এই ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল রাজ্য সরকারকে। বিশেষ করে হায়দরাবাদে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরপরই বাংলার বুকে এমন এক নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খবর সামনে এসেছিল। বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় মালদহে এই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছিলেন।
মালদহে যুবতীকে (Maldah Rape and Murder) ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত মূল অভিযুক্ত বাপন ঘোষ ওরফে ছোটন। গতকাল মালদহ জেলা নগর দায়রা (Maldah CJM) আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আজ বাপন-এর সাজা ঘোষণা হওযার কথা। হয় যাবজ্জীবন বা ফাঁসির আদেশ হতে পারে এক্ষেত্রে। একাধিক ধারায় বাপন-এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এর সমস্ত ধারাতেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছে সে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য খুন এবং খুনের আগে ধর্ষণ ও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায় দেহকে (Violence Against Women) জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো অপরাধ। হায়দরাবাদের (Hyderabad Rape and Encounter) কাছে হায়াতনগরে ধর্ষণ (Hayatnagar Rape and Murder) ও খুনের ঘটনার পরপরই বাংলার বুকে এই অপরাধের ঘটনা সামনে আসে। সে সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বিশেষ করে বিজেপি (West Bengal BJP) তীব্র প্রতিবাদ স্বাভাবিকভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (CM Mamata Banerjee) সরকারের কাছে মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
২২ ডিসেম্বর, ২০২১-এর সকালে মালদহের আরাপুরের ধানতলার একটি আমবাগানে এক যুবতীর অর্ধদগ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার হয়। এই নিয়ে রীমিতো চাঞ্চল্য পড়ে যায়। কারণ, এই ঘটনার কিছুদিন আগেই ঘটেছিল হায়দরবাদের কাছে হায়াতনগরে এক যুবতীকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা। যেখানে অভিযুক্তদের সকলেরই এক পুলিশি এনকাউন্টারে মৃত্যু হয়েছিল। যার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই মালদহের মানুষের ভাবাবেগে প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে যখন ফরেনসিক দল এবং পুলিশি তদন্ত ও চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে সামনে আসে যে যুবতীকে জ্বালিয়ে দেওয়ার আগে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এরপর শ্বাসরোধ করা হয়। আর যুবতীর মৃত্যু নিশ্চিত করতেই তাকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঘটনার এমন নৃশংসতা সকলের সামনে আসতেই ধানতলার মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। এরমধ্যে পুলিশও ছিল অন্ধকারে। কারণ মৃত যুবতী কোনওভাবেই এলাকার বাসিন্দা ছিলেন না। একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা যুবতীকে সনাক্ত করতে পারেনি। শেষমেশ সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ করা হয় যুবতীর ছবি। যা দেখে শিলিগুড়ি (Siliguri) থেকে একটি পরিবার মালদহ পুলিশ কর্তৃপক্ষের (Maldah Police) শরাণাপন্ন হয় এবং মৃত যুবতীকে তাঁদের বাড়ির মেয়ে বলে শনাক্ত করে। এখান থেকেই এই খুনের ঘটনার সূত্র পায় পুলিশ। নতুন উদ্যোমে শুরু হয়েছিল তদন্ত।
তদন্ত নেমে মৃত পরিবারের সূত্র ধরেই পুলিশ খোঁজ পায় মালদহের আরাপুর ধানতলার যুবক বাপন ঘোষ ওরফে ছোটনের। মৃত যুবতীর পরিবার জানায় শিলিগুড়িতে একটি পপকর্ন তৈরির কারখানায় কাজ করত ওই যুবতীয সেখানেই এক যুবকের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পরে জানা যায় ওই যুবক বিবাহিত তাই সম্পর্ক কেটে গিয়েছিল। পরিবার সূত্রে মালদহ পুলিশ আরও জানতে পারে যে মৃত যুবতীর বয়স ২৫ বছরের আশপাশে এবং তিনি একজন ডিভোর্সী।
এরপর মালদহ পুলিশ ঘটনার সূত্র ধরে শিলিগুড়ির সেই পপকর্ন তৈরির কারখানায় পৌঁছয়। সেখানেই কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাপন ঘোষ ওরফে ছোটন এবং মৃত যুবতীর সম্পর্ক নিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এমনকী, বাপনের বাড়ির ঠিকানাও পুলিশের হাতে চলে আসে। আরাপুরে তল্লাশি চালিয়ে বাপন-কে আটক করে ইংরেজবাজার থানা। এরপরই বাপনকে জেরা করে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পুলিশের হাতে আসে। বাপনের এই স্বীকারোক্তির সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গ্রেফতার করে বাপনকে।
পুলিশ পরে জানায় বাপন জানিয়েছে যে শিলিগুড়ির পপকর্ন তৈরির কারখানায় ওই যুবতীর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়েছিল। দুজনে স্বামী-স্ত্রীর মতোই জীবন-যাপন করছিল শিলিগুড়িতে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় যখন যুবতী সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। সে সময় ওই যুবতীকে বাপন জানিয়েছিল যে সে বিবাহিত এবং মালদহে তার স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। এরপরই ওই যুবতী সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বাপন ওই যুবতীকে নানাভাবে বাধ্য করে সম্পর্কে থাকতে। এর কিছুদিন পরে বাপন জানতে পারে যে ওই যুবতী অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বাপন। এই নিয়ে ওই যুবতীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সে কথাও বলে। পুলিশ দাবি করেছে, যুবতীকে নানাভাবে হুমকিও দিয়েছিল বাপন যাতে সে সম্পর্ক থেকে না বেরিয়ে যায়।
এরপর বাপন একদিন মালদহের আরাপুরের বাড়িতে চলে যায়। সেখান থেকে সে ফোন করে যুবতীকে শিলিগুড়ি থেকে মালদহে আসতে বলে। এমনকী যুবতীকে মালদহে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতিও নাকি দিয়েছিল বাপন। প্রেমিকের কাছ থেকে বিয়ের আশ্বাস পেয়ে ওই যুবতী মালদহের আরাপুরে গিয়েছিল। পুলিশের দাবি, বাপনের কথা মতো যুবতী আরাপুরের ধানতলার আমবাগানে যায়। বিকেল নাগাদ আমবাগানে যুবতীকে আসতে বলেছিল বাপন। সেই আমবাগানেই সন্ধ্যা নামার সুযোগ নিয়ে বাপন ওই যুবতীকে একাধিকবার ধর্ষণ করে। ইতিমধ্যেই রাত নেমে যায়। রাতের অন্ধকারে শারীরিক নির্যাতনে আচ্ছন্ন যুবতীকে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে বাপন। প্রাণ সংশয় নিশ্চিত করতে এরপর আগে থেকে সেখানে এনে রাখা তেল ঢেলে যুবতীকে জ্বালিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল বাপন। যেদিন ওই যুবতীর দেহ উদ্ধার হয়েছিল সেদিনও পুলিশ জানতে পেরেছিল ধানতলার এই আমবাগানের দিকে লোকজন সেভাবে যাতায়াত করে না। লোকজনের না যাতায়াত করার সুযোগকে অপরাধ সংগঠিত করতে বাপন যে কাজে লাগিয়েছিল তা পুলিশ তদন্তেও উঠে এসেছে।
এই মামলার সরকারি আইনজীবী তীর্থ বসুও জানিয়েছেন, 'পুলিশের পেশ করা চার্জশিটে উল্লিখিত ধারার সঙ্গে আদালত পুরোপুরি সহমত হয়েছে। এমনকী শুনানিতেও বাপনের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগেরই প্রমাণ মিলেছে। ঘৃণ্য এই অপরাধে তাই বাপনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত। আর আজ এই ঘটনার সাজা ঘোষণা করা হবে।'
Kolkata crime: আইনজীবীকে ধর্ষনের চেষ্টার অভযোগে গ্রেফতার সল্টলেকের যুবক
TMC Malda: সরকারি অফিসে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তৃণমূল সভানেত্রীর ছবি ভাইরাল, অস্বস্তিতে ঘাসফুল শিবির
Paschim Medinipur: ঘরে ঘরে জ্বর হচ্ছে, 'ডাইনি' অপবাদে আদিবাসী প্রৌঢ়াকে মারধরের অভিযোগ