মা-ঠাকুমার হাতে তৈরি মালপোয়া কিংবা গোকুলপিঠে নয়, পৌষ পার্বণে এখন রেডিমেড পিঠেই ভরসা

আজকাল প্রায় সকল মিষ্টির দোকানেই সুস্বাদু পিঠে ও পাটিসাপটা পাওয়া যায়। হাতের কাছে পাওয়া যায় বলেই পিঠে তৈরির উৎসাহ ও বাঙালি ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। অতীতে বাড়ির মহিলারা পৌষ সংক্রান্তির দিন পিঠে, পায়েস তৈরি করতেন। এই পিঠে তৈরির প্রস্তুতি চলত দু দিন আগে থেকে। 

Web Desk - ANB | Published : Jan 14, 2022 11:28 AM IST / Updated: Jan 15 2022, 11:57 AM IST

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এই পার্বণের মধ্যে অন্যতম পিঠে পার্বণ। মকর সংক্রান্তির দিন পিঠে খাওয়ার বহু যুগ ধরে চলে আসছে। এই উৎসবে প্রতিটি ঘরে তৈরি হয় পাটিসাপটা, পুলি পিঠে, গোকুল পিঠে, মালপোয়ার মতো একাধিক সুস্বাদু পদ। ভোজনরসিক হিসাবে বাঙালির খ্যাতি ত্রিভুবনে। আর মিষ্টির প্রতি বাঙালির দুর্বলতা চিরকালের। আবার সেই মিষ্টান্ন যদি নলেন গুড় দিয়ে তৈরি পুলি পিঠে হয়, তাহলে তো ষোলকলা পূর্ণ। তবে আজকের প্রযুক্তির দৌলতে পিঠে বানানোর সময় অনেকেরই থাকে না। খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সময়ের অভাবে তা বানানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর সেই শূন্য স্থান পূরণ করছে মিষ্টির দোকানের তৈরি হচ্ছে পুলি ও পিঠে। আজকাল প্রায় সকল মিষ্টির দোকানেই সুস্বাদু পিঠে ও পাটিসাপটা পাওয়া যায়। হাতের কাছে পাওয়া যায় বলেই পিঠে তৈরির উৎসাহ ও বাঙালি ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। অতীতে বাড়ির মহিলারা পৌষ সংক্রান্তির দিন পিঠে, পায়েস তৈরি করতেন। এই পিঠে তৈরির প্রস্তুতি চলত দু দিন আগে থেকে। বাড়ির ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ো করা হত। দুধ ঘন্টার পর ঘন্টা জ্বাল দিয়ে ক্ষীর তৈরি হত, নারকেল কুড়ে তাতে সেই ক্ষীর মিশিয়ে নানা রকম পিঠ পুলি তৈরি করা হত। আর সেই সময়ে বাড়িতে আসতো নতুন নলেন গুড়। আর সেই গুড়ের গন্ধ সারা বাড়িতে ম ম করত। বাড়িতে তৈরি জিনিসের মধ্যেই থাকত মা ঠাকুমাদের ভালোবাসার ছোঁয়া।

অতীতে বাড়ি বাড়ি পিঠে খাওয়ার জন্য জমজমাট আয়োজন হত। বিশেষ করে গ্রামের দিকে উঠোন পরিষ্কার করে রাখা হত সকালবেলা। দুপুরবেলা বড়দের সঙ্গে বাড়ির কচিকাঁচারাও বসে পড়ত গোটা উঠোনে আলপনা আঁকার জন্য। ভক্তি নিয়ে আঁকা হতো ধানের গোলা, ধানের শীষ, মানুষ, লক্ষী ঠাকুরের পায়ের ছাপ। যেন মিঠে রোদের মিষ্টি গল্প। গোটা প্রক্রিয়ায় অনেক খাটুনি হলেও মা ঠাকুমা হাসি মুখেই কাজ করতেন।

বিকেল হলেই শুরু হতো রান্নাঘরের একদিকে মাটি দিয়ে লেপা জোড়া উনুনে পিঠে পায়েস তৈরী। মুগপুলি, দুধপুলি, রসপুলি, গোকুলপিঠে, পাটিসাপটা, চুষির পায়েস, চালের পায়েস, আর একটা পিঠে হত মাটির সরা ঢাকা দিয়ে, সেটা গুড় দিয়ে খেতে হত। এইসবের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু ছিল চুষি, যা গোবিন্দভোগ চালের গুঁড়ো গরম জলে ফুটিয়ে মাখা আটার মত করে নিয়ে তার থেকে হাতের তালুতে রেখে তৈরি করতে হত। 

পৌষ পার্বণে বাড়িতে পিঠে তৈরির বদলে হাওড়া শহরে এখন রমরমা বাড়ছে রেডিমেড পাটিসাপটার। শহরের বেশ কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছে পাটিসাপটা। সেখানে ভিড় করছেন ক্রেতারা। তবে পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে সেই সব মিষ্টির দোকানগুলিতে একলাফে বিক্রি বেড়েছে অনেকটাই। সেরকমই একটি দোকানে পাটিসাপটা কিনতে আসা শহরের বাসিন্দা জয় বর্মন বলেন, শীতের আমেজ গায়ে মেখে পাটিসাপটা খাওয়ার স্বাদটাই আলাদা। তবে এখন তো আমরা অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাই বাড়িতে পিঠে-পাটিসাপটা বানানোর মতো সময় আর এখন পাই না। সেজন্য এই কেনা পিঠেই ভরসা। 

এক ক্রেতা রতন চক্রবর্তী বলেন, পৌষ পার্বণ উপলক্ষ্যে বাড়িতে পিঠে খাওয়ার চল রয়েছে। অতীতে এগুলি বাড়িতেই তৈরি হত। এখন সেই সময় আর নেই। বাড়ির বাচ্চাদেরকেও জানানোর প্রয়োজন আমাদের রীতিনীতি। এখন যে সমস্ত দোকানে এগুলো তৈরি হচ্ছে তাদের মাধ্যমে এই পার্বণ রক্ষা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বাড়িতে পিঠে তৈরি করার যে আনন্দ সেটা এখন আর নেই। অনেক পরিবার একান্নবর্তী থেকে ছোট সংসার হয়ে গিয়য়েছে। তাই বাঙালির এই পার্বণটা এখন এই দোকানের দ্বারাই টিকে আছে।

বিক্রেতা অভিজিৎ দাস জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরে বেড়েছে এই রেডিমেড পিঠের চাহিদা। এখনকার মানুষের হাতে বেশি সময় নেই। মানুষ ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ব্যস্ত জীবনে সময় বাঁচাতেই ক্রমশ পিঠেপুলির জন্য তারা দোকানমুখী হচ্ছে। অপর এক ক্রেতা প্রকাশ সিং জ্বালা বলেন, আজকে বাড়িতে বিশেষ চাহিদা পুলি আর পিঠের। তাই কিনতে এসেছেন। বাড়িতে এইসব তৈরি করার অনেক ঝামেলা রয়েছে তাই দোকান থেকে তৈরি পিঠেই ভালো। তবে, পৌষ সংক্রান্তির দিনে বাড়িতে তৈরি পিঠের স্বাদে মা ঠাকুমার ভালোবাসাটা এই রেডিমেড পিঠে তে থাকে না। এতে রসনা তৃপ্তি হলেও মনের রসনা তৃপ্তি হয় না।
 

Share this article
click me!