লক্ষ্য শুধু হিন্দু ভোট নয়, সংখ্যালঘু ভোট টানতে কী কৌশল নিচ্ছে বিজেপি

  • হিন্দু ভোট গুরুত্বপূর্ণ বিজেপির কাছে 
  • বিজেপির নজর রয়েছে সংখ্যালঘু ভোটেও 
  • সেই জন্যই দেওয়া হচ্ছে উত্তর প্রদেশের উদাহরণ
  • গেরুয়া শিবির গ্রহণ করেছে একগুচ্ছ প্রকল্প 

Asianet News Bangla | Published : Apr 11, 2021 5:10 PM IST / Updated: Apr 12 2021, 12:10 AM IST

শমিকা মাইতি, প্রতিনিধি,  হিন্দু ভোট যতই ঝুঁকে থাকুক তাদের দিকে, জয়ের জন্য সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ককে মোটেই উপেক্ষা করছে না বিজেপি। কারণ, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ৬, ৯৮, ৯১, ৭৫১ ভোটারের মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ১২টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত, বিধানসভা কেন্দ্রের হিসাবে সংখ্যাটা ১৩০। এগুলিকে বাদ দিয়ে আর যা-ই হোক জয়ের হিসাব করা যায় না।  বিজেপি করছেও না। এক রাজ্য বিজেপি নেতার কথায়, ‘সবাই বলছে মুসলিম ভোটের জন্য নাকি আমাদের ক্ষমতায় আসা অনিশ্চিত। এই ধারণাটা ঠিক নয়। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যা উত্তরপ্রদেশে। সেখানে আমরা ক্ষমতায় আছি। শতাংশের হিসাবে লাক্ষাদ্বীপ, জম্মু-কাশ্মীরের পরেই রয়েছে আসাম। সেখানেও ক্ষমতায় আমরা। নিজেদের উন্নয়নের জন্য এই রাজ্যেও মুসলিম জনগণের একটা বড় অংশ আমাদের সমর্থন করছে। নয়তো গত লোকসভা ভোটে উত্তরবঙ্গে আমাদের এতটা ভাল ফল হত না।’ 
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৭.০১ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। শতাংশের নিরিখে ভারতে চার নম্বর। স্বাভাবিক ভাবেই এই রাজ্যে ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ ধরে রেখেছে তারা। বিশেষ করে মুসলিম ভোট এককাট্টা হয়ে পড়ে বলে ভোটের মানচিত্রে তাদের গুরুত্ব বেশি। 


রাজনীতিবিদদের মতে, সংখ্যালঘুরা মূলত দু'টি বিষয়কে মাথায় রেখে কোনও দলকে সমর্থন বা বর্জন করে। এক, তাদের সম্প্রদায়ের পরিচয়সত্তা রক্ষায় কোন দল কতটা আন্তরিক,  দুই,  তাদের উন্নয়নে কতটা কাজ করছে ওই দল।  এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিমদের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন তাঁর শাসনকালে। কখনও যা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত বলে সমালোচনাও হয়েছে। যেমন,  ইমামদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা, ইফতার পার্টি, এমনকী মহরমের জন্য দুর্গাপুজোর শোভাযাত্রা পিছিয়ে দেওয়া।  বিরোধীদের অভিযোগ, ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে সংখ্যালঘু তোষণ করছেন মমতা। কারণ যা-ই হোক না কেন, মমতা বা তৃণমূলের কাছ থেকে কোনও ‘থ্রেট’ পায়নি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তৃণমূল আমলে এই রাজ্যে তাদের জীবনযাত্রার গুণগত মানের উন্নতি হয়েছে। বামশাসনের শেষ বছর ২০১০-১১ সালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুদের স্কুলে ভর্তির সংখ্যা যেখানে ১০০ পিছু ৫০ ছিল,  ২০১৭-১৮ সালের এক ক্ষেত্রসমীক্ষার হিসাব অনুযায়ী তা হয়েছে ৯৮ জন। যদিও এক্ষেত্রে সর্বশিক্ষা অভিযানই মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছে। ২০১১-র জনগণনা অনুসারে রাজ্যের প্রতি ১০০ জন সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে ৫৯ জন স্বাক্ষর ছিলেন। ২০১৭-১৮ সালের ক্ষেত্রসমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তা বেড়ে হয়েছে ৭১ শতাংশ। বামফ্রন্টের শেষ বছর স্নাতক স্তরে রাজ্যে মাত্র ৪.৫০ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পড়ুয়া ছিল। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে তা বেড়ে হয়েছে ২২ শতাংশ। এক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার তৃণমূল ক্ষমতায় এসে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওবিসি-দের জন্য যে ১৭ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, তার মধ্যে ওবিসি-এ শ্রেণির সংখ্যালঘুদের জন্য ১০ শতাংশ রয়েছে। সংরক্ষণের এই সুবিধার জন্যই সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘুদের হার ২.৪০ থেকে বেড়ে ৬.৭৮ শতাংশ হয়েছে। 

লাদাখের পর এবার ব্রহ্মপুত্রের দিকে নজর চিনের, তিব্বতে বাঁধ তৈরির পরিকল্পনায় উদ্বেগ ভারতের ...
স্বাভাবিক ভাবেই উন্নয়নের জন্য, বিশেষ করে সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের প্রশ্নে গত কয়েকটা ভোটে তৃণমূলের প্রতি সমর্থনের ঝুলি ভরিয়ে দিয়েছে সংখ্যালঘুরা। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে এই রাজ্যের ১২৫টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কেন্দ্রের মধ্যে ৯১টিতে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট। ২০১৬ সালের ভোটে একা তৃণমূলই এই ১২৫টির মধ্যে ৮৫টি পেয়েছিল। সেবার বাম-কংগ্রেস জোট বেধেও সুবিধা করতে পারেনি। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে মুর্শিদাবাদ সমেত উত্তরবঙ্গের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ৪৬টি বিধানসভা কেন্দ্রে বাম ও কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৮.৪২ শতাংশ। তৃণমূল এই কেন্দ্রগুলিতে প্রায় ১০ ভোট বাড়িয়ে ৩৪ শতাংশের মতে ভোট পেয়েছিল। অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ৭৯টি কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৯.৫০ শতাংশ। যেখানে বাম- কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ৩৮.৬৫ শতাংশ। বিজেপি ওই কেন্দ্রগুলিতে মাত্র ৮.৭৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে রাজ্যের ১৩০টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিধানসভা  কেন্দ্রে তৃণমূল একাই ৪৬.৯০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৯৮টি কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল। বিজেপি ৩৩.৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ওই ১৩০টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৪টিতে এগিয়ে রয়েছে। কংগ্রেস ১০.০৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৮টি আসনে এগিয়ে ছিল। 


এই প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট নিয়ন্ত্রণে বিজেপি দু’টো বিপরীতমুখী কৌশল নিয়েছে। প্রথমত, হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করে মুসলিম অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলিতে জয়ের অঙ্ক কষছে তারা। যেভাবে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে রায়গঞ্জের মতো আসনে, যেখানে প্রায় ৪৯ শতাংশ মুসলিম ভোটার রয়েছে, সেখানেও জিতে বেরিয়ে গিয়েছিল বিজেপি। এই আসনে মুসলিম ভোট ভাগ হয়েছিল তৃণমূলের কানাইয়ালাল আগরওয়াল ও সিপিএমের সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মধ্যে। কিন্তু হিন্দুভোটের পুরোটাই পেয়ে জিতে গিয়েছেন বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী। একই ভাবে কোচবিহার আসনে প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটার থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলের পরেশচন্দ্র অধিকারীকে ৫৪ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক। ২০১৪ সালে এই আসনে যেখানে বিজেপির ভোটশেয়ার ছিল ২৮ শতাংশ, ২০১৯-এ বেড়ে হয় ৪৮ শতাংশ। বালুরঘাটের ক্ষেত্রেও এক ছবি। এক তৃতীয়াংশ মুসলিম ভোট থাকা সত্ত্বেও এই আসনে তৃণমূলের বুদ্ধিজীবী নেত্রী অর্পিতা ঘোষকে ১৩ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন বিজেপির সুকান্ত মজুমদার।

বিজেপি ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক সন্ত্রাস নিয়ে কঠোর হবে সরকার, কর্মিসভায় রীতিমত কড়া বার্তা অমিত শাহর ...
বিজেপির দ্বিতীয় কৌশলটি হল, হিন্দুত্ববাদের চেয়েও বাংলার উন্নয়নের বিষয়টিকে ভোটের মূল ইস্যু করা। এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘ধর্ম দিয়ে যে পেট ভরে না এটা সবাই বোঝে। এই রাজ্যে কলকারখানা বন্ধ। রুজি-রোজগারের জন্য বাড়ির ছেলেদের ভিন্‌ রাজ্যে যেতে হচ্ছে।  বাংলার উন্নয়ন হলে তার সুবিধা ভোগ করবে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রচারের সময় এই পয়েন্টটায় জোর দিচ্ছি আমরা।’ এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, পশ্চিমবঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকাংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। রুজির টানে তাদের কেউ কেরালা, কেউ মধ্যপ্রদেশে গিয়ে কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গে পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ থাকলে তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে বাইরে পড়ে থাকতে হত না। শুধু ‘ব্লু কলার জব’ বলে নয়, ‘হোয়াইট কলার জবে’র ক্ষেত্রও এ রাজ্যে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে ক্রমশ। তাই উন্নয়নের প্রশ্নে শিক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা অংশ সমর্থন করছে বিজেপিকে। 

শীতলকুচির ঘটনার দায় কি এড়াতে পারেন মমতা, অবশ্য এটাই তাঁর স্বভাব ...
এছাড়া,  ইতিহাস বলছে, সংখ্যালঘুদের মধ্যে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র যে দিকে যাচ্ছে সেদিকে ঢলে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। ২০১১ সালে তৃণমূলকে সমর্থন করার পিছনে এই প্রবণতাই কাজ করেছিল। এবারের ভোটে বিজেপি সংবাদমাধ্যম-সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে এই হাওয়া ছড়িয়ে দিতে চাইছে যে তাদের ক্ষমতায় আসা প্রায় নিশ্চিত। যাতে স্বাভাবিক প্রবণতায় মুসলিম ভোট তাদের দিকে ঢলে পড়ে। 
শেষ, অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল ভোট কাটাকুটির খেলা। ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি প্রকাশ্যে তৃণমূলকে সমর্থন করলেও তার ভাইপো আব্বাস সিদ্দিকি আকা ভাইজান  ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ নামে একটি দল খুলে শাসকদলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। বিরোধী বাম ও কংগ্রেস জোটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংযুক্ত মোর্চা গড়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ছে আইএসএফ। আব্বাসের বক্তব্য, ‘আমরা ভিক্ষা চাই না। কাজ চাই।’ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কেন্দ্রের অনেক ক’টাতেই প্রার্থী দিয়েছে আইএসএফ। সেক্ষেত্রে জিততে না পারলেও ভোট কাটাকুটির খেলায় বেশ ক’টাতে তারা তৃণমূলের ‘নাক কেটে’ নিতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরা।
 

Share this article
click me!