সংক্ষিপ্ত
আমির এমনিতে খুব প্রাইভেট মানুষ। প্রাইভেসিতে জোর দেন। কিন্তু বলিউডের তাবড় সেলিব্রিটিরা যা মনে-প্রাণে চেয়েও পারেন নি, সেই কাজটাই আমির করছেন সম্পূর্ণ নিজের ফর্মুলায়। কাজটা খুব সহজ নয়। কিন্তু দেখানো মানবিকতার মোড়কে বা আধুনিকতার সংজ্ঞায় তা আদতে কতটা মানবিক আর কতটা একনায়ক তন্ত্রকে জায়গা করে দেওয়া, তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে।
তপন বক্সী, মুম্বই: বহু বছর আগে কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এক প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্র গোষ্ঠীর বিতর্ক সভার বিষয় ছিল, 'বিখ্যাতদের ব্যক্তিগত জীবন থাকা উচিত, নাকি উচিত নয়?' ক্রিকেটার পতৌদি, দক্ষিণ ভারতের স্বনামধন্য জাতীয় সাংবাদিক চো রামস্বামীরা সেই বিতর্ক সভায় অংশ নিয়েছিলেন। শেষমেষ জয়ী হয়েছিলেন দ্বিতীয় মতবাদের অংশগ্রহণকারীরা। অর্থাৎ বিখ্যাতরাও নিজেদের ঘরের পর্দাটি সাধারণ মানুষের জন্য তুলেই রাখুন। এই মুহূর্তে আমির খানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চলতে থাকা চর্চার মধ্যেই সেই বিতর্ক সভার কথাটি মনে করার বিশেষ কারণ আছে বৈকি। সিনেমা শিল্পের সঙ্গে বরাবরই জড়িয়েছিল আমির খানদের পরিবার। ১৯৪০-এর শেষের দিকে নাসির হুসেন খান মুম্বইয়ের 'ফিলমিস্তান স্টুডিও'-তে এসে লেখক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। মালাড -এর 'বম্বে টকিজ'-এর দেবিকা রাণীর সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় শশধর মুখোপাধ্যায়রা 'ফিলমিস্তান ' তৈরি করেছিলেন।
আরও পড়ুন-পুরোনো একঘেয়েমি 'সহবাস' আর নয়, 'জীবনে সুখ একটাই', খোলসা করে প্রকাশ্যে জানালেন শ্রাবন্তী
সেখানেই নাসির হুসেন 'আনারকলি', 'মুনিমজি', 'পেয়িং গেস্ট' ছবিগুলি লিখেছিলেন। শশধর মুখোপাধ্যায় নাসির হুসেনকে পরিচালক হিসেবে লঞ্চ করেছিলেন 'তুমসা নহি দেখা' ছবিতে।'তুমসা নহি দেখা' থেকে শুরু করে 'কারবাঁ'('ক্যারাভ্যান') টানা ১২ বছর নাসির হুসেন তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে নায়িকা হিসেবে নিয়েছিলেন আশা পারেখকে। ইনি হলেন আমির খানের জ্যাঠামশাই। ফিলমিস্তান স্টুডিওর অ্যাসিস্ট্যান্ট কোরিওগ্রাফার মার্গারেট লিউইসকে 'আয়েষা খান' নামে বিয়ে করার পরেও আশা পারেখের সঙ্গে নাসির হুসেনের লঙ টার্ম রোমান্টিক রিলেশনশিপের কথা ইন্ডাস্ট্রির সবাই জানতেন। এমনকি আশা পারেখ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত আত্মজীবনী 'দ্য হিট গার্ল'-এ সেকথা খোলাখুলি স্বীকারও করেছেন। নাসির হুসেনকে ভালোবেসে আশা পারেখ নাসির হুসেনের ঘর যেমন ভাঙতে চাননি, তেমনই নিজে সারা জীবন আর বিয়েও করেন নি। আশা পারেখ চিরকুমারী থেকে গিয়েছেন। আশা পারেখ নিজেই জানিয়েছেন, পরিবারের সব সদস্যদের সঙ্গে বেঁচে থাকার মর্ম আমি জানি। তাই আর একটি পরিবারকে আমি ভাঙতে চাইনি।
আশা পারেখ এর সঙ্গে সুদীর্ঘ রিলেশনশিপের জন্য নাসির হুসেনের স্ত্রী মার্গারেট ওরফে আয়েষা স্বামী নাসির হুসেনের সঙ্গে থাকতে চাননি। নাসির হুসেন আর আয়েষা খানের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে মনসুর খান বম্বে আইআইটির ছাত্র ছিলেন। ওঁদের মেয়ে নুজাত খান দাদার বম্বে আইআইটির বাঙালি বন্ধু, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অনিল পালকে বিয়ে করেছিলেন। আমেরিকার ম্যাডিসনে নুজাত আর অনিলের ছেলে ইমরানের জন্ম হয়। ইমরানের দেড় বছর বয়সে নুজাত আর অনিলের ডিভোর্স হয়ে যায়। নুজাত মুম্বই ফিরে এসে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের কাজ শুরু করেন। পরে অভিনেতা রাজ জুৎসিকে বিয়ে করেছিলেন নুজাত। তাঁর সঙ্গেও ডিভোর্স হয়ে যায়। পরে নুজাতের ছেলে ইমরান খানকে (মার পদবি) ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে লঞ্চ করান দুই মামা মনসুর খান ও আমির খান। অভিনয়ে তেমন সাফল্য পাননি ইমরান। সেই ছায়া তার ব্যক্তিগত জীবনেও এসে পড়েছে। এই মুহূর্তে প্রেমিকা থেকে স্ত্রী হওয়া অবন্তিকা মালিকের সঙ্গে সেপারেশনে আছেন। ৮ বছরের বিবাহিত জীবনের পর ২০১৯-এ অবন্তিকা মেয়ে 'ইমারা'- কে নিয়ে ইমরানের বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
এই ফিল্মি পরিবারের মধ্যে জন্মে ও বড় হয়ে নাসির হুসেনের ছেলে মনসুর খান অন্য কিছু ভেবেছিলেন। নাহলে 'কয়ামত সে কয়ামত তক', 'জো জিতা ওহি সিকন্দর', 'অকেলে হম অকেলে তুম' ছাড়া আরও কিছু হিট ছবি পরিচালনা করার পরেও সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে তামিলনাড়ুর নীলগিরি পর্বতের গায় ২২ একর জমি নিয়ে ফার্মিং করতেন না। বউ টিনা, এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে তামিলনাড়ুর কুন্নুরে ফার্ম হাউস চালান মনসুর। সিনেমার গ্ল্যামারাস জগত এবং সেই জগতে থেকে অর্থহীন পারিবারিক অসুখী জীবনের বৈপরীত্যে জীবন কাটাতে মন চাইনি মনসুরের। কিছুদিন আগে কুন্নুর থেকে এক ইন্টারভিউয়ে মনসুর বলেছিলেন, আমির খান বরাবরই এক্সেপশনাল। অভিনয় জগতের মধ্যে থেকেও আমির সব সময় নতুন কিছু ভেবেছেন এবং তা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেছেন। সিনেমার মধ্যে থেকেও আমির যেভাবে ব্যতিক্রমী হতে চেয়েছেন, মনসুর সে পথেই হাঁটেন নি। পরিবারের মধ্যে থেকে একমাত্র অড ম্যান আউট হয়ে চলে গিয়েছেন সম্পূর্ণ অন্য এক জগতে।
নাসির হুসেনের ছোট ভাই প্রযোজক-পরিচালক তাহির হুসেন দাদা নাসিরের সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। এই তাহির খানই হলেন আমির খানের বাবা। আমির খানেরা চার ভাইবোন। নিখাত, আমির, ফয়জল আর ফরহাত। নাসির হুসেনের দুই ছেলেমেয়ে আর তাহির হোসেনের চার ছেলেমেয়ে। সম্পর্কিত এই মোট 'ছ জন ভাই বোনেদের মধ্যে একমাত্র আমির খানই বলিউডে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। আমিরের ছোটবোন ফরহাত সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত নন। হিন্দু স্বামী রাজীব দত্তকে বিয়ে করে আমেরিকায় থাকেন। আমিরের বড়দি নিখাতের স্বামীও হিন্দু। তাঁর নাম সন্তোষ হেগড়ে। বাবা তাহিরের সঙ্গে কিছু ছবিতে প্রোডাকশনের কাজ সামলানোর পর নিখাত হিন্দি ছবিতে ক্যারেক্টার রোলে অভিনয় করেন এবং বিজ্ঞাপনের এজেন্সি চালান। আমিরের ছোটভাই ফয়জল তাঁর মানসিক রোগের জন্য খবর হয়েছিলেন কয়েক বছর আগে। হিন্দি সিনেমায় ফয়জলকে দাঁড় করানোর জন্য আমির 'মেলা' নামে একটি ছবি করেছিলেন। 'মেলা' চলেনি। অবিবাহিত ফয়জল এরপর যা কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছেন, তা সাফল্য পাননি। মানসিক রোগগ্রস্থ হয়ে পড়া ফয়জলকে নিয়ে বাবা তাহির হুসেনের সঙ্গে আমির খানের দ্বন্দ্ব কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। পেশাদারী জীবনে আমির খানের সুউচ্চ সাফল্য ও প্রতিষ্ঠা পারিবারিক জীবনে বিভেদের উপকরণও হয়ে উঠেছে। বাবা তাহির ও ভাই ফয়জলের সঙ্গে আমিরের সম্পর্ক 'ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই' হয়ে রয়ে গিয়েছে। বড়দা নাসির হুসেনের মত ভাই তাহির হুসেনের দাম্পত্য জীবনেও ঝড় উঠেছে বারবার। স্ত্রী জিনাতকে রেখেও তাহির হুসেন দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন প্রৌঢ় বয়সে। আর তার মাঝখানে extra-marital রিলেশনশিপে জড়িয়ে পড়েছেন অনেকবার। অভিনেত্রী দিব্যা পালট, বিতর্কিত মৃত্যুর শিকার অভিনেত্রী জিয়া খানের মা রাবিয়া আমিন খানদের সঙ্গে তাহির হুসেনের নাম জড়িয়ে গিয়েছে বারবার।
২০১০-এ মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাহির হুসেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গ ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন আমিরের মা জিনাতের কাছে। চড়া আলোর বাণিজ্যিক সিনেমায় অভিনয় করতে করতে পরিণত হয়ে আমির যেমন নিজেকে অন্য রকম সিনেমার সঙ্গে যুক্ত করেছেন, তেমনই ব্যক্তিগত জীবনে আমির খান এক নতুন ট্রেন্ড সেট করতে উদ্যোগী হয়েছেন। বিবাহিত স্ত্রীদের সঙ্গে ১৫ বছর করে ঘর করার পর তাঁদের নির্দিষ্ট একটি স্থানে জায়গা করে দিচ্ছেন। আমিরের স্ত্রীরা প্রাক্তন হচ্ছেন। কিন্তু আমির তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন করছেন না। প্রাথমিকভাবে স্ত্রীরা যখন মনের দিক থেকে ভেঙে পড়তে চলেছেন, আমির তখন সময় নিয়ে তাঁদের বোঝাচ্ছেন। ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী দের আর্থিক ও সামাজিক ভার নিচ্ছেন। কিন্তু স্ত্রীদের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কে থাকছেন না। এর আগে বলিউডে সলমনের বাবা সেলিম খান, ধর্মেন্দ্র, সঞ্জয় খান, উদিত নারায়ণ, বনি কাপুরেররা এই চেষ্টা করেছিলেন। এঁদের মধ্যে সেলিম খান, ধর্মেন্দ্র, উদিত নারায়ণেরা প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স না দিয়েই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। কিছু মানসিক ক্লেশের মধ্য দিয়ে গেলেও সেটল করতে পেরেছেন। ঋত্বিক রোশনের প্রাক্তন শ্বশুর সঞ্জয় খান জিনাত আমনের সঙ্গ ছেড়ে স্ত্রী জারিন খানের কাছে আবার ফিরে এসেছেন। কিন্তু আমির খান বলিউডের প্রথম সেলিব্রিটি যিনি ডিভোর্স দেওয়া স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েদের সঙ্গে রিলেশন রেখেও নতুন কোনও সম্পর্কের দিকে এগোচ্ছেন। সেদিক থেকে আমির ব্যতিক্রম তো বটেই। বলিউডে আমির খান এক নতুন ট্রেন্ড সেট করতে চলেছেন।আর এটা সম্ভব হচ্ছে আমিরের আর্থ -সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য। আমির এই মুহূর্তে বলিউডের এক প্রতিষ্ঠানের মত। তাই নবাগত বা অত্যন্ত সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়েদের কাছে বাড়িয়ে দেওয়া হাত অবধারিত ভাবে গৃহীত হচ্ছে। আর আমির এভাবেই এক সম্পূর্ণ নতুন নজির সৃষ্টি করছেন।
আমির এমনিতে খুব প্রাইভেট মানুষ। প্রাইভেসিতে জোর দেন। কিন্তু বলিউডের তাবড় সেলিব্রিটিরা যা মনে-প্রাণে চেয়েও পারেন নি, সেই কাজটাই আমির করছেন সম্পূর্ণ নিজের ফর্মুলায়। কাজটা খুব সহজ নয়। কিন্তু দেখানো মানবিকতার মোড়কে বা আধুনিকতার সংজ্ঞায় তা আদতে কতটা মানবিক আর কতটা একনায়ক তন্ত্রকে জায়গা করে দেওয়া, তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে। যেমন হিন্দি সিনেমার প্রবীণ সাংবাদিক হানিফ জাভেরি আমিরের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেন না। আর একজন নাম না লিখতে বলে বললেন, 'মনে পড়ে, রিনা দত্তের সঙ্গে আমিরের বোঝা না বোঝার খেলাটা? খেয়াল করে দেখেছেন, শুটিংয়ের বাইরে লাদাখে কিরণ রাওকে সঙ্গে নিয়ে আমিরের নাচের দৃশ্যে কিম্বা কিরণকে নিয়ে জয়েন্ট ভিডিও স্টেটমেন্টের সময় কিরণের মুখটা? যে মুখে কিরণ ২০০৪ কিম্বা ২০০৫ বা তার পরের সময়ে কথা বলেছেন, এটা কি সেই মুখচ্ছবি? এগুলো লুকিয়ে রাখা যায় না।'আমির প্রাইভেট মানুষ। যে কোনও মানুষেরই প্রাইভেট লাইফ থাকে। কিন্ত বিখ্যাতরা যা করেন, সমাজে তার প্রতিফলনটা জোরদার প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। সেজন্যই বিখ্যাতদের দিয়ে সরকারি, বেসরকারি প্রচারের কাজও করানো হয়। বিজ্ঞাপনের জগতে বিখ্যাতদেরই কদর। আমিরের এই নতুন ট্রেন্ড সেটিং 'লগান', 'তারে জমিন পর', 'থ্রি ইডিয়টস', 'দঙ্গল' সিনেমার মত কোনও সফল ট্রেন্ড সেটিং সিনেমার মত গৃহীত হবে কি ভবিষ্যতে? এই মুহূর্তে এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।