সংক্ষিপ্ত

অস্কার পাওয়ার পর ভারতের ডাকটিকিটে ছাপা হয়েছিল তাঁর ছবি। চলচ্চিত্র জগতের মহীরুহ সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে রইল এমনই কিছু জানা অজানা তথ্য।

বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বমানের খ্যাতির আসন দিয়েছিলেন যিনি তিনিই পরিচালক সত্যজিৎ রায়। তবে সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তাঁর অবদান, সাহিত্য জগৎ থেকে শুরু করে প্রচ্ছদ অঙ্কণ সবদিকেই তিনি ছিলেন সিদ্ধ্যহস্থ। তাঁরই ৯৮ তম জন্মবার্ষিকীতে রইল এমন কিছু তথ্য যা সত্যজিৎ রায়-কে আজও বাঙালীর তথা বিশ্ববাসীর কাছে এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে রেখেছে, এবং যার জেরে আজও সকলে একবাক্যে বলে ওঠেন- মহারাজা, তোমারে সেলাম।

  • শৈশবের সত্যজিৎ রায়

২রা মে ১৯২১ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক দিক থেকে তখন রায় পরিবারের আভিজাত্য উর্ধ গগণে। বিশিষ্ঠ শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর সুবাদে রায় পরিবার তখন এক ভিন্ন মর্জাদার আসন পায় সমাজে। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র সুকুমার রায় ছিলেন সাহিত্য জগতের অপর এক স্তম্ভ। ছন্দের জাদুকর সুকুমার রায়-এর একমাত্র সন্তান হলে সত্যজিৎ রায়। তাঁর জন্মের তিন বছরের মাথায় মৃত্যু ঘটে সুকুমার রায়ের। এরপর জীবনের সকল পাঠ নেওয়া শুরু হয় পিতামহর কাছ থেকেই। মনের কোণে শিশু সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ ও গুপি বাঘা পর্বের বীজ বপন হয় পিতামহের অনুপ্রেরণায়।

  • চলচ্চিত্র বিপ্লব ও সত্যজিৎ রায়-এর হাতেখড়ি

১৯৪২ সালে বিশ্বযুদ্ধের পর সারা দেশ জুড়ে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক স্তরে এক বিপুল ভাঙলের সৃষ্ঠি হয়। যার প্রভাব পরে চলচ্চিত্র জগতেও। পুঁজির অভাবে একে একে বন্ধ হতে থাকে ছবি পরিচালনার কাজ। এমনই অবস্থায় ইতালীর বিখ্যাত পরিচালক জ্যঁ রেনওয়া কলকাতায় আসেন দ্য রিভার নামক একটি তথ্যচিত্র পরিচালনার কাজে, যাকে সঙ্গত দেন সত্যজিৎ রায়। এরপর পারি দেওয়া ইতালীতে। তখন ইতালী জুড়ে চলছে নিউ রিয়ালিজম-এর ঝড়। যার প্রভাবে ক্রমেই বদল ঘটছিল চলচ্চিত্র পরিচালনার ধাঁচের। ১৯৪৮ সালে ইতালীর অপর এক বিখ্যাত পরিচালক ভিতোরিও দেসিকা প্রথম এ ঘরানার ছবি তৈরি করেন, বাই সাইকেল থিপ। দ্য রিভার-এ কাজ করার সুবাদে ইতালীতে গিয়ে তিনি দেখেন এই ছবিটি, যার দ্বারা বিপুল প্রভাবিত হন সত্যজিৎ রায়। কম পুঁজিতেও যে কিভাবে বাস্তবকে নিঁখুতভাবে তুলে ধরা সম্ভব তার পাঠ তিনি এখানেই নেন এবং সিদ্ধান্ত নেন তৈরি হবে পথের পাঁচালী।

  • পথের পাঁচালী-র সৃষ্টি

দেশে ফিরে প্রথমেই তিনি মনোনিবেশ করেন তার প্রথম সিনেমা তৈরির কাজে। লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পথের পাঁচালী উপন্যাসের শিশু সংস্করণ আমাটির ভেঁপু-র সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। তৈরি করেন এই বইয়ের প্রতিটি প্রচ্ছদ। যা পরবর্তীতে সিনেমার শর্টডিভিশন-এ ব্যবহার করেছিলেন তিনি। অর্থের অভাবে মোট তিন বছর লেগেছিল পথের পাঁচালী ছবির শ্যুটিং শেষ করতে। পরবর্তীতে বাংলা তথা ভারতের চলচ্চিত্রকে বিশ্বর দরবারে পৌঁছতে পথ করে দিয়েছিল এই ছবি। মোটের ওপর ১১টি পুরষ্কারে ভূষিত হয় পথের পাঁচালী।

  • চলচ্চিত্র জগৎ-এর মানিকদা

চলচ্চিত্র জগতে সত্যজিৎ রায়ের মানিক দা নামে পরিচিতি ছিল অধিক। চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র মিলিয়ে মোট ৩৭টি ছবি তিনি পরিচালনার কাজ করেন। তবে অপু ট্রিলজি সত্যজিৎ রায়-এর জীবনের এক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার, এই তিনটি ছবি বাংলার চলচ্চিত্র ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হয়ে রয়েছে। আবহসঙ্গীত ছিল তাঁর ছবির অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

  • চলচ্চিত্র জগতে তিন মহীরুহের ডেবিউট

সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই চলচ্চিত্র জগতে পরিচিতি পেয়েছেন তিন বিশিষ্ট তারকা, সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অনেকটা জায়গা দখল করে রয়েছেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫৯ সালে অপুর সংসার-এ প্রথম অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বিপরীতে ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। শর্মিলা ঠাকুর-এরও এটি ছিল প্রথম চলচ্চিত্র জগতে হাতেখড়ি। অপরদিকে ১৯৫৫ সালে মেজবৌ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অপর্না সেন, কিন্তু তার অভিনয় প্রসংশা পায় পরবর্তী ছবি সমাপ্তী-র জন্য, তখন থেকেই পরিচালকদের নজরে পরেন এই তারকা।

  • চিত্রনাট্যে আপোস নয়

তিনি চিত্রনাট্যের তাগিদে সকল প্রকার প্রস্তুতি ও ঝুঁকি নিতে রাজী ছিলেন। কোথাও কোনও খামতীর আবকাশ রাখতেন না তিনি। তাতে যদি কাউকে ফেরাতে হয় পিছু পা হতেন না পরিচালক। অভিনেতা দীলিপ কুমার এই একই কারণে কাজ করতে পারেননি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। একটি ছবির চিত্রনাট্য পাঠের পর তা পছন্দ হয় অভিনেতার। ডাক পাওয়া মাত্রই তিনি দেখা করেন পরিচালকের সঙ্গে। কিন্তু চিত্রনাট্যের চাহিদা অনুসারে তাকে জামা খুলে অভিনয় করতে বলায় পিছু পা হন তিনি। নিজের ইমেজ বজায় রাখতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দীলিপ কুমার, কারণ তৎকালীণ সময় জামা ছাড়া অভিনয়ের চলছিল না সমাজে।

 

  • ফিলুদা ও শঙ্কু

সাহিত্য জগতের দুই খ্যাতনামা ব্যক্তির জন্মদাতা ছিলেন তিনিই। গোয়ান্দ ফেলু মিত্তির ও বিজ্ঞানী শঙ্কু। যা আজও বাংলা সাহিত্য জগত থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র জগতের একবিশাল স্তম্ভ সরূপ দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরিচালক ও অভিনেতার হাতে পরে জীবন্ত হয়ে উঠেছে সকলের প্রিয় ফেলুদা। তিনি নিজে এবং পরবর্তিতে তার পুত্র সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় ফেলুদা পেয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা।

  • প্রাপ্তী

বহু পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। পেয়েছিলেন দাদা সাহেব ফালকেও। ১৯৯২ সালে অষ্কার পুরষ্কারও তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে। এরপর ১৯৯৮ সালে ভারতের ডাক টিকিট-এ সত্যজিৎ রায়-এর ছবিও ছাপা হয়।