শিশুর চোখেও পড়তে পারে ছানি? বড়দের থেকে আলাদা এই বিরল রোগের ব্যাপারে জানুন বিশদে

Published : Jun 26, 2025, 05:52 PM IST
Kids eye

সংক্ষিপ্ত

বড়দের মতো আপনার খুদেরও হতে পারে চোখে ছানি। এমনকি ছানি নিয়েও জন্মাতে পারে শিশু! সঠিক সময়ে রোগ ধরা না পড়লে বা উপসর্গ এড়িয়ে গেলে পরিণতি অন্ধত্ব।

ছানি বলতে আমরা সাধারণত বয়স্কদের চোখের সমস্যা বুঝি, যা দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা করে দেয়। কিন্তু এই ধারণা আজ পাল্টে গেছে। কারণ, সদ্যোজাত শিশু থেকে শুরু করে ৫-৬ বছরের শিশুরও চোখে ছানি পড়তে পারে, যা অন্ধ করে দিতে পারে আপনার বাচ্চাকে। বিরল হলেও বেশ চিন্তার এই সমস্যা। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এখন এই সমস্যার চিকিৎসা সম্ভব কলকাতাতেও।

বড়দের ছানির মতো নয় শিশুদের ছানি। এটি মূলত লেন্সের স্বচ্ছতা নষ্ট হওয়ার ফল, যার ফলে আলো চোখে প্রবেশ করতে পারে না। শিশুর এক চোখে ছানি হলে তাকে বলে ‘ইউনিল্যাটারাল’ আর দু’চোখে হলে বকে ‘বাইল্যাটারাল’। আবার শিশুদের ছানি তিন ধরনের হতে পারে -

১. কনজেনিটাল ক্যাটারাক্ট (Congenital Cataract) এক্ষেত্রে ছানি নিয়েই মায়ের গর্ভ থেকে জন্মায়, অথবা জন্মেই ছানি পড়ে।

২. ইনফ্যান্টাইল ক্যাটারাক্ট (Infantile Cataract) জন্মের এক বছরের মধ্যে শিশুর চোখে ছানি পড়ে এক্ষেত্রে।

৩. ডেভেলপমেন্টাল ক্যাটারাক্ট (Development Cataract) পাঁচ বছর বা ছ’বছরে গিয়ে বাচ্চার চোখে ছানি পড়তে পারে।

শিশুদের ছানি বিরল

আগে হাতে গোনা কয়েক জন শিশুর মধ্যে ছানির সমস্যা দেখা যেত, কিন্তু এখন এই সমস্যা আগের থেকে বেড়েছে। ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ক্লিনিকাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল অপথ্যালমোলজি’ তাদের সমীক্ষায় জানিয়েছে, দেশে প্রতি বছর ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১.৮ থেকে ৩.৬ শতাংশের ছানি পড়ে। যেহেতু ছোটদের মধ্যে ছানি পড়ার বিষয়ে অনেকেই তেমন অবগত নয়, ফলে এর চিকিৎসা থেকে অনেকেই বঞ্চিত হয় যা অন্ধত্বের পর্যায়ে পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে। গবেষণা বলছে, আমাদের দেশে শিশু অন্ধত্বের হার অনেকটাই, আর এর বড় কারণই হল ছানি।

বড়দের থেকে আলাদা শিশুরদের ছানি

বড়দের থেকে শিশুদের চোখে ছানি কতটা আলাদা, তা বুঝতে গেলে আগে জানতে হবে, বড়দের চোখে ছানি কেন পড়ে? আমাদের চোখের লেন্স প্রোটিন ও জলীয় উপাদানে তৈরি। তাতে কিছু বিশেষ প্রোটিন থাকে, যা লেন্সের স্বচ্ছতা বজায় রাখে। বয়স বাড়ার সঙ্গে এবং নানা কারণে সেই সব প্রোটিনের ঘাটতি হলে লেন্স অস্বচ্ছ হতে শুরু করে। তার ভিতর দিয়ে আলো চলাচল করতে পারে না, ফলে রেটিনার উপর একটি আস্তরণ পড়ে যায়। তখন চোখের সামনে সব কিছুই ঝাপসা লাগে।

অথচ, ছোটদের ক্ষেত্রে বাচ্চারা সবেমাত্র দেখা শুরু করে, তাই লেন্সের গঠন, তাতে প্রোটিন ইত্যাদি ততটা ভাল করে তৈরিই হয়না। তার আগেই লেন্স ঝাপসা হতে শুরু করে। আলো চলাচলের পথটা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে লেন্সের উপরে সাদা তুলোর মতো একটা পর্দা পড়তে শুরু করে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পর্দা সরিয়ে না দিলে, শিশুদের অন্ধত্বের পর্যায়ে পৌঁছতে পারে ছানি।

তাহলে ছোটদের চোখে ছানি কেন পড়ে?

* মায়ের গর্ভে থাকার সময়ে রুবেলা, সাইটোমেগালো ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। আবার প্রসবের সময়ে সংক্রমণজনিত কারণেও সদ্যোজাতের ছানি পড়তে পারে।

* ক্রোমোজ়োমের ত্রুটি বা জিনগত কারণে ছানি পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে বংশগত ভাবে বাবা-মা বা পরিবারের কারও চোখের অসুখ থাকলে, তার প্রভাব পড়তে পারে।

* মায়ের থাইরয়েড, এইচআইভি, ডায়াবিটিস বা কোনও রকম ক্রনিক রোগ থাকলে তার থেকে শিশুর চোখের অসুখ হতে পারে।

* মায়ের অপুষ্টি, মেটাবলিক ডিজ়অর্ডার থাকলে অথবা শিশুর শরীরে বিপাকক্রিয়া জনিত সমস্যা থাকলে, তার থেকে চোখে ছানি পড়তে পারে।

* অস্ত্রোপচারের সময়ে মায়ের রক্তে শর্করার মাত্রা কমতে থাকলে, তার প্রভাব পড়ে গর্ভস্থ শিশুর চোখে।

* স্বাভাবিক প্রসবে শিশুকে বার করার সময়ে আঘাত লেগে চোখের সমস্যা হতে পারে।

লক্ষণ কী? কীভাবে বুঝবেন মা-বাবারা?

বেশিরভাগ সময় সদ্যোজাত বা ছোট বাচ্চার চোখে ছানি পড়েছে, তা বুঝতেই পারেন না মা-বাবারা। আবার চোখে দেখতে পাচ্ছে না বললে, পাওয়ারের সমস্যা অথবা পড়াশোনা করতে না চাওয়ার বাহানা বলেই ভেবে নেওয়া হয়। যেকারণে শিশুর চোখে ছানি পড়েছে কিনা তা বোঝার কিছু উপায় বলেছেন চক্ষু চিকিৎসক মৃন্ময় দাস।

* সদ্যোজাত শিশু হলে বা বয়স ১ থেকে ৬ মাসের মধ্যে হলে খেয়াল করতে হবে শিশুর চোখের মণির উপরে সাদা ‘স্পট’ পড়েছে কিনা।

* দেখতে হবে শিশু ঠায় একই দিকে তাকিয়ে আছে কি না। ঘন ঘন চোখের পাতাও ফেলবে তারা। সামনে খেলনা বা কোনও বস্তু ধরলে, তা দেখতেই পাবে না ঠিক করে।

* স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে এমন শিশুর ক্ষেত্রে, শিশুর যদি দূরের লেখা পড়তে সমস্যা হয়, ক্লাসে বোর্ডে র লেখা দেখতে পা পায়, মাঝেমধ্যেই অক্ষর ঝাপসা হয়ে আসে, তাহলে চোখের পাওয়ার না ছানি, তা নিয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী।

* শিশু একদিকে ঘাড় কাত করে দেখবে, দূরের দৃশ্য দেখার সময়ে চোখ ট্যারা হয়ে যেতে পারে, রং ভাল করে বুঝতে পারবে না শিশু, সব কিছুই বিবর্ণ লাগতে শুরু করবে। ‘ডব্‌ল ভিশন’ বা একই জিনিস দুটো করে দেখলে চোখে ছানির সমস্যা হতে পারে শিশুর।

কীভাবে হবে তবে চিকিৎসা?

চিকিৎসক ঈপ্সিতা জানান,“অনেক বাবা-মা শিশুকে নিয়ে এসে বলেন, আগে এক চোখের মণিতে সাদা ছোপ বোঝা গিয়েছিল, এখন দু’চোখেই দেখা যাচ্ছে। শিশুর ছানি বোঝা গেলে একটা দিনও সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। কারণ, প্রতিটি দিন একটু একটু করে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হতে থাকে, যা অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে।"

বড়দের মতো ছোটদের ছানি চিকিৎসার উপায় একটাই - অস্ত্রোপচার, তবে এর ধরন আলাদা। কনজেনিটাল ক্যাটারাক্ট এর ক্ষেত্রে শিশুর যদি দুই চোখেই ছানি পড়ে, সেক্ষেত্রে ৪-৬ মাস বয়স না হওয়া অবধি ছানির অস্ত্রোপচার করা ঠিক হবে না। আর যদি ছানি এক চোখে বোঝা যায়, তা হলে বয়স ৬ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেই অস্ত্রোপচার করতে হবে।

আবার ইনফ্যান্টাইল বা ডেভেলপমেন্টাল ক্যাটারাক্ট হয়ে থাকলে যেহেতু শিশুর ১ বছর বয়সের পরে হয়, তাই সময় নষ্ট না করে, যে দিন ছানি ধরা পড়বে, সে দিনই অস্ত্রোপচার করার ব্যবস্থা করতে হবে।

কনজেনিটাল ক্যাটারাক্ট-এর অস্ত্রপচারে সমস্যা

কনজেনিটাল ক্যাটারাক্ট-এর অস্ত্রপচারের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে, যা মাথায় রাখতে হয়। শিশুর ওজন কতটা, শরীর কেমন, অপুষ্টির শিকার হয় বা সময়ের আগেই জন্মেছে কিনা, জন্মগত ভাবে হার্টের রোগ আছে কিনা - এসবই dekhte হবে চিকিৎসককে। সেই অনুযায়ী অস্ত্র প্রচারের সময় পিছিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কারণ অত ছোট শিশুর জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়া করা যাবে না, বিপদ এতে। সে ক্ষেত্রে শিশুর ৮ থেকে ৯ মাস বয়স হওয়া অবধি অপেক্ষা করতেই হবে। এক চোখে অস্ত্রোপচার আগে করতে হবে। তার পর পরিস্থিতি অনুযায়ী অন্য চোখে।

এবার জানুন অস্ত্রোপচার কীভাবে হবে?

চিকিৎসক মৃন্ময় জানান, ১ বছরের আগে ছানির চিকিৎসায় শিশুর অস্ত্রপচার হলে তার দুটি পদ্ধতি রয়েছে-

১) পোস্টেরিয়র ক্যাপসুলোরেক্সিস

২) অ্যান্টেরিয়োর ভিরেক্টমি

ছোটদের চোখের লেন্সের মাঝে জেলির মতো স্তর জমা হয়, সেটি অস্ত্রোপচার করে বাদ দিয়ে দিতে হয়। চিকিৎসার ভাষায় একে বলে ‘ওয়াশ’। তাই ছোটদের ছানি অস্ত্রোপচারের পদ্ধতির আরও একটা নাম আছে, তা হল ‘ক্যাটারাক্ট অ্যাসপিরেশন’।

বড়দের মতো শিশুদের কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরে শুরুতেই লেন্স দেওয়া হয় না। কারণ, যদি লেন্স বসানো হয়, তা হলে দু’রকম সমস্যা হতে পারে-

প্রথমত, শিশুটির চোখের দৃষ্টি নষ্ট হতে পারে, গ্লকোমার শিকার হতে পারে শিশু

দ্বিতীয়ত, এক্ষেত্রে লেন্সের পিছনেও আর একটি স্তর তৈরি হতে থাকে যা থেকে আবারও দৃষ্টিশক্তি চলে যেতে পারে।

চিকিৎসক ইপ্সিতা যার সমাধান হিসেবে বলেন, প্রথম সিটিংয়ে ছানি বাদ দিয়ে লেন্সের মধ্যে দিয়ে আলো চলাচলের রাস্তা তৈরি করে দেওয়া হয়। দেখার জন্য পরানো হয় মোটা ফ্রেমের চশমা, যাকে বলে ‘আফেকিক গ্লাস’। অস্ত্রোপচারের পরে শিশুর এক থেকে পাঁচ বছর বয়স অবধি, এই চশমা পরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রতি ছ’মাস অন্তর চোখের পরীক্ষা করাতে বলা হয়।

এছাড়াও অনেককে 'প্যাচিং' করেও দেখা হয়। একটি চোখে পট্টি লাগিয়ে দেখা হয়, এক চোখের দৃষ্টি ঠিক আছে কি না। আবার অন্য চোখে একই রকম পট্টি লাগিয়ে দেখা হয়, সে চোখ দিয়েও ঠিক দেখছে কি না। এই ভাবে পাঁচ বছর অবধি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। তার পর সব ঠিক থাকলে, তখন আরও এক বার অস্ত্রোপচার করে লেন্স বসিয়ে দেওয়া হয়। তবে এর পরেও কিন্তু চশমা পরার প্রয়োজন হতে পারে।

অস্ত্রপচারের পর সচেতনতা

অস্ত্রপচারের পর বাবা-মায়ের দায়িত্বও থাকে। শিশু ঠিক মতো দেখতে পাচ্ছে কি না, কম আলোয় পড়াশোনা করা বা দীর্ঘ সময়ে মোবাইল বা টিভি দেখা, এগুলো না করাই ভাল। শিশুর যদি এর পরেও দেখতে সমস্যা হয় বা চোখের যন্ত্রণা বা চোখ থেকে জল পড়ার মতো সমস্যা হয়, তা হলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

PREV
Read more Articles on
click me!

Recommended Stories

৬০ সেকেন্ডের কম সময়ে মেজাজ হবে ভালো, রইল টিপস
ফ্যাটি লিভারের সমস্যা ভুগছেন? নিয়মিত এই যোগাসনগুলো করলে মিলবে আরাম, জেনে নিন কী কী