বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা সংস্কৃতি কখনও ধর্মীয় উন্মাদনাকে গ্রহণ করেনি

  • ধর্ম ছাড়া রাজনীতি সম্ভব নয়
  • মানবিকতাই মূল কথা এটাই বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য
  • বাংলায় ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন হয়েছিল যা ভক্তি আন্দোলন নামেও পরিচিত
  • চৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণব আন্দোলনও হয়েছিল এই বাংলায়

তপন মল্লিক : এ রাজ্যে দলীয় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে বিশেষ করে ভোটের রাজনীতি ঘিরে সম্প্রতি এমন কতগুলি ঘটনা ঘটেছে তাতে বাংলার রাজনীতির ঐতিহ্য নিয়ে তো বটেই, মানুষের ধর্ম বা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রথাগত ধর্ম থেকে মানবধর্ম এবং রাজনীতিকে আলাদা করিয়া দেখার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অথচ প্রথাগত ধর্মের মধ্যেও যে মানবিকতাই মূল কথা এটাই বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সেই জায়গায় আঘাত করছে। 

 ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বা ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে ক্ষমতা দখল কংবা টিকে থাকার  চেষ্টা বাংলায় আগে ছিল না। কারণ বাংলার সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যে তার ঠাই নেই। যারা এতদিন সেই অভিযোগকে কার্যত অস্বীকার করে এসেছেন আজ তারাও প্রকাশ্যে বলছেন, ‘ধর্ম ছাড়া রাজনীতি হয় না। ধর্ম ছাড়া রাজনীতি সম্ভব নয়। ধর্ম ছাড়া রাজনীতির কোনও অর্থই নেই। ধর্ম এবং রাজনীতি পাশাপাশিই বিরাজ করে। ধর্ম মানে কী করতে হবে আর কী করতে হবে না। আর সেই কারণেই রাজনীতিতে ধর্মের প্রয়োজন আছে’।‌  

Latest Videos

কেবল যে ধর্ম তাতো নয়, ধর্মের নামে যে শ্লোগান বা হুঙ্কার উঠছে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলায় তা মানুষে মানুষে বিভেদ ও তা থেকে হিংসাত্মক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই জাতপাতের রাজনীতি আছে। কিন্তু তার সর্বগ্রাসী ক্ষমতা নেই। ভোট বৈতরণী পেরোতে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে জাতপাতের রাজনীতি চললেও তা সব সময়ে শক্তপোক্ত, মজবুত হয়ে উঠতে পারে না। জাতপাতের ভোটের শতাংশেও সেটা দেখা গিয়েছে। তার থেকেও বড় কথা এই বাংলায় এই রাজনীতি কোনওকালেই তেমন গুরুত্ব পায় নি। তবে সেই চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন তফশিলি জাতিকেও হিন্দু বলে চালানো হচ্ছে। শিখ, বৌদ্ধ, জৈনদেরও আনা হচ্ছে হিন্দু ছাতার তলায়! 

এই বাংলায় ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন হয়েছিল যা ‘ভক্তি আন্দোলন’ নামেও পরিচিত। চৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণব আন্দোলনও হয়েছিল এই বাংলায়। সেই সময়কার হিন্দু সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সেই আন্দোলন গড়ে ওঠে নদীয়ায়। যদিও তা চৈতন্যদেবের আগেই শুরু হয়েছিল। চৈতন্যদেব তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে এটি একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়। তখন এর নতুন নাম হয় গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম, যা সাধারণভাবে বাংলায় বৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিত। এতে হিন্দু সমাজের ভগবৎপ্রেম ও ভক্তিবাদ আশ্রিত বৈষ্ণবধর্ম থাকলেও সুফি মতবাদের উদার মানবপ্রেম ও সাম্যনীতির আদর্শ যুক্ত করে চৈতন্যদেব একে একটি নব্য ভাববাদী ধর্মমতের রূপ দেন। প্রেম ও ভক্তি দিয়ে পরমাত্মাকে পাওয়া যায়; তাঁর সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়। চৈতন্যদেব পদযাত্রাসহ নামসঙ্কীর্তন ও নগরকীর্তন প্রবর্তন করে এতে নতুন মাত্রা যোগ করেন। 

চৈতন্যদেবের এই আন্দোলনের কারণ ধর্ম ও সমাজের সংস্কার, শাসক শ্রেণির ছত্রচ্ছায়ায় ইসলাম ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রোধ করা। তিনি একদিকে হিন্দু অভিজাতদের সেচ্ছাচার রোধ করেন, অন্যদিকে নামসঙ্কীর্তনের মাধ্যমে সর্বসাধারণকে নতুন প্রেমধর্মে সমান অধিকার দেন। এই ভাবে তিনি উচ্চ ও নিম্ন বর্গকে অভিন্ন ধর্মাচরণ ও ভাবাদর্শে পরস্পরের কাছে এনে এক আত্মীয়ভাবাপন্ন হিন্দু সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

সেই সময় হিন্দু সমাজের অবস্থা ছিল খুবই সঙ্কটজনক। সমাজে তখন বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথার কারণে অস্পৃশ্যতা,  বৈষম্য এবং অনৈক্য তৈরি হয়েছিল। এছাড়া  সতী প্রথা,  কৌলীন্য প্রথা, বাল্যবিবাহ, জাতিচ্যুতি, প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি সংস্কার হিন্দু সমাজকে নানা দিক থেকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। চৈতন্যদেব হিন্দু সমাজের এই অচলায়তন ভেঙ্গে তাতে মানবতা সঞ্চার করেন। তাঁর আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল এটাই।  

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চৈতন্যদেবের এই ধর্মীয় আন্দোলনে প্রভাবিত হয়। উচ্চ বর্গের হিন্দু সম্প্রদায় সংস্কৃতকে এবং মুসলমান সম্প্রদায় আরবি-ফারসিকে শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার মাধ্যম করায় বাংলা ভাষা প্রায় দু-তিনশো বছর ধরে উপেক্ষিত ছিল। তখন বাংলা ভাষায় কিছু রচনা বা অনুবাদ অধর্মের কাজ বলে মনে হত। চৈতন্যদেবের পার্ষদরা সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বৈষ্ণব প্রেমভক্তিবাদ বাংলা ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ করেন। বৈষ্ণব কবিরা অসংখ্য পদ রচনা করেন। বহু কবি ছিলেন বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান। সেই সময় বাংলা ছিল যেমন গতিশীল  তেমনই সৃষ্টিশীল। বৈষ্ণব আন্দোলনে ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও চৈতন্যদেব মানবপ্রেমের ওপরই বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। 

অন্যদিকে ধৰ্ম বিকৃত হয়ে তন্ত্র সাধনার নামে নারী উপাসনাকে কেন্দ্র করে সমাজে চরিত্রহীনতা ও যৌনলিপ্সা, সংক্রামক ব্যাধির মতো দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার ঘোর অন্ধকার যুগে। ধর্মীয় আন্দোলনের প্রভাবে বাংলা্র সেই অন্ধকার দূর হয়ে সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে এক উন্নতমানের জীবনাদর্শন প্রতিষ্ঠা পায়। সে ধর্ম হল মানবধর্ম। 
বাংলার সামাজিক জীবন এবং মানুষের অগ্রগতির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এক একটি যুগ যখনই শ্রেষ্ঠ নিদর্শন সৃষ্টি করেছে তার মূলে ছিল উদারতা, মানবিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। এটাই বাংলার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। এটাই বাংলার আবহমানকালের সংস্কৃতি। যারা ধর্মীয় ধ্বজা উড়িয়ে, হিন্দুত্বের জিগির তুলে, ধর্মীয় উন্মাদনায় বিভেদ সৃষ্টি করে, দাঙ্গা বাধিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে, বাংলার মাটিতে তাদের ঠাই হবে না। বাংলা কোনওদিন তাদের নিজেদের লোক ভাবতে পারবে না।

Share this article
click me!

Latest Videos

'Bangladesh-এ Israel-এর মতো অ্যাকশন করতে হবে!' বিস্ফোরক Suvendu Adhikari #shorts #shortsvideo
এই সরকার সব তুলে দিয়েছে! ক্লাস টেন পাশ করলেই মোবাইল কেনো আর গেম খেলো : শুভেন্দু | Suvendu Adhikari
'উনি মুখ্যমন্ত্রী উনি যা মনে করবেন তাই করবেন' হিডকোর চেয়ারম্যান পদ যেতেই এ কী বললেন ফিরহাদ?
দেখুন কামুক প্রতিবেশীর কাণ্ড! একলা পেয়ে নাবালিকাকে নিশানা! তারপর যা হলো | Ranaghat News Today
'দিনকাল খুব খারাপ, পাশেই বাংলাদেশ' চরম ইঙ্গিত শুভেন্দুর | Suvendu Adhikari | Bangla News |