ভারতের এ আই যাত্রা: নীতি, উন্নতি, ভবিষ্যৎ - সব চিত্র ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে

এই প্রতিবেদনে প্রযুক্তির ভৌগলিক রাজনীতি খতিয়ে দেখার ধারাবাহিকের অংশ। এটা কার্নেগির থিম। এ বছরের ৪ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হতে চলেছে ভারতের অষ্টম বিশ্ব প্রযুক্তি সম্মেলন।

Rajat Karmakar | Published : Nov 14, 2023 4:20 AM IST / Updated: Nov 14 2023, 11:42 AM IST

বিবেক আব্রাহাম, সিনিয়র ডিরেক্টর, বৈদেশিক কৌশল-ভারত, দক্ষিণ এশিয়া, সেলস ফোর্স

এই প্রতিবেদনে প্রযুক্তির ভৌগলিক রাজনীতি খতিয়ে দেখার ধারাবাহিকের অংশ। এটা কার্নেগির থিম। এ বছরের ৪ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হতে চলেছে ভারতের অষ্টম বিশ্ব প্রযুক্তি সম্মেলন। এই সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত থাকছে নীতি পরিকল্পনা ও গবেষণা বিভাগ, বিদেশমন্ত্রক। এই সম্মেলনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিট্যাল জন পরিকাঠামো, গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন প্রযুক্তি, জাতীয় নিরাপত্তা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে।

এই সম্মেলনের মিডিয়া পার্টনার এশিয়ানেট নিউজ। এই সম্মেলনের বিষয়ে সবিস্তারে জানার জন্য এবং নাম নথিভুক্ত করার জন্য ক্লিক করুন।

একজন অপেশাদার প্রযুক্তিবিদ হিসেবে আমি দ্রুতগতিতে প্রযুক্তিগত বদল দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি। ২০২২ সালে খুব কম মানুষই জেনারেটিভ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কথা শুনেছিলেন। ২০২৩ সালে সারা বিশ্বের সংস্থাগুলি এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছে। ঝুঁকি ও সুযোগের কথা ভেবে এই প্রযুক্তির উপর নজর রাখছে সরকারগুলি। জেনারেটিভ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নয়। এখন আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জড়িয়ে গিয়েছে। আমরা সকালে যখন হাতে ফোন তুলে নিয়ে কোনও বার্তা এসেছে কি না দেখি, সোশ্যাল মিডিয়া দেখি, জিন সম্বন্ধীয় এবং ওষুধ সংক্রান্ত গবেষণা করি, ই-কমার্স ইকোসিস্টেম গড়ে তুলি, নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলি, আর্থিক ও ক্রেডিট ব্যবস্থা তৈরি করি, নিজেরা গাড়ি চালাই, সবক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পাকাপাকিভাবে আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে।

সারা বিশ্বে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রথমসারিতেই আছে ভারত। সারা বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত অর্থনীতি পরিচালনা করতে চলেছে ভারত। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজার ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইন্ডিয়া ব্র্যান্ড ইক্যুইটি ফাউন্ডেশন এমনই জানিয়েছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন আমাদের বিশ্ব বদলে দিচ্ছে এবং অন্যরকম করে দিচ্ছে, তখন কোনও ক্ষতি যাতে না হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য নীতির বিষয়টির উপর নজর রাখা জরুরি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রস্তুতকারী ও ব্যবহারকারীদের বিশ্বাসযোগ্য প্রযুক্তি গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়া উচিত। দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছ্বতা ও ন্যায়পরায়ণতার উপর জোর দেওয়া জরুরি। এই বিষয়গুলিকে ৩টি স্তম্ভের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। দায়িত্ববান হয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই ৩টি স্তম্ভ জরুরি।

১. নীতির মাধ্যমে কাজ করার মানসিকতা গড়ে তোলা: নীতিগতভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গড়ে তোলার জন্য সংস্থায় সেই ভাবনা গড়ে তোলা উচিত। নীতি সংক্রান্ত বিষয়টি দেখার জন্য একটি দলের উপর নির্ভর করা বাস্তবসম্মত নয়। তার বদলে নীতির মাধ্যমে কাজ করার ব্যবস্থা গড়ে তোলার অর্থ হল, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতি, লিঙ্গ, অতীত জীবন, দক্ষতার মাধ্যমে নীতি গড়ে তোলা। বৈষম্য আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখে নীতির উপর জোর দিতে হবে এবং নীতি সংক্রান্ত ঝুঁকির বিষয়টি দেখতে হবে।

২. স্বচ্ছ্বতার মাধ্যমে কাজ করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে যদি কাজের পরিবেশ গড়ে তোলা হয়, তাহলে বাস্তবে কীভাবে কাজ হবে, সেটা আগাম বলা কঠিন। দায়বদ্ধতার উপর জোর দেওয়া জরুরি। কোনও পণ্য গড়ে তোলার সময় এর সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সেটা হলে তথ্যের গুণমান যাচাই করা যাবে, বৈষম্য দূর করা যাবে। শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, সরকার-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এর ফলে সর্বোচ্চ মানের স্বচ্ছ্বতা গড়ে তোলা যায়। সেটা হলে ব্যবহারকারীরা আশ্বস্ত হন যে সংশ্লিষ্ট সংস্থায় বৈষম্য রোখার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

৩. গ্রাহকদের নীতিগত পছন্দের বিষয়টি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া: গ্রাহকরা যাতে নিরাপদ ও দায়িত্ববান ব্যবহার করতে পারেন, সেই সুযোগ দেওয়া উচিত। গ্রাহকরা যাতে উপযুক্ত ও সংবেদনশীল তথ্য পেতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বয়স, জাতি, লিঙ্গ সংক্রান্ত তথ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে জরুরি। তথ্য চিহ্নিত করা জরুরি। প্রশাসন যাতে সমস্যার জায়গাগুলি চিহ্নিত করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রাহকরা যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত সংবেদনশীল বিষয়টি বাদ দেওয়ার কথা বুঝতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

ভারতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

ভারতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। ভারতই সারা বিশ্বে অগ্রণী হিসেবে জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতি সংক্রান্ত খসড়া তৈরি করেছে। দায়বদ্ধতা, খোলামেলা পরিবেশ, ন্যায়, নিরাপত্তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভারতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ শুধু সম্ভানাময়ই নয়, দেশে বদলও আনছে।

এই ক্ষেত্রগুলিতে প্রভাব ফেলতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-

১. আর্থিক বৃদ্ধি: ভারতের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেলসফোর্স একটি ডিজিট্যাল স্কিলস সার্ভে করে। ১১টি দেশে ১১,০৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৯৩ শতাংশ ভারতীয় কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। এই গবেষণায় যোগ দেওয়া ৯৩ শতাংশ ব্যক্তিই জানিয়েছেন, তাঁরা জানেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে তাঁদের কাজে প্রভাব ফেলবে। মানসিকতায় এই বদলের ফলে কৃষি, স্বাস্থ্য, উৎপাদন, খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রে কাজ আরও দক্ষ হয়ে উঠেছে। এর ফলে অর্থনীতির উন্নতি হচ্ছে।

২. কর্মসংস্থান: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়বেন এই আশঙ্কা তৈরি হলেও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এর ফলে সৃজনশীলতা ও কৌশলগত ভূমিকা পালন করার উপর জোর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে দৈনিক কাজকর্ম স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যায়। এর ফলে কর্মীরা নতুন কিছু করার দিকে মন দিতে পারেন। সেলসফোর্স ও আইডিসি রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ২০২৮ সালের মধ্যে ১১.৬ মিলিয়ন কর্মসংস্থান হবে।

৩. সামাজিক অর্থনৈতিক প্রভাব: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সামাজিক অর্থনৈতিক দূরত্ব দূর করা যায়। বিশেষ করে যে অঞ্চলগুলিতে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার বিশেষ সুযোগ নেই, সেখানে কাজে লাগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করা যায়। এর জন্য চিকিৎসকদের কাছে যেতেও হয় না। অন্য জায়গায় থেকেই আলোচনা করা যায়। এর ফলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতি করা যায়।

৪. উন্নত সরকারি কাজকর্ম: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ, জনগণের নিরাপত্তা, দূষণ নিয়ন্ত্রণের মতো সরকারি কাজকর্ম ভালোভাবে পরিচালনা করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে পরিষেবা উন্নত করার ক্ষেত্রে সাহায্য করা যায়।

ভারতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ কী?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নত হওয়ার ফলে ভবিষ্যতে উন্নতি ও বদলের প্রবল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ উন্নত করতে হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নীতিগতভাবে ও দায়িত্বশীলভাবে তৈরি করতে হবে। নিয়ম মেনে চলার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। বিভিন্ন নিয়ম, নৈতিক মান, দায়িত্ব মেনে চলতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রস্তুতকারীদের পাশাপাশি ব্যবহারকারীদেরও নিয়ম মেনে চলতে হবে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, ভুল ধারণা তৈরি বা ভুয়ো তথ্য পরিবেশন যাতে না হয়, সেক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি।

একই সময়ে ভারতকে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে যাতে আরও সম্ভাবনা থাকে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। সেটা করতে হলে স্কিল ইন্ডিয়ার মতো প্রকল্পের উপর জোর দেওয়া যেতে পারে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, বিনামূল্যে অনলাইন কোর্স করানো হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব পূরণের ব্যবস্থা করা হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফলভাবে সব ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হলে সেটা জরুরি। সবমিলিয়ে উদ্ভাবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র ও নীতি সংক্রান্ত সব বিষয় সতর্কভাবে খতিয়ে দেখা জরুরি। প্রযুক্তি যাতে মানুষের কাজে লাগে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সাম্য, স্বচ্ছ্বতা ও দায়বদ্ধতার মূল্যবোধ মেনে চলতে হবে।

লেখক পরিচিতি-

বিবেক আব্রাহাম সেলসফোর্সের ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের বৈদেশিক কৌশল সংক্রান্ত আঞ্চলিক অধিকর্তা। তিনি কৌশল গড়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেন। সরকার ও শিল্প সংস্থাগুলিকে সাহায্য করেন বিবেক। তিনি ভারতের লিডারশিপ টিমের সদস্য। https://www.salesforce.com/in/blog/author/vivek-abraham/

যে দেশগুলিতে গবেষণা চালানো হয়েছে সেই দেশগুলি হল- অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, স্পেন, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও সুইডেন। আরও তথ্যের জন্য দেখুন- https://www.salesforce.com/news/stories/digital-skills-based-experience/

Share this article
click me!