বিগত আট দশকেরও বেশি সময় ধরে বাঙালি মহালয়ার ভোরে আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান শুনে আসছেন। ইন্টারনেটের যুগেও এই প্রভাতী অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়ামাত্র বাংলার আকাশে বাতাসে পুজোর গন্ধ ছড়িয়ে যায়। আজও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পাঠ, ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু...’ প্রভৃতি গানের সুরেই ইট-কাঠ-কংক্রিটের জীবনে শিশির ভেজা শিঊলির গন্ধ ভেসে আসে। বহুতলের ভিড়ে ঢেকে যাওয়া আকাশে সাদা তুলো মেঘ উড়তে দেখা যায়, এক ফালি জমির বুকে জেগে ওঠে কাশ ফুলের গুচ্ছ। অন্য সব আয়োজনের মতো বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বাঙালির শারদ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ।
প্রসঙ্গত; ১৯৩৭ সালে এই প্রভাতী অনুষ্ঠানের নামকরণ স্থায়ী ভাবে হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। তার আগে ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে ‘প্রভাতী অনুষ্ঠান’ নামে মহাষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটির নাম হয় ‘মহিষাসুর বধ’। ওই বছরই কিছু অদলবদল হয়ে অবশেষে মহালয়ার ভোরেই সম্প্রচার স্থায়ী হয়। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রচনার সময়ে বাণীকুমারের ভাবনাতেও এসেছিল কায়স্থ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ চণ্ডীপাঠ করলে সবাই মেনে নেবেন তো? সেই সময় এই দ্বিধা অস্বাভাবিক ছিল না। তবে বেতারের অনুষ্ঠান পরিচালক নৃপেন মজুমদার বলেছিলেন, “করব একটা প্রোগ্রাম, তার আবার বামুন কায়েত কি? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? তাছাড়া এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে তারা তো অর্ধেক মুসলমান। তা হলে তো তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়।”
উল্লেখ্য; অনুষ্ঠানের রিহার্সাল চলাকালীন বীরেন ভদ্র যখন বাংলা ও সংস্কৃত স্তোত্র পাঠ করছিলেন, ভাষাগত তফাত করতে পারছিলেন না, যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীদের দলে থাকা অধিকাংশ অবাঙালি মুসলিম বাজিয়ের দল। ফলে তাঁরা সব জায়গায় বাজাচ্ছিলেন। বীরেনবাবু কিন্তু তাঁদের থামালেন না। বাংলার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষ্যকেও সুর বলে বাজনার সুরের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। এক অন্য রূপ পেল স্তোত্রপাঠ। যা আমরা আজও শুনি। উস্তাদি যন্ত্রসঙ্গীতের সুরের সঙ্গে মিলে গেল চণ্ডীপাঠের সুর। তৈরি হল এক অপূর্ব ধর্মীয় বিনিময়। এতগুলি বছর ধরে ভোরের মহালয়া শোনা, নিষ্ঠাভরে তর্পণ, চণ্ডীপাঠ ও আবহসংগীতের মূর্ছনায় হিন্দু ধর্মীয় আবেগ উথলে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু জনপ্রিয় এই অনুষ্ঠানটির যন্ত্রানুষঙ্গে আকাশবাণী কলকাতার মুসলমান শিল্পীদের অবদান স্মরণীয়। অনুষ্ঠানে সারেঙ্গি বাজিয়েছিলেন মুনশি, চেলো বাজান তাঁর ভাই আলি, হারমোনিয়ামে ছিলেন খুশি মহম্মদ। এ ছাড়াও আকাশবাণীর আরও কয়েক জন নিয়মিত মুসলমান বাদক ছিলেন মহিষাসুরমর্দিনীর নেপথ্য শিল্পী।
কেবলমাত্র তা-ই নয়, কবি শামসুর রহমানের লেখা থেকে জানা যায় (কোন বছরের ঘটনা কবি উল্লেখ করেননি), ‘…মহালয়ার দিন প্রত্যুষে আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠানের সূচনা হত স্তোত্রপাঠ দিয়ে। সেই স্তোত্রের অবধারিত পাঠক ছিলেন বীরেন ভদ্র। অন্য কেউ তাঁর মতো স্তোত্র আবৃত্তি করতে পারতেন না। এক বার মহালয়ার স্তোত্রপাঠের নির্ধারিত সময়ে তিনি বেতারকেন্দ্রে আসতে পারেননি। রেডিওর অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে প্রচার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। নাজির আহমদ জানালেন যদি কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেন তা হলে তিনি স্তোত্রপাঠ করতে পারেন। অনুমতি পাওয়া গেল। ঠিক সময়মাফিক মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে স্তোত্র আবৃত্তি করতে লাগলেন তাঁর আবেগময় কণ্ঠস্বরে।
ইতিমধ্যে বীরেন ভদ্র এসে হাজির। তিনি দাঁড়িয়ে নাজির আহমদের স্তোত্রপাঠ শুনলেন নিবিষ্ট চিত্তে। কেউ কেউ নাজির আহমদকে থামানোর প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু বীরেন ভদ্র বারণ করলেন। কারণ তিনি একজন প্রকৃত গুণীর কদর করতে জানেন।’ নাজির আহমদের পরিচয় দিতে গিয়ে কবি শামসুর রহমান জানাচ্ছেন, ‘… যাঁরা আকাশবাণী কলকাতার আরেকটি বিশেষ অনুষ্ঠান শুনেছিলেন বহু বছর আগে তাঁরা আজও স্মরণ করেন ‘কচ ও দেবযানী’র কথা। সেই সংলাপকাব্য নাজির আহমদ এবং নীলিমা সেনের কণ্ঠে এমনই জীবন্ত হয়ে উঠেছিল যে, যদি রবীন্দ্রনাথ শুনতেন, তা হলে তিনিও সাধুবাদ জানাতেন…’।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নিজে একবার ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় মহিষাসুরমর্দিনী প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, এ যেন স্বয়ং মহামায়া এসে হিন্দু-মসুলমান শিল্পীদের মিলিত প্রচেষ্টায় সুরবৈচিত্র্যের এক সঙ্গম স্থাপন করে দিয়ে গিয়েছিলেন আড়াল থেকে। তবে কিছু রক্ষণশীল মানুষ, তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কন্ঠে কেন চণ্ডীপাঠ শুনতে হবে? প্রতিবাদ করেন বাণীকুমার। আরও একটি আপত্তি ছিল। মহালয়ার সকালে পিতৃপুরুষের তর্পণের আগেই কেন চণ্ডীপাঠ? সেটা মাথায় রেখেই ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল ষষ্ঠীর ভোরে। ফের ১৯৩৭ সাল থেকে মহালয়ার ভোরেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সম্প্রচার শুরু হয়।