে মানবিক হতে হবে এটা ভাবলে শুধু হবে না, এর সঙ্গে যৌনপল্লিগুলিকে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। কারণ, যৌন পেশাকে আইনি বৈধতা দেওয়া হলেও এই পেশার সঙ্গে যুক্তদের নির্দিষ্ট একটা জায়গা থাকা উচিত যেখানে তাঁরা তাঁদের পেশাটা করতে পারবে। এই নিয়ে আইনি সুরক্ষা না থাকলে যৌনপল্লিগুলো যে তিমিরে পড়েছিল সেই কোণেই পড়ে থাকবে বলে মনে করছেন বিশাখা। সুপ্রিমকোর্টের রায় যে যৌনকর্মীদের পারিবারিক স্তরেও একটা আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হবে তা মানছেন অনেকেই। যৌনকর্মী বিশাখার মতে, সমাজের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে পারিবারিক মানসিকতা। বলা যেতে পারে সমাজ দ্বারাই লাজ-লজ্জা এবং ভয়-এর ক্ষেত্রে অনেকটাই প্রভাবিত হয় একটি পরিবার। তাই বিশাখার মতে যদি যৌনকর্মীদের পেশাকে বৈধতা দেওয়া হয় এবং তাঁদের আইনি সুরক্ষা কবচ বৃদ্ধি পেলে সমাজও আরও এই বিষয়গুলিতে বুঝতে শিখবে এবং তা নিশ্চিতভাবেই পরিবারগুলিকে প্রভাবিত করবে। তবে, এখনই এখনই এই জায়গাটা তৈরি হওয়া নয় বলেই মনে করেন বিশাখা। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৯৪ সালে যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষায় আন্দোলনে নেমেছিলেন। তারপর কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর, সেদিন যৌনকর্মী এবং যৌনপল্লির যে হাল দেখেছিলেন আজ  সেখানে পরিবর্তনের বহরটা কয়েক'শ গুণ বলেই জানিয়েছেন বিশাখা। 

যৌনকর্মীদের অধিকার সুরক্ষা দুর্বারের সঙ্গেই কাঁধ কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে আসছেন মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, সুপ্রিমকোর্টের অবস্থান একটা যুগান্তকারী ঘটনা। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি যৌনকর্মীদের যতগুলো অধিকার রক্ষার বিষয়ে লড়াই করে আসছে, মানবিকতা এবং সম্মানের সঙ্গে যৌনকর্মীদের বাঁচতে দেওয়াটা অন্যতম। যখন তখন যৌনকর্মীদের ক্রেতাদের পুলিশের তুলে নিয়ে যাওয়া, বা যৌনকর্মীর সন্তানকে কোনও আছিলায় তুলে নিয়ে যাওয়া এগুলো নিত্যনৈমত্তিক বিষয়। এমনকী যৌনপল্লি থেকে নাবালিকাদের উদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে হোমে ফেলে দেওয়া- এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার আন্দোলন সংগঠিত করা হয়েছে। এতে অনেকটাই কাজ হয়েছে। হয়তো সময় লেগেছে, কিন্তু মানুষ বুঝতে শিখেছে। হোমে নিয়ে গিয়ে নাবালিকাদের ফেলে দেওয়াটা কোনও সমস্যার সমাধান নয়। আর যে সব প্রাপ্তবয়স্ক নিজের মর্জি মতো যৌনকর্মী হতে চান তাঁদের অধিকারের উপর কেন হস্তক্ষেপ করবে পুলিশ প্রশাসন। এমনকী, যখন তখন যৌনকর্মীদের তুলে নিয়ে যাওয়া, তাদের ছবি তুলে সংবাদমাধ্যমে বিলিয়ে দেওয়া। এই কাজগুলোর বিরুদ্ধে বারবারই প্রতিবাদ হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট এই বিষয়গুলিকে মান্যতা দিয়ে বিচার করেছে এবং যৌনকর্মীদের পরিচয় সর্বসমক্ষে ফাঁস করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে-এটা খুবই ভালো পদক্ষেপ বলা যেতে পারে।

সুপ্রিমকোর্টের রায়কে স্বাভাবিকভাবেই পজিটিভ বলে মন্তব্য করেছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির মেন্টর ভারতী দে। তিনি জানিয়েছেন, গত কয়েক দশক ধরে দুর্বার যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষায় যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে সুপ্রিমকোর্টের অবস্থান তাকেই যেন মান্যতা দিল। যৌনকর্মীদের মানবিকতা ও সম্মান দেওয়ার কথা বহুদিন ধরে বলে আসা হচ্ছে। একটা সময় এমন একটা আইন আনা হয়েছিল যে যৌনপেশা অপরাধের মতো বিবেচ্য হত। এর বিরুদ্ধেও আন্দোলন গড়ে তুলেছিল দুর্বার। পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সরকার সেই আইন লাগু করা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। যৌনকর্মীদের অধিকার সুরক্ষার আন্দোলনটা অনেকটাই এগিয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলনে আরও জোর আনল বলেই মনে করছেন তিনি। 

যৌনপেশায় যে জিনিসটি বারবার সামনে আসে সেটা হল মানবিকতা ও সম্মান। এখনও অসংখ্য যৌনকর্মী বলে থাকেন যে তাঁদের অর্থের উপরে পরিবারের চোখ থাকে। কিন্তু সেই অর্থ যে যৌনপেশা থেকে এসেছে সেটা বলতে আজও কুণ্ঠা থেকে যায়। ফলে যৌনকর্মীরা যথ অর্থই তাদের বাড়িতে দিন না কেন সম্মান পাওয়া যায় না। সুপ্রিমকোর্টের অবস্থান হয়তো যৌনপেশার সঙ্গে যুক্তদের গলার আওয়াজকে আরও জোরদার করতে সাহায্য করবে। আপাতত ২৭ জুলাই-এর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে কলকাতা এবং ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি সোনাগাছি।  
আরও পড়ুন- চেনে তাঁদের প্যারিসও, কেমন আছে সোনাগাছির যৌনকর্মীরা, চলুন ফিরে দেখা যাক  
আরও পড়ুন- 'এটা নিয়ে আইন হলে বেশি খুশি হব', সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যে কী প্রতিক্রিয়া শহরের যৌনকর্মীদের 
আরও পড়ুন- যৌনকর্মীদের হেনস্থা করতে পারবে না পুলিশ, Sex Work বৈধ বলল সুপ্রিম কোর্ট

Share this article
click me!