সংক্ষিপ্ত

শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে হত ৪ ভোটার

এর দায় নির্বাচন কমিশন এবং বিজেপির উপর চাপাচ্ছেন মমতা

কিন্তু, এই ঘটনার দায় তাঁর উপরও কি বর্তায় না

অবশ্য কোনও দিনই কোনও ঘটনার দায় নেননি তৃণমূল নেত্রী

 

চতুর্থ দফার ভোটে চরমে পৌঁছল হিংসা। শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে প্রাণ গেল ৪ জনের। তাঁরা সকলেই তৃণমূল কংগ্রেস সদস্য বলে জানা গিয়েছে। তারও আগে প্রাণ গিয়েছে আরেক ভোটারের, যিনি জীবনের প্রথম ভোটটি দিতে এসেছিলেন। এই ঘটনার পর থেকেই শুরু হয়েছে দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপ-এর পালা। যুযুধান দুই পক্ষের দুই সেনাপতি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদী - দুজনেই পরস্পরের দিকে আঙুল তুলেছেন। কিন্তু, দিনের শেষে এই দায় কার?

আপাত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন সংক্রান্ত নিরাপত্তার সবটাই তাদের দেখার কথা। তাই এদিন যে ৫ সহ-নাগরিককে আমরা হারালাম, তার প্রাথমিক দায় অবশ্যই নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। গত তিন দফা নির্বাচনেই তাদের ভূমিকা ও ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এই দফার নির্বাচনের পর, তা নিঃসন্দেহে আরও জোরালো হবে।

তবে, শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস দায়ী করেছে বিজেপি দলকেও। সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-কেই নিশানা করেছেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর অভিযোগ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই পূর্বপরিকল্পিতভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের ওই এলাকায় গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। যাতে বাকি ৪ দফায় আতঙ্কে মানুষ ভোট দিতে না বের হয়। এই ঘটনার জন্য দায় নিয়ে অমিত শাহ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী - দুজনেরই পদত্যাগ দাবি করেছেন তিনি।

প্রশ্ন হল মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের উপরও কি এই মর্মান্তিক ঘটনার দায় বর্তায় না? অভূতপূর্বভাবে এইবারের বাংলার ভোটে শাসক দলকেই শোষিতের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। নন্দীগ্রামে মমতার 'আক্রান্ত' হওয়ার অভিযোগ থেকে শুরু করে একের পর এক অভিযোগ এসেছে তৃণমূলের পক্ষ থেকে। বিজেপি-সিপিএম তো আছেই, তৃণমূলের অভিযুক্তের তালিকায় ইভিএম, কেন্দ্রীয় বাহিনী, নির্বাচন কমিশন - কেউ ছাড় পায়নি।

এদিনের ঘটনার আগেও, নির্বাচনী প্রচারে এই শীতলকুচির সভাতেই তিনি ফের খেলার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। বলেছিলেন, 'কী মা বোনেরা একটু হাতা-খুন্তি নিয়ে খেলা হবে নাকি?' ওইদিন ছিল তৃতীয় দফার নির্বাচন। খানাকুল ও আরামবাদে দলীয় প্রার্থীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার সমালোচনা করে সরাসরি আঙুল তুলেছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর দিকে। সভা থেকে আহ্বান করেছিলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের দেখলেই ঘেরাও করে রাখতে।  

এদিনের ঘটনাক্রম দেখলে কিন্তু, বলতেই হবে, তৃণমূলের সমর্থক 'মা-বোন'রা সেই ডাকে সাড়া দিয়েছেন। কোচবিহারের এসপি প্রাথমিক রিপোর্টের নিরিখে সাফ জানিয়েছেন, বাহিনীর সদস্যদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। মহিলারা হাতা-খুন্তি-দা নিয়ে বাহিনীর জওয়ানদের উপর চড়াও হয়েছিলেন। তাদের অস্ত্র ছিনতাই করার চেষ্টা হয়েছিল। প্রাণ সংশয়ের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় আত্মরক্ষার্থেই গুলি চালাতে হয়েছে বাাহিনীকে।

মমতা বলছেন, অমিত শাহ-র নির্দেশে গুলি চালানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতাধীন ঠিকই, কিন্তু, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেকটিই পেশাদার বাহিনী। অমিত শাহ বললেন, আর জওয়ানরা সেই নির্দেশ মেনে গুলি চালিয়ে দিল, এমনটা হয় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু চাইলে তাঁর দলে কারোর না বলার সাধ্য থাকে না। কিন্তু, ভারতীয় বাহিনী এমন নয়।এখানে চেইন-অব-কমান্ড, মানে নির্দেশের শৃঙ্খলা বলে একটা বিষয় আছে। ধাপে ধাপে আসতে হয় সব নির্দেশকেই। কাজেই তদন্ত হলে সবটাই প্রকাশিত হবে। অমিত শাহ, আর যাই হোন, এতটা নির্বোধ নন।

"

আসলে কোনওদিনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বা তাঁর দলের কোনও ঘটনার দায়িত্ব নেওয়ার ইতিহাস বা অভ্যাস নেই। ক্ষমতায় আসার পর মাঝের হাট ব্রিজ ভেঙে পড়া থেকে শুরু করে একের পর এক বহুতলে অগ্নিকাণ্ড, রাজনৈতিক হিংসা, ধর্ষণ - কোনও ঘটনারই দায় নেননি তিনি। অন্যের  ঘাড়ে ঠেলে দিয়েছেন। এমনকী এই ক্ষেত্রে তাঁর নিজের দলের নেতা-নেত্রীদের বিপদের মুখে ঠেলে দিতেও পিছপা হননি। ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে নারদা কাণ্ড সামনে আসার পর তিনি প্রকাশ্য সভাতেই বলেছিলেন, আগে জানলে তিনি এঁদের প্রার্থী করতেন না। এখনও দলের কোনও নেতা বিজেপি-তে যাওয়ার পর তিনি বলছেন, তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত। আগে জানতেন না। দায় ঝেড়ে ফেলছেন।

কাজেই, শীতলকুচি কাণ্ডেরও দায় তিনি নেবেন না, এটাই প্রত্যাশিত। সমস্যা হল, বিরোধী দলে থাকলে দায় এড়িয়ে গেলেও চলে, কিন্তু, শাসকের আসনে বসে, তা করা যায় না। কারণ যে শাসক, সেই রাজ্যবাসীর অভিভাবক। এই সত্যটা গত ১০ বছরেও মমতা বুঝতে পারেননি।